আম বয়ানের মধ্যে দিয়ে বিশ্ব ইজতেমা দ্বিতীয় পর্ব শুরু

গতকাল শুক্রবার বাদ ফজর আম বয়ানের মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছে বিশ্ব ইজতেমার দ্বিতীয় পর্ব। টঙ্গীর তুরাগ নদীর তীরে বিশ্ব ইজতেমার দ্বিতীয় পর্বে অংশ নিচ্ছেন দিল্লির মাওলানা সাদ কান্ধলভীর অনুসারীরা।

গতকাল শুক্রবার বাদ ফজর পাকিস্তানের মাওলানা ওসমানের আম বয়ানের মধ্যদিয়ে ইজতেমার দ্বিতীয় পর্বের আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হয়। বাংলায় তরজমা করেন মাওলানা জিয়া বিন কাসিম।

ময়দানে অবস্থানরত বিদেশিদের জন্য মূল বয়ানটি আবার তাদের নিজ নিজ ভাষায়ও তাৎক্ষণিক অনুবাদ করা হয়।

আয়োজকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, বিশ্ব ইজতেমার মূল পর্ব শুক্রবার থেকে শুরু হওয়ার কথা থাকলেও গত বুধবার থেকেই দলে দলে তাবলীগের মানুষরা ইজতেমা ময়দানে এসে অবস্থান নিয়েছেন। তারা দলে দলে মাঠের ভেতরে ঢুকে নিজ নিজ জেলার খিত্তায় অবস্থান নিতে শুরু করেছেন। মানুষের উপস্থিতিতে ইজতেমা ময়দান পূর্ণ হয়ে গেছে।

ইজতেমা ময়দানে বিদেশি মেহমানদের জন্য পশ্চিম-উত্তর দিকে আলাদা তাবু নির্ধারিত রয়েছে। সেখানে আধুনিক সব ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। আর দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আসা মানুষদের অবস্থানের জন্য দ্বিতীয় পর্বে পুরো ইজতেমা ময়দানকে জেলা ওয়ারী ৮৫টি খিত্তায় ভাগ করা হয়েছে।

এদিকে গতকাল শুক্রবার জুম্মা নামাজের জন্য লাখো লাখো মুসল্লী অংশ নিতে সকাল থেকে জমায়েত হয়েছে।
গতকাল শুক্রবার জুম্মার নামাজ পরিচালনা করেন মাওলানা সা’দ কান্ধলভীর বড় ছেলে মাওলানা ইউসুফ কান্ধলভী। বাস, ট্রাক, ট্রেন বা পায়ে হেঁটে টুপি-পাঞ্জাবি পরিহিত তাবলীগ জামাতের অনুসারীরা টঙ্গীর ইজতেমা ময়দানে আসছেন। মানুষের এ স্রোত এখনও অব্যাহত রয়েছে। রোববার আখেরি মোনাজাতের আগ পর্যন্ত মানুষের এ আগমন অব্যাহত থাকবে।

আম বয়ানে শুরু ইজতেমার দ্বিতীয় পর্ব
খাবার ও গোসলের বিরতি দিয়ে রোববার পর্যন্ত চলবে ঈমান-আমলসহ তাবলীগের ছয় উসুলের বয়ান। সেদিন হেদায়তী বয়ান শেষে অনুষ্ঠিত হবে আখেরি মোনাজাত।

কুষ্টিয়া থেকে ইজতেমায় যোগ দিতে আসা শামস সুমন বলেন, দশ বছর আগে একবার এসেছিলাম। আবার গতকাল সকালে রওনা হয়ে রাতে ইজতেমার মাঠে যোগ দিয়েছি। তিনি বলেন, মিরপুর উপজেলার বারুইপাড়া ইউনিয়ন থেকে একটি বাসযোগে ৫০ জন এই ইজতেমায় এসেছেন। দ্বীন ও ইসলাম বিষয়ে নানান আলোচনায় মশগুল ছিলাম সারাদিন।

বিশ্ব ইজতেমার আয়োজক কমিটির সুরা সদস্য মাওলানা সৈয়দ ওয়াসিফুল ইসলাম জানান, ২০১৯ সাল থেকে ভারতের মাওলানা সাদ কান্ধলভী বাংলাদেশে বিশ্ব ইজতেমায় যোগ না দিলেও এবার দ্বিতীয় পর্বের ইজতেমায় যোগ দিতে তার ছেলে মাওলানা ইউসুফ বিন সাদ কান্ধলভী, মাওলানা সাঈদ বিন সাদ কান্ধলভী, মাওলানা ইলিয়াস বিন সাদ কান্ধলভী এবং মেয়ের জামাতা মাওলানা হাসান বৃহস্পতিবার দুপুরে টঙ্গীর ইজতেমা মাঠে এসে যোগ দিয়েছেন।

