
ইলিশ বাংলাদেশের জাতীয় মাছ এবং জাতির গৌরবের প্রতীক। এটি শুধু সুস্বাদু খাবার হিসেবেই নয় বরং দেশের অর্থনীতি, পুষ্টি ও সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে গুরুত্ব বহন করে। দেশের মোট মাছ উৎপাদনের প্রায় এক-চতুর্থাংশ আসে ইলিশ থেকে। যা প্রায় পাঁচ লাখ জেলে পরিবারের জীবিকা নির্বাহের প্রধান উৎস। ইলিশ মূলত সমুদ্রের মাছ হলেও প্রজননের সময় মিঠাপানির নদীতে উঠে ডিম ছাড়ে। বাংলাদেশ সরকার মা ইলিশ সংরক্ষণের জন্য এসময় বিশেষ অভিযান চালায়। ইলিশ সংরক্ষণ সপ্তাহের দুটি রূপ রয়েছে। একটি হলো জাটকা সংরক্ষণয় সপ্তাহ (সাধারণত এপ্রিল মাসে) এবং অন্যটি হলো মা ইলিশ সংরক্ষণ অভিযান (অক্টোবর মাসে)। প্রতিবছর এই সপ্তাহগুলো পালিত হয় ইলিশ মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি এবং এদের প্রজনন ও বেড়ে ওঠার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য।
এবছর ৪ অক্টোবর মধ্যরাত থেকে ২৫ অক্টোবর এই ২২ দিন সারা দেশে নদ–নদীতে ইলিশ ধরার নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। মা ইলিশ রক্ষা করতে বিজ্ঞানভিত্তিক প্রজনন সময় বিবেচনায় এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। প্রতিবছর আশ্বিন মাসের অমাবস্যা ও পূর্ণিমার মধ্যবর্তী সময়কে সামনে রেখে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এসময় সারাদেশে ইলিশ মাছ আহরণ, পরিবহণ, মজুদ, বাজারজাতকরণ, ক্রয়-বিক্রয় ও বিনিময় সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ থাকে। সরকারি ঘোষণা অনুযায়ী, এই সময় ইলিশ আহরণের কোনো প্রকার লঙ্ঘন শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। মৎস্য সংরক্ষণ ও সংরক্ষণ আইন, ১৯৫০ অনুযায়ী অপরাধীদের এক থেকে দুই বছরের জেল এবং পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা বা উভয় দণ্ড হতে পারে।
সরকারের ঘোষিত নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে নৌবাহিনী ১৭টি যুদ্ধজাহাজ দেশের বিভিন্ন জেলায় মোতায়েন করেছে। চাঁদপুর, কক্সবাজার, খুলনা, বাগেরহাট, পিরোজপুর, বরগুনা, বরিশাল ও পটুয়াখালীতে বিশেষ নজরদারি চলছে। অভিযানে জাহাজ, ক্রাফট ও বোটসমূহ সার্বক্ষণিক টহলে নিয়োজিত, পাশাপাশি গভীর সমুদ্রে অবৈধ মাছ শিকার প্রতিরোধে মেরিটাইম পেট্রোল এয়ারক্রাফট ব্যবহার করা হচ্ছে। নৌবাহিনী স্থানীয় প্রশাসন, কোস্টগার্ড, নৌ পুলিশ ও মৎস্য অধিদপ্তরের সঙ্গে সমন্বয় করে অভিযান পরিচালনা করছে।
মৎস্য অধিদপ্তর ও স্থানীয় প্রশাসনের প্রচারণায় সাধারণ মানুষকে সচেতন করে তোলা হয়। এই অভিযানের মাধ্যমে মা ইলিশের নিরাপদ প্রজনন এবং দেশের মৎস্য সম্পদের টেকসই ব্যবহার নিশ্চিত হয়। এতে ইলিশের প্রজনন চক্র সুসংহত হয় এবং মোট উৎপাদন বাড়ে। ফলে দেশের অর্থনীতি যেমন সমৃদ্ধ হয় তেমনি নদীনির্ভর জেলে সম্প্রদায়ের জীবিকা নির্বাহের নিশ্চয়তা তৈরি হয়। ইলিশ বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত, কারণ এটি জনগণের জন্য অন্যতম পুষ্টিকর ও সহজলভ্য প্রোটিনের উৎস। মা ইলিশের জাটকা সংরক্ষণ কর্মসূচির মাধ্যমে সরকার শুধু ইলিশ রক্ষা নয় বরং নদী ও সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণেও ভূমিকা রাখছে। জেলেদের বিকল্প কর্মসংস্থান ও সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে এই উদ্যোগ আরও টেকসই হয়ে উঠছে। মূলত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের খাদ্য ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই মা ইলিশ সংরক্ষণের অন্যতম লক্ষ্য।
