
আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বিষয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ইতোমধ্যেই ঘোষণা দিয়েছেন।
গত ৪ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে সদ্য পদায়ন পাওয়া দেশের সব জেলার পুলিশ সুপারদের সঙ্গে বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, এই নির্বাচন আমাদের নতুন বাংলাদেশের দরজা খুলে দেবে। কাজেই নতুন বাংলাদেশের যে জন্ম হবে, এখানে যারা (এসপি) উপস্থিত আছি তাদের ভূমিকা হলো ধাত্রীর ভূমিকা। আমরা যেন সুন্দর, সুষ্ঠুভাবে সেই জন্মটা দিতে পারি।
নির্বাচনকালীন দায়িত্বপালন ও মাঠপর্যায়ের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এসপিদের প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনা দেওয়ার জন্য এই বৈঠকের আয়োজন করা হয়েছিলো।
এ বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা আরও বলেছিলেন নির্বাচন পরিদর্শন করতে বাইরের যারা পর্যবেক্ষক দল আসবে, তারা আমাদের খুঁত ধরার চেষ্টা করবে। আমাদের এটা হয়নি, ওইটা হলে ভালো হতো- বলবে। এবারের নির্বাচন হলো এমন নির্বাচন, তারা (পর্যবেক্ষক) স্মরণ করবে, বাংলাদেশের নির্বাচন আমরা দেখেছিলাম, এটা এমন। তারা নানা দেশে এটা বলবে। তারা একটা দৃষ্টান্ত হিসেবে নিয়ে যাবে তাদের মাথায়।
তারা বারেবারে বলবে, এই নির্বাচনের মতো নির্বাচন আমরা কখনো দেখিনি। এখানে যে নির্বাচন আমরা দেখে গেলাম, এটা আমাদের একটি স্মরণীয় নির্বাচন। সেই ধরনের একটি নির্বাচন আমরা করে রেখে যেতে চাই। এটা সাধারণ নির্বাচন নয়। যে পাঁচ বছর পর পর একটি নির্বাচন হয়, দেশের সরকার পরিবর্তন হয়। এটা রুটিন একটা কাজ। এবারের নির্বাচনে যেটা বারবার আন্ডারলাইন করা দরকার, এটা গণঅভ্যুত্থানের পরবর্তী নির্বাচন। গণঅভ্যুত্থানে যারা শরিক হয়েছিল, আমরা যারা যুক্ত আছি, তাদের আদর্শ, স্বপ্ন বাস্তবায়ন আমরা এই নির্বাচনের মাধ্যমে করে যাবো। যে স্বপ্ন দেখার মাধ্যমে তোমরা আত্মত্যাগ করেছ, সেই স্বপ্নকে আমরা স্থায়ী রূপদান করতে যাচ্ছি।
বর্তমান নির্বাচন কমিশন পুরোদমে আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে সকল প্রস্তুতি গ্রহণ করে বাস্তবায়ন শুরু করেছে। রাজনৈতিক দলগুলোও নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু করেছে। মোট কথা সমগ্র দেশ এখন নির্বাচনমুখী। এসব প্রস্তুতিসহ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বারবার দ্যার্থহীন ভাষায় বলার পরও কিছু কিছু মহল থেকে নির্বাচনের বিষয়ে অসৎ উদ্দেশ্যে গুজব ছড়ানো হচ্ছে। সম্প্রতি জরিপ পরিচালনাকারী গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘ডিজিটালি রাইট’ বলছে, নির্বাচনের সংবাদ সংগ্রহের সময় শারীরিক হুমকির পাশাপাশি ডিজিটাল হয়রানি বাড়ারও আশঙ্কা করছেন জরিপে অংশ নেয়া সাংবাদিকেরা। জার্নালিস্ট সেফটি ইন ২০২৬ ইলেকশন’ শিরোনামের এ গবেষণা ১৯টি জেলার ২০১ জন সাংবাদিকের ওপর জরিপ চালানো হয়েছিলো এবং ১০টি ‘ইনডেপথ’ সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছিলো। এ জরিপে ৭৫ শতাংশ সাংবাদিক বলেছেন, তাদের বা তাদের সংবাদমাধ্যমের বিরুদ্ধে অপতথ্য বা ‘ডিসইনফরমেশন’ ছড়ানোর আশঙ্কা বেশি। উত্তরদাতাদের অর্ধেকেরও বেশি মনে করেন তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট করার উদ্দেশ্যে মানহানিকর প্রচারণাও চালানো হতে পারে। গবেষণায় উঠে এসেছে, বেশিরভাগ সংবাদমাধ্যমেরই এই ঝুঁকি মোকাবিলার জন্য যথেষ্ট প্রস্তুতি নেই।
