ঈদের করোনাকাল ও সেকাল

’ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশীর ঈদ’…….গানটি এই প্রথমবারের মতোন আমাদের মধ্যে মন খারাপের আবেশ তৈরী করছে। যাপিত জীবনে এরচেয়ে নিরানন্দের ঈদ আমাদের জীবনে আসেনি। এবারের এই পার্থক্য তৈরী করে দিয়েছে করোনা। এই মহামারি আমাদের সকল আনন্দ মাটি করে দিয়েছে। অথচ ঈদের রঙ এমন ছিলোনা।

ঈদ মানে, খুশী ঈদ মানে আনন্দ। এই উৎসব এখন শুধু মুসলমান ধর্মের অনুসারীদের নয় এখন এই উৎসব সার্বজনীন। হাজার হাজার বছরের বেশি সময় ধরে এই উৎসব সাম্যের বারতা নিয়ে আসছে। এই আনন্দের ঢেউ ছড়িয়ে পড়ে সমাজের সর্বস্তরে। ধনী-গরিব-যুবক-বৃদ্ধ, নারী-শিশু, কিশোর-কিশোরী সবাই অদৃশ্য এক অনুভূতিতে আলোড়িত হন। এ অনুভূতির রূপভেদ থাকতে পারে। মাত্রাগত পার্থক্য থাকতে পারে। কিন্তু ঈদ সন্দেহাতীতভাবে সবাইকে ছুঁয়ে যায়।

দুই ঈদের মধ্যে ঈদুল ফিতরেই ঘরে ঘরে সাড়া পড়ে বেশি। দীর্ঘ একটি মাস রোজা রাখার পর পশ্চিম আকাশে এক ফালি চাঁদ ওঠে। চাঁদ দেখেই মনের গহীনে রিন্ রিন্ করে বেজে ওঠে ঈদের খুশির ঘণ্টাধ্বনি। ঈদের মূল আনন্দ ও চেতনা সকল কালে এক ও অভিন্ন কিন্তু এবারে পার্থক্য তৈরী করে দিয়েছে করোনা। করোনাকালের আগে শাওয়ালের চাঁদ দেখা হলেই পরদিন ভোরে উঠেই শুরু হয়ে যেতো ঈদের উৎসব । সকাল সকাল গোসল সেরে নতুন কাপড় পরে বাড়ীর সকলের সাথে দলবেধে ঈদগাহে যাওয়া; দু’রাকাত নামাজ পড়া এবং খুৎবা শোনা; গরিব মিসকিনদের দান খয়রাত করা, আত্নীয় স্বজনের বাড়ীতে বেড়ানো, নিজের বাড়ীতে সকলকে আপ্যায়ন, দলবেধে ঘোরা, আড্ডা দেয়ার মধ্য দিয়েই কেটে যেতো ঈদের দিন।

করোনাকালের আগের ঈদের সবচেয়ে বড় দিক ছিল অকৃত্রিম আন্তরিকতা।সেই ঈদে নিভাজ নিপাট আনন্দ নিয়ে প্রাণ খুলে একে অন্যের সঙ্গে মিশেছে মানুষ। কিন্তু করোনা এসে সব শেষ করে দিয়েছে। আমাদের সকল সামাজিক, পারিবারিক বাঁধন একবোরে শিথিল, ঢিলে করে দিয়েছে। আমরা আজ সবছাড়া, বিচ্ছিন্ন, তাই এবারের ঈদ আমাদের জন্য বড্ড বিষাদের, বড্ড কষ্টের। গত ঈদেও বাড়ীর ছোটরা ছিলো সবচে বেশি উচ্ছ্বল। নতুন জামাকাপড়, সালামি, ঘোরার আনন্দে সারা বাড়ী চনমনিয়ে রাখতো। এই আনন্দ শুধু ছোটরাই করতো- তা না আমরাও আমাদের ছোটবেলায় এটা করতাম। তবে আমাদের সময়ে আজকের মতো এতো রেডিমেড গার্মেন্টস ছিল না। অধিকাংশ সময়ে বাজার থেকে কাপড় কেনা হতো তারপর দর্জির দোকানে মাপজোখ দিয়ে কী দারুণ অপেক্ষা!