ইলিশ সম্পদ সংরক্ষণের জন্য সরকার দীর্ঘদিন ধরেই আইনি ও প্রশাসনিক পদক্ষেপ গ্রহণ করে আসছে। এই সময় ইলিশ ধরা সম্পূর্ণভাবে বন্ধ রাখতে স্থানীয় প্রশাসন, মৎস্য বিভাগ ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কঠোর নজরদারি চালায়। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে টাস্কফোর্স কমিটি গঠন করা হয়, যারা নিয়মিত নদ-নদীতে অভিযান পরিচালনা করে। পাশাপাশি নৌবাহিনী, কোস্টগার্ড, বিজিবি, পুলিশ ও উপজেলা প্রশাসন যৌথভাবে টহল ও অভিযান চালিয়ে অবৈধ কারেন্ট জাল, জাটকা ও মাছ ধরার নৌকা জব্দ করে থাকে। এসব উদ্যোগ ইলিশ সম্পদের স্থায়িত্ব ও প্রজনন নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
মা ইলিশ আহরণ নিষিদ্ধকালে জেলেরা সাময়িকভাবে মাছ ধরতে না পারায় সরকার তাদের জন্য বিভিন্ন সহায়তা ও বিকল্প কর্মসংস্থান কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। প্রতিবছর ভিজিএফ ও ভিজিডি কর্মসূচির আওতায় ক্ষতিগ্রস্ত জেলে পরিবারগুলোকে চালসহ খাদ্য সহায়তা প্রদান করা হয়, যাতে নিষিদ্ধকালীন সময়ে তারা জীবিকা নির্বাহ করতে পারে। পাশাপাশি জেলেদের বিকল্প আয়ের উৎস সৃষ্টির জন্য সরকার ও স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে পোলট্রি, হাঁস-মুরগি পালন, সবজি চাষ, মাছ চাষ, ক্ষুদ্র ব্যবসা ও কারিগরি প্রশিক্ষণ কর্মসূচি পরিচালনা করা হচ্ছে। এই কার্যক্রমগুলোতে স্থানীয় প্রশাসনের পাশাপাশি এনজিও ও বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোও সক্রিয়ভাবে অংশ নিচ্ছে। ফলে জেলেরা ধীরে ধীরে মৌসুমি নির্ভরতা থেকে মুক্ত হয়ে স্থায়ী জীবিকা অর্জনে সক্ষম হচ্ছে, যা টেকসই মৎস্য সম্পদ ব্যবস্থাপনায় ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে।
মা ইলিশ সংরক্ষণে সরকারের পাশাপাশি সাধারণ জনগণের সক্রিয় ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মাছ ধরার সময় সবাইকে মৎস্য সংরক্ষণ আইন মেনে চলতে হবে এবং নিষিদ্ধ সময়ে ইলিশ আহরণ থেকে বিরত থাকতে হবে। নিষিদ্ধ সময়ে ইলিশ বাজারে বিক্রি বা ক্রয় না করা নাগরিক দায়িত্ব হিসেবে পালন করা উচিত। একইভাবে নদীতে অবৈধ কারেন্ট জাল বা সূক্ষ্ম জালের ব্যবহার পরিহার করতে হবে কারণ এসব জাল ইলিশের প্রজনন বৃদ্ধিতে মারাত্মক ক্ষতি করে। শিশু-কিশোর ও তরুণ প্রজন্মকে স্কুল, কলেজ ও স্থানীয় সাংস্কৃতিক কর্মসূচির মাধ্যমে সচেতন করে তুলতে হবে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও জাটকা সংরক্ষণবিষয়ক প্রচারণা চালিয়ে জনমত গঠন করা যেতে পারে। জনগণের সম্মিলিত সচেতনতা ও অংশগ্রহণই ইলিশ সম্পদ রক্ষার সবচেয়ে কার্যকর উপায়।