নির্বাচনী মৌসুম সবসময় গুজব ও প্রোপাগান্ডার জন্য উর্বর ভূমি। অতীতে প্রার্থীদের নিয়ে ভুয়া খবর বা মনগড়া কেলেঙ্কারি ছড়ানো হয়েছে। আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও এধরনের অপতথ্য ছড়ানোর হচ্ছে। এজন্য সংশ্লিষ্ট সকলকে সচেতন থাকতে হবে এবং জনগণকে এ বিষয়ে সচেতন করতে হবে। বাংলাদেশে ইতোমধ্যেই অনলাইন গুজব সহিংসতায় রূপ নিয়েছে। আমাদের সবচেয়ে বড়ো ক্ষতি হলো আস্থার অবক্ষয়। যখন নাগরিকরা সত্য মিথ্যা আলাদা করতে পারে না, তখন তারা সত্য বা বৈধ সংবাদকেও সন্দেহের চোখে দেখে। ফলে শুরু হয় বিভ্রান্তি। ওইসব বিভ্রান্তি থেকে ব্যক্তিগত নিরাপত্তা, নাগরিক মানবাধিকার ও সাংবিধানিক অধিকারকে হুমকির মুখে ফেলে, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। আমাদের দেশে ডিজিটাল লিটারেসি অনেক কম; তাই এআই সৃষ্ট কনটেন্টগুলো মানুষ সহজে বিশ্বাস করে। ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রামের প্রায় ৮০ শতাংশ পোস্টই এআই রিকমেন্ডশনে তৈরি।
আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বিষয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মিথ্যা তথ্য ও গুজবের হিড়িক পড়ে যাচ্ছে। ব্যক্তিগত উদ্যোগে কেউ কেউ সেসব মিথ্যা খণ্ডনের চেষ্টা করেছেন। কিন্তু মিথ্যা যে গতিতে ছড়ায়, সেই গতিতে সত্যকে ছড়ানো সত্যিই কঠিন। ‘ফ্যাক্টচেক’ করা প্রতিষ্ঠানগুলোও জনগুরুত্বপূর্ণ বিবেচনায় তথ্য যাচাই করে। কিন্তু একজন সাধারণ মানুষের কোনো তথ্য যাচাইয়ের দরকার হলে সেটি যাচাইয়ের সহজ কোনো উপায় অতীতে না থাকলেও বর্তমানে আছে। প্রযুক্তির মাধ্যমে ছড়ানো অপতথ্য বা গুজব নির্ণয়ের জন্য প্রযুক্তির সাহায্যের বিকল্প নেই। তার আগে জানা দরকার নির্বাচন সংক্রান্ত গুজব কেন ছড়ানো হচ্ছে? আর কেনই বা ছড়াচ্ছে? একটি অসাধু চক্র পরিকল্পিতভাবে অসৎ উদ্দেশ্যে দেশকে অস্থিতিশীল করতে এবং দেশে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ফিরিয়ে নিতে বাধাগ্রস্ত করতে গুজব ছড়াচ্ছে। বিভিন্ন রকম ফটোকার্ড করে সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে ছড়ানো হচ্ছে। সে সব ফটোকার্ডে নির্বচন নিয়ে নানারকম অনিশ্চয়তার কথা বলা হচ্ছে। কিছু কিছু মিডিয়ার নামে ভুয়া ফটোকার্ড করে সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে।
এআই এর এই রেভুলেশনের পিরিয়ডে এমন জেনারেটেড ছবি নিয়ে অসৎ উদ্দেশ্যে করা কাজ হরহামেশাই ঘটছে। তাই এআই জেনারেটেড ছবি কীভাবে শনাক্ত করা যায় তার কৌশলের নির্ভরযোগ্য উপায় হচ্ছে মেটা ডেটা বিশ্লেষণ। প্রতিটি ছবির সাধারণত কিছু প্রযুক্তিগত তথ্য থাকে। যাকে বলা হয় মেটা ডাটা। যেমন কবে, কখন, কোথায় কোন ডিভাইস দিয়ে ছবিটি তোলা হয়েছে, তার বিস্তারিত তথ্য এখানে পাওয়া যায়। যে কোনো ছবির মেটা ডেটা বিশ্লেষণ করলেই অনেকটা ক্লিয়ার হওয়া যায়। এআই জেনারেটেড ছবিতে এমন তথ্য থাকে না। অনেক সময় কোন সফ্টওয়্যার দিয়ে ছবিটি তোলা হয়েছে তাও চলে আসে। wasit ai image detector, sightengine ai image detector, Photo-Me ও metadata2go -এর মতো ওয়েব সাইডগুলোর মাধ্যমে খুব সহজেই ছবির মেটা ডেটা বিশ্লেষণ করা সম্ভব। এছাড়াও মোবাইল ফোনের মাধ্যমেও মেটা ডেটা বিশ্লেষণ করা সম্ভব। এনড্রয়েড ফোনের জন্য গুগল প্লে স্টোর থেকে Photo Exit Editor Metadata -APPS টি ডাউনলোড করে এর মাধ্যমে ছবির বিস্তারিত জানা সম্ভব। আবার আইফোনের ক্ষেত্রে এক্সিট ভিউয়ের মাধ্যমে ছবি যাচাই করা সম্ভব। ছবি যাচাইয়ের আর একটি পদ্ধতি হলো রিভার সার্চ। এজন্য যে ছবিটির সত্যতা যাচাই