আগে ঘুষ, পরে কাজ

অতিরিক্ত টাকা বা ঘুষ ছাড়া কোন কাজই হয় না গাংনী সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে। সরকারি ধার্যকৃত টাকার বাইরেও বিভিন্ন খাতের অযুহাতে নেওয়া হচ্ছে অতিরিক্ত টাকা। টাকা দিতে না চাইলে হয়রানি করা হচ্ছে সেবা গ্রহীতাদের। নকল নবিশ, মহুরী ও অফিস সহকারীদের ব্যবহার করা হচ্ছে এই অতিরিক্ত অর্থ আদায়ে।

এছাড়াও দলিল প্রতি প্রায় ৫’শ টাকা অতিরিক্ত দিতে হয় বলেও জানা গেছে। এমনকি মুজিববর্ষ পালনের নামেও অতিরিক্ত আরও ১শ টাকা নেওয়া হচ্ছে সেবা গ্রহীতাদের কাছ থেকে। আদায়কৃত টাকাগুলো সাব-রেজিস্টারসহ সকল কর্মচারী ও উপর মহলের মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারা করা হয়। সম্প্রতি ঘুষের টাকা বণ্টনে বৈষম্য থাকায় সাব-রেজিস্টারের সাথে দু‘একজন অধিনস্থ কর্মচারীর মধ্যে মনোমালিন্যর ঘটনাও ঘটেছে।

মেহেরপুরের মুজিবনগর সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের নকল নবিশ রতনকে জেলা রেজিস্টারের অনুমতি ছাড়া গাংনী সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে দায়ীত্ব পালন করানো হচ্ছে। ওই নকল নবিশের কথাতেই উঠতে বসতে হয় অফিসের অন্যান্য কর্মকর্তা কর্মচারীদের। গাংনী সাব-রেজিস্ট্রিার মাহফুজ রানার নেতৃত্বেই এই কাজ হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছে অনেকে।

গাংনীর সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের ঘুষ বন্ধের জন্য এর আগে নাগরিক কমিটি গঠিত হয়। এর আগে গাংনী সাব রেজিস্টার অফিসে দুর্নীতির প্রতিবাদে এই কমিটি জমি রেজিস্ট্রি অনির্দৃষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দিয়েছিল। পরে জনসমাবেশ করে সাবেক সাব-রেজিস্টার আব্দুর রশিদ মন্ডলকে ঘুষ না খাওয়ার অঙ্গিকার করে নেয় এলাকাবাসি। চলতি বছরের ৯ ফেব্রুয়ারি যোগদান করেন বর্তমান সাব-রেজিস্টার মাহফুজ রানা। এরপর থেকেই নিজের মত কৌশলে চালিয়ে যাচ্ছে ঘুষ বাণিজ্য।

এনিয়ে দৈনিক মেহেরপুর প্রতিদিন পত্রিকায় “গাংনীতে সাব-রেজিস্টার মাহফুজ রানার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ, দলিল প্রতি ঘুষ নেন কমপক্ষে ৩৫০ টাকা, কখনও তার বেশি” শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশও হয়। তারপরও থামেনি তার ঘুষ নেওয়া। জানা গেছে, বিভিন্ন মহলকে ম্যানেজ করে চালিয়ে যাচ্ছেন অবাধ ঘুষ বাণিজ্য।

কয়েকজন ভুক্তভোগী জানান, নিয়ম অনুযায়ী প্রতি লাখে পৌর এলাকার জন্য লাখে সাড়ে ৮ হাজার। পৌর এলাকার বাইরে হলে লাখে সাড়ে ৬ হাজার টাকা রেজিস্ট্রি ফিস নেয়ার কথা। কিন্তু বিভিন্ন খাতের কথা বলে অতিরিক্ত নেয়া হচ্ছে লাখে এক হাজার থেকে দেড় হাজার টাকা। টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানালে বিভিন্ন হয়রানি হতে হয়েছে। পরে বাধ্য হয়ে টাকা দিতে হয়েছে। জমি ক্রয় বিক্রয়ে জনদুর্ভোগের শিকার হতে হয়েছে আমাদের।

কয়েকজন দলিল লেখক জানান, লাইসেন্স নবায়ন বাবদ তাদের কাছ থেকে জেলা রেজিস্টারের নামে অতিরিক্ত টাকা নিয়েছেন বর্তমান সাব রেজিস্টার মাহফুজ রানা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অফিসের এক দলিল লেখক জানান- এখানকার অসাধু কর্মচারীরা ডিআর (জেলা রেজিস্টার) মহোদয়ের অডিট ব্যয়, নজরানা ও দলিল ফাইলিংয়ের নামে দলিল প্রতি ৩৫০ টাকা থেকে ৫০০ টাকা, মসজিদ উন্নয়ন বাবদ ৫০ টাকা, ও নকল সরবরাহের জন্য এক হাজার টাকা থেকে দেড় হাজার টাকা, হেবা দলিল রেজিস্ট্রিতে ১৫শ টাকার স্থলে তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকা নেয়া হয়।