সরকারের দীর্ঘমেয়াদি এবং সুশৃঙ্খল উদ্যোগের ফলে ইলিশ সম্পদ সংরক্ষণে উল্লেখযোগ্য সাফল্য দেখা দিয়েছে। নিয়মিত জাটকা ও মা ইলিশ সংরক্ষণ, আইনগত ব্যবস্থা ও সচেতনতামূলক প্রচারণার কারণে ইলিশ উৎপাদন ২০০৮ সালে মাত্র ২.৯ লাখ মেট্রিক টন থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে প্রায় ৬ লাখ মেট্রিক টনে উন্নীত হয়েছে। এই সাফল্য শুধু জাতীয় পর্যায়ে নয়, আন্তর্জাতিক মঞ্চেও প্রশংসিত হয়েছে। খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) ও অন্যান্য সংস্থা বাংলাদেশের ইলিশ সংরক্ষণ কার্যক্রমকে উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করেছে। ইলিশ সংরক্ষণ কার্যক্রমের ফলে শুধু মাছের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়নি বরং উপকূলীয় নদী ও খাল-বিল অঞ্চলে জীববৈচিত্র্যও সুসংহত হয়েছে। মৎস্যজীবী সম্প্রদায়ের জীবনযাত্রার মান উন্নত হয়েছে এবং নদী-নিবাসী পরিবেশ রক্ষা পেয়েছে। এই সাফল্য প্রমাণ করে যে, সঠিক নীতি, আইন ও জনগণের অংশগ্রহণ মিলিয়ে টেকসই মৎস্য সম্পদ সংরক্ষণ সম্ভব।
মা ইলিশ সংরক্ষণ ও জাটকা রক্ষায় সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের অধিন দপ্তর/সংস্থা বিশেষত তথ্য অধিদফতর (পিআইডি) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। জেলা তথ্য অফিস, বিটিভি, বাংলাদেশ বেতার, প্রেস ক্লাব, স্থানীয় সংবাদমাধ্যম এবং সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে নিয়মিত প্রচারাভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। এই প্রচারণার মাধ্যমে জনসাধারণকে মা ইলিশ ও জাটকা আহরণের নিষিদ্ধকাল, আইনগত বিধি এবং সচেতন আচরণের গুরুত্ব সম্পর্কে অবহিত করা হয়। নদী তীরবর্তী এলাকায় মাইকিং, পোস্টার, ব্যানার, ভিডিও ক্লিপ, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও স্কুলভিত্তিক সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে, যাতে শিশু-কিশোর ও যুব সমাজও সম্পৃক্ত হয়। সামাজিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার মাধ্যমে বার্তা আরও বিস্তৃতভাবে পৌঁছানো হচ্ছে। এই বহুমুখী প্রচেষ্টা সাধারণ জনগণকে দায়িত্বশীল হতে উদ্বুদ্ধ করছে এবং ইলিশ সম্পদ সংরক্ষণে তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করছে। ফলশ্রুতিতে, মৎস্য সম্পদ সংরক্ষণের জন্য জনসচেতনতা বৃদ্ধি পেয়েছে।
ইলিশ আমাদের জাতীয় মাছ হিসেবে কেবল অর্থনৈতিক সম্পদ নয় বরং বাংলাদেশের প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ। নদী ও সমুদ্রের এই মূল্যবান সম্পদ আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা, পুষ্টি, জীবনযাত্রা ও জেলেদের জীবিকার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত। তাই ইলিশ সংরক্ষণ শুধু প্রশাসনিক দায়িত্ব নয়, এটি সকলের দায়িত্ব। সরকার, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়, স্থানীয় প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী, জেলে সম্প্রদায় এবং সাধারণ জনগণকে একত্রিতভাবে কাজ করতে হবে। একসাথে কাজ করলে ইলিশ সম্পদ টেকসইভাবে সংরক্ষণ করা সম্ভব এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য দেশের প্রাকৃতিক ঐতিহ্য রক্ষা করা সম্ভব হবে।
লেখক: সহকারী তথ্য অফিসার, তথ্য অধিদফতর