করা হবে সেটি আবারও গুগল সার্চ করতে হবে। এআই জেনারেটেড ছবি হলে পালটা সার্চে সে ছবি কম দেখা যাবে। আবার নাও দেখা যেতে পারে। আবার আসল ছবি হলে অন্যান্য অথিন্টিক সোর্স বা ওয়েব সাইড পাওয়া যাবে। এর বাইরে এআই সনাক্ত করার কিছু টুলস রয়েছে। সেগুলো ব্যবহার করে ছবি আসল না নকল সহজেই বের করা যায়। এসব এর বাইরে নিজের চোখ ও বিবেচনা বোধকে কাজে লাগাতে হবে। কোনো ছবির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে একটু সময় নিয়ে বিশ্লেষণ করতে হবে। ছবির হাতের আঙুলগুলো স্বাভাবিক আছে কি না? স্ক্রিন অতিরিক্ত নিখুঁত কি না? ছবির ব্যাকগ্রাউন্ড অতিরিক্ত ঘোলা কি না? এসব বিশ্লেষণ করে ছবির সত্যতা অনেকাংশে নিরূপণ করা সম্ভব।
আমাদের দেশে ফ্যাক্টচেকিংয়র কাজ অনেকেই করে থাকে। এআইভিত্তিক ফ্যাক্টচেকিং ওয়েবসাইট ‘খোঁজ’ এর মাধ্যমে ব্যবহারকারী নিজেই যে-কোনো তথ্য যাচাই করে নিতে পারবেন। কোনো মানুষের সাহায্য লাগবে না। তথ্য যাচাইয়ের সম্পূর্ণ কাজটিই করবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই। খোঁজ-এ কোনো কিছু যাচাই করতে দেওয়া হলে প্রথমে এটি ইন্টারনেট, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, নিউজ আর্কাইভ এবং মাল্টিমিডিয়া উৎস থেকে তথ্য সংগ্রহ করে। এরপর উৎসগুলোর নির্ভরযোগ্যতা যাচাই করে। প্রাসঙ্গিকতা ও ভাষাগত মিল পরীক্ষা করে টেক্সট এবং ছবি বিশ্লেষণ করে ফলাফল দেয়। নির্ভরযোগ্য উৎস উল্লেখ করে খোঁজ জানায় দাবিটি সত্য, বিভ্রান্তিকর, নাকি সম্পূর্ণ ভুল। ফলাফলের সঙ্গে একটি বিস্তারিত বিশ্লেষণ দেয় খোঁজ, সেখানে উল্লেখ থাকে কোন কোন উৎস থেকে তথ্য যাচাই করা হয়েছে। ব্যবহারকারী চাইলে নিজেও উৎসগুলোতে গিয়ে তথ্যটি ফের যাচাই করতে পারবেন। কোনো তথ্য যাচাই করতে না পারলেও খোঁজ সেটি জানিয়ে দেয়, কিন্তু ভুল তথ্য দেখায় না। খোঁজ বর্তমানে ওয়েবসাইটভিত্তিক প্ল্যাটফর্ম। এটিকে মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন (অ্যাপ) হিসেবে আনার কাজ চলছে।
ভুল তথ্য চিহ্নিত করার জন্য যেসব পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়ে থাকে তার একটি হলো SIFT। এখানে S মানে হলো স্টপ; সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কোনও খবর দেখামাত্র তাৎক্ষণিকভাবে তা শেয়ার করা যাবে না। এমনকি সেখানে কোনও মন্তব্যও করা যাবে না। I দিয়ে বুঝানো হয়েছে- ইনভেস্টিগেট দ্য সোর্স (উৎস যাচাই); একটি তথ্যের উৎস কী, এ প্রশ্ন নিজেকে প্রতিনিয়ত করতে হবে। ‘F দিয়ে বুঝানো হচ্ছে ফাইন্ড বেটার কাভারেজ; উপরের ধাপের মাধ্যমে বিশ্লেষণের পর যদি সোর্সের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন থাকে, তাহলে আরেকটু ভাবতে হবে। T মানে ট্রেস দ্য ক্লেইম টু ইটস অরিজিনাল কনটেক্সট। উপরের তিনটি ধাপ-ই অনুসরণ করার অর্থ হলো, আরও ভালো এবং নিখুঁত সংবাদের খোঁজ করতে হবে।
তথ্যপ্রযুক্তির এই দ্রুত পরিবর্তনশীল সময়ে সত্য আর বিভ্রান্তির সীমারেখা আগের চেয়ে অনেক বেশি ঝাপসা হয়ে গেছে। তাই দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে আমাদের প্রতিটি তথ্য, ছবি ও দাবির পেছনে একবার হলেও প্রশ্ন তোলা জরুরি। যাচাই ছাড়া শেয়ার নয় এই সচেতন অভ্যাসই পারে গুজবের বিস্তার রুখে দিতে। প্রযুক্তির ইতিবাচক ব্যবহার, এআইভিত্তিক ফ্যাক্টচেকিং টুলের সহায়তা এবং ব্যক্তিগত বিবেচনাবোধ একসঙ্গে কাজে লাগাতে পারলেই তথ্যের জগতে সত্যকে টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে।
লেখক: জনসংযোগ কর্মকর্তা, খাদ্য মন্ত্রণালয়