হেবা দলিল সম্পাদনে এক এর অধিক খতিয়ান হলে প্রতি খতিয়ান বাবদ আরও এক হাজার করে টাকা নেয়া হয়। নাম্বারিং দলিলে ২হাজার টাকা পর্যন্ত আদায় করছে। জমির শ্রেণি পরিবর্তন করে দলিল সম্পাদনে টাকা নেয়ারও অভিযোগ সাব-রেজিস্টারের উপরে। এছাড়াও টাকার বিনিময়ে জমি খারিজ ছাড়াও দলিল রেজিস্ট্রি হয় বলে জানাগেছে।

গাংনী সাব রেজিস্ট্রি অফিসের একজন জানান, বণ্টননামা এবং অসিয়ত দলিলের মূল্যের উপরও অফিসকে অতিরিক্ত ঘুষ দিতে হয়। দলিলের ও খারিজের মূল কপি ছাড়া দলিল করতে আসলে সাব রেজিস্টারকে পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত ঘুষ দিতে হয় । এসএ এবং আরএস খতিয়ানের সার্টিফিকেট কপি জেলা প্রশাসকের রেকর্ড রুম থেকে সংগ্রহ করার পরও দলিল করতে গেলে ‘এটি ঠিক নয়’ জানিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা নেয়া হয়। এদিকে লাইসেন্স বাতিলের ভয়ে দলিল লেখকরা টাকা দিতে বাধ্য হয়েছেন বলেও জানান।

কমিশনের (অফিসের বাইরে গিয়ে দলিল সম্পাদন) সরকারি ফি ৩০০ টাকা (উপজেলার মধ্যে)। কিন্তু সাবরেজিস্টার নেন ৩ হাজার টাকা। ঢাকা, অন্য কোনও জেলা কিংবা বিভাগের বাইরে কমিশনের মাধ্যমে দলিল হলে সরকারি ফি’র ১০গুণ বেশি টাকা নেন সাব-রেজিস্টার। এই দলিল লেখক জানান, সাব রেজিস্টার এখনও দলিল সম্পর্কে অভিজ্ঞ নন।

মুজিবনগর অফিসের নকল নবিশ রতন ‘দলিল ঠিক আছে’ এমন নিশ্চিত তথ্য দেবার পরেই তিনি দলিল সনাক্ত করেন। তিনি আরও জানিয়েছেন, গাংনী রেজিস্ট্রি অফিসের নকল নবিশের সাথে আর্থিক লেনদেনে বিরোধ হবার কারণে তাকে মুজিবনগর রেজিস্টি অফিসে পাঠিয়েছেন। আর আজ্ঞাবহ হওয়াতে রতনকে মুজিবনগর থেকে পুনরায় গাংনী অফিসে নিয়ে এসেছেন সাব-রেজিস্টার মাহফুজ রানা। যা জেলা রেজিস্টার জানেন না।

ভুক্তভোগী অনেক দলিল লেখক জানান, দলিল সম্পাদনকালে দলিলে ভুল-ত্রুটি ধরে তাদের কাছ থেকে অতিরিক্ত টাকা আদায় করা হয়। ভুল-ত্রুটি ধরার পর টিসি মোহরার (ট্যাক্স কালেকটর মোহরার) আজাদ ও নকল নবিশ রতনের হাতে অতিরিক্ত টাকা না দিলে সম্পাদনে অপারগতা জানান সাব রেজিস্টার।

এছাড়াও সাংবাদিকদের সাথে খারাপ আচরণের অভিযোগও রয়েছে এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে।

এ বিষয়ে গাংনী সাব-রেজিস্টার মাহফুজ রানাকে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি অফিসে গিয়ে কথা বলতে বলেন।

জেলা রেজিস্টার সাইফুল ইসলাম জানান, গাংনী সাব রেজিস্টারের নামে অভিযোগ আসতেই আসছে। লিখিত অভিযোগ না পাওয়াতে কোন পদক্ষেপ নিতে পারেন না। মুজিবনগরের নকল নবিশ গাংনীতে দায়ীত্ব পালনের বিষয়টি তার জানার বাইরে বলে জানান। তবে তিনি বিষয়টি দেখবেন এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন বলে জানান।