কলম উদ্যান এবং কলম

জগৎ জীবনে একথা বুঝি নিরপেক্ষভাবে সত্য যে মানুষের আলাদা ভাবে পরিচিতির পেছনে তার নতুন কোনো সৃষ্টিকর্ম অধিক দাবিদার। সেই নব সৃষ্টিধর্মী সুস্থ-সুদ্ধ মানুষটি তখন মানুষের কাছে হয় অধিক আলোচিত। আমরা জানি পৃথিবী জুড়ে সৌন্দর্য ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকলেও তার আত্মপ্রকাশ ঘটে একজন মানুষেরই স্বপ্নরুপ হয়ে। সে ক্ষেত্রে যে কোনো নবসৃষ্টিই একজন মানুষের আকাঙ্গার অপেক্ষা রাখে। শুনেছি বিশ্বসৃষ্টিকর্তা নাকি প্রাণিকূল সৃষ্টির পূর্বেই সৃষ্টি করে ছিলেন উদ্ভিদ জগৎ। যে উদ্ভিদ জগৎ সৃষ্টির কেন্দ্রে থেকে এ অবধী লালন করে চলেছে সমগ্র প্রাণীকুলকে। সেই উদ্ভিদ নিয়ে উদ্যান সুষ্টির নৈপুন্যের নেপথ্যে কলমের যে স্বপ্ন ছিল তারই বাস্তব রুপ “কলম উদ্যান”। কলম তার নিজের নামের সাথে সঙ্গতি রেখে তিন অক্ষরের ‘কলম’ নামটি উদ্যানের নামের সাথে যুক্ত করে ছিলেন তাতে ব্যক্তি কলমকেই চিনে নিতে সহজ হয়েছিল এলাকাবাসির। আর তিনি হয়েছিলেন আলোচিত ব্যক্তিত্ব। কলমের প্রকৃত নাম মোঃ গোলাম নবী ওরফে কলম। তবে তিনি এলাকার মানুষের কাছে কলম নামেই অধিক পরিচিত। কলমের সেই স্বপ্নরুপ কলম উদ্যান আজ দাঁড়িয়ে আছে সুধুই স্বপ্ন হয়ে। মাত্র এক বছর পূর্বেও যার নিপুন হাতের র্স্পশে র্স্পশে সজিব হয়ে উঠতো উদ্যানের শিরা উপশিরা। যার নিবিড় মনোবল ও আত্মত্যাগে গড়ে উঠেছিল সুন্দরের সার্থকতা। সেই সার্থক সুন্দরের স্বপ্নদ্রষ্টা আজ আর আমাদের মাঝে নেই। হঠাৎ দমকা বাতাসে নিভে যাওয়া প্রদীপের মতই তিনি বিশ্বের সব আলো নিভিয়ে নিভে গেছেন। ফুলপাতা, আমজাম, নারকেল নেবুর গদ্ধমাখা বাতাসের শেষ শ্বাসটুকু বুকে নিয়ে তিনি চলে গেছেন না ফেরার দেশে। সেই সাথে শূন্যতার এক ষোলোকলায় পূর্ণ করে গেছেন তার পরিবার পরিজন, গুনগ্রাহী, সুভাকাঙখীদের সমস্ত হৃদয়। ১৯ অক্টোবর ২০২০ বিশ্বের বুকে স্থির হয় এক নতুন ইতিহাস।