আর মনে মনে প্রার্থনা-আমার কাপড় যেন সবচেয়ে সুন্দর হয়। মনে মনে শঙ্কা-যদি যথাসময়ে সেলাই শেষ না হয়। মাঝে মাঝে কাপড়ের দোকানে তাগাদা দেবার জন্য মাকে জ্বালাতাম। এই মহামারির আগে প্রত্যেক ঈদ শুরু হতো সেই ভোর বেলায়। ভোরে উঠেই হইহুল্লুড়। গোসল সেরে সাজবার পালা। নতুন কাপড়, মাথায় টুপি, চোখে সুরমা আর গায়ে সুগন্ধী আতর। তারপর দল বেঁধে ঈদগায় যাত্রা। নামাজ শেষে কবর জিয়ারত, পাড়া মহল্লার সবার সাথে কোলাকুলি করে বাসায় ফিরে আসা। ফিরে এসে বড়দের পায়ে ধরে সালাম, ছোটদের সালাম নেয়া আর সালামি দেওয়ার রেওয়াজ বরাবরের মতো। সব ঘরেই রকমারি খাবার তৈরি। চারদিকে খাবারের মিষ্টি সুবাস, হাসিখুশি আর আনন্দ। আমাদের নামাজ পড়ে আসার আগেই পরিবারের নারী সদস্যরা গোছল করে নতুন কাপড় পরে বসে থাকতো। আমরা ফিরে আসার পরে সবাই একসাথে খেতে বসতাম। মিষ্টি, দই, লাচ্ছা সেমাই, খিচুড়ী, মুরগী, গরুর গোস্ত আর পোলাও-ছিলো ঈদের খাবার। করোনাকালের আগে দেখতাম মা, আমার স্ত্রী, বোনেরা বাসার আসে পাশের ঘরে খাবার পৌঁছিয়ে দিতো।

এবারের ঈদে এসবের কিছুই হবেনা। প্রতিবার সবচে উপভোগ করতাম ঢাকা থেকে বাড়ী যাওয়া। ঈদের সময় রাস্তায়, ট্রেনে ও বাসে দেখা যেতো প্রচন্ড ভিড়। সবাই নাড়ীর টানে বাড়ী যেতে চাই। কেউ বাড়ীতে, কেউ শ্বশুরবাড়ি কেউ কেউ আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে। ফেরিঘাটের অসহনীয় জাম শেষে নদীটা পার হলেই সব কষ্ট শেষ। এবারে একদম বন্দী জীবন। যারা বের হচ্ছেন সেই রাস্তায় বের হওয়া মানুষগুলো ভয়ে, শংকায় আতংকিত। সবাইকে একটা অদৃশ্য ভয় তাড়া করে ফিরছে। আমরাও একটা বিচ্ছিন্ন জীবন যাপন করছি। ঈদের কোন কিছুই আমাদের স্পর্শ করছেনা। ছোটবোনটা তার বাচ্চাদের নিয়ে তার শহরে একা, বাচ্চাদের বাবা তার কর্মস্থলে, মা বাড়ীতে একদম ছোটবোনটাকে নিয়ে মন খারাপ করে আছে আর আমরা চারজন ঢাকাতে। এবারে ছোটভায়ের নতুন বউকে নিয়ে প্রথম ঈদ করার কথা ছিলো আমাদের। করোনা সেটা করতে দিলোনা।

এবারের ঈদ আমাদের যাপিত জীবনে স্মরনীয় হয়ে থাকবে। এই প্রথম সকালে হুল্লোড় করে ঘুম থেকে উঠা হবেনা, দলবেধে ঈদগাহে যাওয়া হবেনা, জামাতে নামাজ পড়া হবেনা, নামাজ শেষে কোলাকুলি হবেনা, বাড়ীতে বাড়ীতে দাওয়াত খাওয়া হবেনা, হবেনা আনন্দের সাথে সেই বাড়ী যাওয়া। তবে নিশ্চয় মাস্কপরা, গ্লোভস পরা ঈদই আমাদের জীবনের শেষ ঈদ নয়।

একদিন আমরা এই পরাক্রমশালী করোনাকে পরাজিত করবো। ঈদের উৎসবী আমেজটাকে ফিরিয়ে নিয়ে আসবো এবং গলা ছেড়ে, মুক্তির আনন্দে গেয়ে উঠবো….. ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশীর ঈদ তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে, শোন আসমানি তাগিদ……………..

লেখক: উন্নয়নকর্মী ও প্রশিক্ষক