করোনাকালে নতুন রোগে গবাদিপশুর মহামারী

প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের তাণ্ডবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে গোটা বিশ্ব। এই ভাইরাসের থাবায় অসহায় হয়ে পড়েছে বিশ্বের অন্তত ২১৩টি দেশ ও অঞ্চল। এর মধ্যে বাংলাদেশও রয়েছে।

এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে ১ লাখ ১ হাজার ১৯২ জন। এর মধ্যে মৃত্যু হয়েছে ১ হাজার ৩৪৩ জনের।

করোনার এই সংক্রমণের মধ্যেই রংপুর বিভাগের বিভিন্ন এলাকায় দেখা দিয়েছে গবাদিপশুর ‘লাম্পিভাইরাস’ নামের নতুন এক ধরনের চর্মরোগ। গত দুই সপ্তাহে এই রোগে আক্রান্ত হয়ে বিভাগের আট জেলায় তিন শতাধিক গরুর মৃত্যু হয়েছে। ৫০ হাজার ছাড়িয়েছে আক্রান্তের সংখ্যা। বিভাগীয় প্রাণিসম্পদ অধিদফতর জানিয়েছে প্রত্যেক এলাকায় এখন গরুর এই দূরারোগ্য ব্যাধি দেখা দিয়েছে।
‘লাম্পি স্কিন ডিজিস’ নামের এই রোগ মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়েছে। এর কোনও প্রতিষেধক না থাকায় পালিত গরু নিয়ে দুশ্চিন্তায় দিন কাটাচ্ছেন এই অঞ্চলের মানুষ।

অনেকে না বুঝেই গ্রাম্য পশু চিকিৎসককে মোটা অংকের টাকা দিয়ে হচ্ছেন ক্ষতিগ্রস্ত। গরুপ্রতি দুই থেকে তিন হাজার টাকা খরচ করতে হচ্ছে কৃষকদের। এতে গরু মারা না গেলেও সুস্থ্য হতে বেশ সময় লাগছে। তবে প্রাণিসম্পদ অধিদফতর বলছে, একমাত্র সচেতনতাই পারে এই রোগের প্রতিকার করতে। সংক্রামক ব্যাধি লাম্পি রোধে গোয়াল ঘরের মশা-মাছি নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি সচেতন থাকতে হবে।

করোনাভাইরাসের কারণে কর্মহীন হয়ে পড়ায় কৃষকসহ সাধারণ মানুষের ঘরে ঘরে চরম আর্থিক সংকট দেখা দিয়েছে। তার ওপর কোরবানি ঈদের আগে আকস্মিকভাবে গবাদিপশু লাম্পিভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে পড়ায় এ অঞ্চলের গরু খামারিসহ কৃষকদের মাঝে চরম আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে।

রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার কোলকোন্দ, সদর উপজেলার মমিনপুর, তারাগঞ্জ উপজেলার ইকরচালিসহ বিভিন্ন এলাকার খামারি ও কৃষকরা জানান, প্রথমে গরুর শরীরে তীব্র মাত্রার জ্বর আসে। এরপর আস্তে আস্তে সারা শরীরে চামড়ায় গোটা গোটা হয়ে যায়। গলাসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে পানি জমে যাওয়ায় গরু ঘাস, খড় বা ভূষি কিছুই খেতে পারে না। এ ব্যাপারে উপজেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয়ে গিয়ে কোন প্রতিকার পাচ্ছে না তারা। ফলে পল্লী চিকিৎসকদের দ্বারস্থ হয়ে বিভিন্ন ধরনের ওষুধ ও ইনজেকশন দিলেও তেমন কোনও কাজে আসছে না।

তারাগঞ্জের ইকরচালি গ্রামের আব্দুল হক জানান, তার তিনটি গরু অজ্ঞাত রোগে আক্রান্ত হয়েছে। আসন্ন কোরবানি ঈদকে সামনে রেখে যত্ন করে গরু বড় করেছেন একটু বেশি দাম পাবার আশায়। কিন্তু গরুর সারা শরীরে গোটা গোটা দানার মত (ফোসকা জাতীয়) হওয়ায় কোরবানির হাটে দাম পাওয়া যাবে না বলে আশঙ্কা করেন তিনি। একই ধরনের কথা জানালেন তারাগঞ্জের সয়ার এলাকার সামছুল হক, রমজান আলীসহ অনেকে।