মাওলানা সাদ-এর তিন ছেলেই ইজতেমায় বয়ান করেন।
বিশ্ব ইজতেমার মিডিয়া সমন্বয়কারী মোহাম্মদ সায়েম বলেন, গতকাল শুক্রবার জুম্মার নামাজ ও বিশ্ব ইজতেমার আখেরি মোনাজাত পরিচালনা করবেন মাওলানা সাদ কান্ধলভীর বড় ছেলে মাওলানা ইউসুফ কান্ধলভী। গতকাল শুক্রবার দুপুর সোয়া একটার দিকে জুম্মার খুৎবা দেওয়া হবে, বলেন তিনি। এদিকে বিশ্ব ইজতেমার দ্বিতীয় পর্বে ভালভাবে শেষ করতে ব্যাপক নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন গাজীপুর মেট্টোপলিটন পুলিশের কমিশনার মোল্যা নজরুল ইসলাম।

তিনি বলেন, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রায় ১০ হাজার সদস্য ইজতেমায় কাজ করছেন। ব্যাপক নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। আগত মুসল্লিদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে পুরো ইজতেমা ময়দানকে কয়েকটি সেক্টরে ভাগ করে নিরাপত্তা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।”

প্রসঙ্গত, সংরক্ষিত ইতিহাস অনুসারে মাওলানা ইলিয়াস কান্ধলভি (রহ.)-এর হাত ধরে ১৯২৭ সালে উপমহাদেশে দাওয়াত ও তাবলিগের কাজের সূচনা হয়। মাওলানা আবদুল আজিজের মাধ্যমে ১৯৪৪ সালে বাংলাদেশে তাবলিগের কাজ শুরু হয়। তাবলিগ জামাতের কাজ প্রসার লাভ করলে তাবলিগ জামাতের অনুসারীদের এলাকাভিত্তিক সম্মেলনের সূচনা করেন মাওলানা ইলিয়াস (রহ.)। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর দুই পাকিস্তান ও ভারতে সম্মিলিত ইজতেমার উদ্যোগ নেওয়া হয়। বাংলাদেশের কাকরাইল, ভারতের ভুপাল এবং পাকিস্তানের রাইভেন্ডে ইজতেমার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ধর্মীয়, সামাজিক ও পারিপার্শ্বিক অন্যান্য কারণে প্রথম থেকেই বাংলাদেশের ইজতেমার আয়তন অন্য দুই দেশের চেয়ে বেশি ছিল। ফলে ক্রমেই তা প্রাধান্য লাভ করতে থাকে এবং বিশ্ব ইজতেমায় রূপ নেয়।

বাংলাদেশে ইজতেমা : ১৯৪৬ সালে প্রথমবারের মতো কাকরাইল মসজিদের ভেতরে ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর ১৯৪৮ সালে চট্টগ্রামের হাজি ক্যাম্পে এবং ১৯৫৮ সালে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে তাবলিগ জামাতের ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়। দিন দিন লোকসংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় ১৯৬৬ সালে টঙ্গীর পাগাড় গ্রামের কাছে (টঙ্গীর মনসুর জুট মিলের নিকটে) একটি মাঠে ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এই ইজতেমায় বিদেশি কয়েকটি জামাতও অংশ নেয়। এখান থেকেই এর নাম হয় বিশ্ব ইজতেমা। ১৯৬৭ সালে টঙ্গীর তুরাগ নদের পারে প্রথমবারের মতো বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সরকার তুরাগ পারের ১৬০ একর জমি তাবলিগ জামাতের জন্য বরাদ্দ দেয়। ২০১৫ সাল পর্যন্ত বিশ্ব ইজতেমা এক পর্বে অনুষ্ঠিত হতো। তবে লোকসংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় ২০১৬ থেকে একাধিক পর্বে ইজতেমা করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

ইজতেমা যেভাবে বিশ্ব ইজতেমা : কথিত আছে, বাংলাদেশকে বিশ্ব ইজতেমার স্থান হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছিল লটারির মাধ্যমে। তবে তাবলিগ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলেন, বিষয়টি তাদের অজ্ঞাত। তাদের দাবি, দেশভাগের পর উদ্ভূত পরিস্থিতিতে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশ), পশ্চিম পাকিস্তান ও ভারতে পৃথক ইজতেমার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। তখন একই সঙ্গে তিন ভূখণ্ডে ইজতেমা শুরু হয়। তবে অধিকসংখ্যক লোকের অংশগ্রহণ, স্বল্প ব্যয়ভার, ভিসাপ্রাপ্তির সহজতা, সাধারণ মুসলমানের আন্তরিকতা, অনুকূল পরিবেশ, সামাজিক ও ধর্মীয় সহিষ্ণুতা ইত্যাদি কারণে বাংলাদেশের ইজতেমা সারা বিশ্বের তাবলিগ জামাতের অনুসারীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ক্রমেই বাংলাদেশ ইজতেমা বিশ্ব ইজতেমায় পরিণত হয়।