তারা জানান, বিশেষ করে বাচ্চা গরুগুলো (বাছুর) আক্রান্ত হলে দুই থেকে তিনদিনের মধ্যেই মারা যাচ্ছে। তাদের এলাকায় গত ১০ দিনে অন্তত ১০টি গরু ও বাছুর মারা গেছে বলে জানান তারা।

রংপুর সদর উপজেলার মমিনপুর এলাকায় শত শত গরু গোয়াল ঘরে অজ্ঞাত এই রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সাথে লড়ছে। কৃষক সখিনা বেগম জানান, তার চারটি বলদ গরু কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে খেয়ে না খেয়ে অনেক কষ্টে বড় করেছেন। এর মধ্যে দুটি গরু অজ্ঞাত রোগে আক্রান্ত হয়ে এখন কিছুই খেতে চায় না, ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়ছে। গ্রামের ডাক্তার দিয়ে চিকিৎসা করাচ্ছেন জানিয়ে সখিনা বলেন, শেষ পর্যন্ত বেঁচে থাকলেও গরুর শরীরে ফোসকার মত গুটি হওয়ায় চাহিদার অর্ধেক দামও পাওয়া যাবে না। ওই এলাকার একাধিক কৃষক একই ধরনের কথা জানান।

গঙ্গাচড়া উপজেলার কোলকোন্দ এলাকায় প্রায় প্রত্যেক বাড়িতেই গবাদিপশুর ওই রোগ দেখা দিয়েছে। হাউমাউ করে কেঁদে প্রান্তিক কৃষক নিজামউদ্দিন বলেন, ‘করোনায় কোনোটে (কোথাও) কাম মেলেনো। সারাদিনে একবেলা খ্যায়া কোনমতে বাঁচি আছি। আশা আছিল ঈদোত গরু দুইটা বেচাইলে আর এমন কষ্ট থাইকপার নয়। তারোতো ব্যারাম (রোগ) হইচে, কোনদিন বা মরি যায়। এ্যালা নিজে বাঁচমো না গরুক বাঁচামো!’

কোলকোন্দ ইউনিয়নের এআই টেকনিশিয়ান কাফিনুর রহমান গণমাধ্যমকে জানান, লাম্পি গরুর একটি ভাইরাসজনিত রোগ। এটি একটি এলাকার গরুতে আক্রান্ত হলে পরবর্তীতে অন্যান্য অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। এ রোগের টীকা এখনো আবিষ্কার না হলেও সময়মতো চিকিৎসা করালে গরু সম্পূর্ণ ভালো হয়ে যায়। তিনি নিজেও কয়েকটি গরুর চিকিৎসা করে ভালো করেছেন বলে জানান।

রংপুর উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. এএসএম সাদেকুর রহমান বলেন, অফিসে প্রতিদিনই চিকিৎসার জন্য অজ্ঞাত রোগে আক্রান্ত গরু নিয়ে আসছেন খামার মালিক ও কৃষকরা। আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করছি। তবে মশা-মাছির আক্রমণ থেকে রক্ষা ও পরিচর্যা করলে কিছুটা হলেও রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব বলে জানান তিনি।

গঙ্গাচড়া উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা নুরুল আজিজ বলেন, লাম্পি নামে যে রোগটি গরুতে আক্রান্ত হচ্ছে এতে করে আমাদের এলাকায় গরু মারা যাওয়ার তথ্য নেই। সময়মতো চিকিৎসা করলে এ রোগ সম্পূর্ণ ভালো হয়ে যাচ্ছে। এ রোগ থেকে গরুকে রক্ষার জন্য বিভিন্ন এলাকায় উঠান বৈঠকসহ কৃষকদের মাঝে সচেতনতামূলক লিফলেট বিতরণ করা হচ্ছে। এছাড়া আক্রান্ত গরুকে উপজেলা প্রাণিসম্পদ হাসপাতালে নিলে অল্প খরচে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।

রংপুর বিভাগীয় প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের উপপরিচালক ডা. হাবিবুল হক গণমাধ্যমকে জানান, এ রোগের প্রকৃত কোনও ওষুধ নেই। এ রোগটি ইতিপূর্বে ঝিনাইদহে দেখা দিয়েছিল, এখন রংপুর বিভাগের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। এ পর্যন্ত প্রায় এক লাখ গরুকে প্রতিষেধক ইনজেকশন দেওয়া হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন কৃষকদের সচেতনতা বাড়াতে হবে। আক্রান্ত হবার সঙ্গে সঙ্গে গরুকে নিকটস্থ প্রাণিসম্পদ হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা দিলে রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব। সূত্র-যুগান্তর