বারাদী বাজার থেকে উত্তর দিকে মাত্র দু’কিলোমিটার পথ পেরুলেই দিগোলকান্দি গ্রাম। প্রগতির আর্শিবাদে আঁকাবাঁকা পথটি এখন পিচঢালা পাকাপোক্ত। গ্রামটির শেষ প্রান্তে পথের মাঝে মধ্য বয়সী পাকুড় গাছটিতে আটকানো এ্যারোমার্ক আপনাকে ঠিক ঠিক জানিয়ে দেবে উদ্যানটির অবস্থান আর আপনিও পৌছে যাবেন উদ্যানটির প্রবেশ পথের কাছে। প্রথমেই নজরে পড়েবে উত্তর দিকের সীমানা ঘেসে স্বর্গবে দাঁড়িয়ে থাকা গুঁড়ি মোটা গাছ গুলির প্রতি। নজরে পড়বে উদ্যানের বেষ্টনি বেড়ার পাশ দিয়ে সারিবদ্ধতায় দাড়িয়ে থাকা বনজ ও বিবিধ বৃক্ষসমহ। উদ্যানের রাস্তার দু’পাশ দিয়ে দু’টি সারিতে সাজানো হয়েছে নারিকেল সুপারি এবং নানা প্রজাতীর দৃষ্টিনন্দন বৃক্ষ দিয়ে। তৃতীয়মাত্রায় যোগ যুক্ত হয়েছে ফুল পাতা লতা গুল্মদীসহ নানা ধরণের পাতাবাহারে সৌন্দর্য, যার আলাদা আলাদা চমক এবং আলাদা তার ব্যঞ্জনা। মনোরম এ পরিবেশ প্রকৃতি প্রেমীদের একটু বেশিই আকৃষ্ট করে। প্রাচীন গরিমায় দাড়িয়ে থাকা বিশাল বিশাল বৃক্ষের নিরাবতা অন্তরে এনে দেয় এক অনাবিল শান্তি, স্নিগ্ধতা এবং মুক্তির স্বাদ। ঠিক তখনই আধুনিক সৌভ্যতার বেড়ার ফাঁক দিয়ে মনের কোনে ভেসে আসে দূরকালের কোনো সবুজ সমারোহের ছবি।

উদ্যানের একদম দক্ষিণ-পশ্চিম কোণের কাছে বট-পাকুড়ের যুগলবন্দি হয়ে দু’টি বৃক্ষ দাড়িয়ে আছে ডাল পালা ছড়িয়ে। তরুণ বয়সি এ বৃক্ষ দু’টির যেন আলাদা আকুতি। রোদেলা দুপুরে বাড়তি ছায়াদান তাদের বাড়তি অহংকার। সেই অহংকারী বৃক্ষযুগল তলেই ছোট্ট একটি ঘরের ছোট্ট বারান্দাটিতে বসে অবসর সময় কাটাতেন একজন নিরহংকারী মানুষ। নিরব নিভৃত ছায়াপুনজিত স্থানটিতে এসে দাড়ালে মনে হয় পৃথিবীর সকল সৌখিনতা সব আছে সব খানে কিন্ত এই স্থানটি যেন এক আভিজাতিক বিশুদ্ধায় পরিপূর্ন এবং একেবারেই আলাদা। বর্তমান সভ্য মানবের নব্য জগৎ থেকে অনেকটাই ভিন্ন। এখানে বসেই যিনি তার চিত্তকে প্রকৃতির সাথে যোগযুক্ত রেখে অন্তরের ফল্গুধারাটিকে প্রবাহিত রাখতে প্রয়াসী ছিলেন। যিনি এক শুভ আকাঙ্খায় ধরে রাখতে চেয়েছিলেন সুচিশুভ্র একটি পরিবেশ, যিনি সৌন্দর্যবোধের ছোঁয়া দিয়ে ফুটিয়ে তুলতে চায়তেন ঐর্শ্বযময় শ্রীশালীনতায় পূর্ন ভিন্ন একটি সভ্যতা। তিনিই সত্তোর্রোধ বয়সের বিশুদ্ধ বৃক্ষপ্রেমিক আত্ম উৎর্কষের অগ্রজ সাধক ব্যাক্তি কলম। তিনি ছিলেন এই উদ্যানের প্রতিষ্ঠাতা। তার শুষমাময় পরিপূর্ণ অমলিন চিত্তের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে অনেকেই তার সাথে সাক্ষাৎ করে তৃপ্তি বোধ করতেন। অনেকের মুখে শোনা যায় ব্যাক্তি কলামের কাছে সুধু জগৎ সুন্দরের জ্ঞানই পাওয়া যেত না তার পরিপূন্য স্বাদও পাওয়া যেত।

কলম তার শুভাকাঙ্খী স্বজনদের নিয়ে নানামুখী আলোচনা করে সময় কাটাতে পছন্দ করতেন। কথা প্রসঙ্গে তিনি প্রায়ই জীবনকে বৃক্ষের সাথে তুলনা করতেন। তিনি বলতেন জীবনের সুন্দরতম প্রাপ্তিই হচ্ছে একে অপরকে সাহায্য করা আন্তরিক ভাবে সেবাদান করা। বৃক্ষ এ গুরুভার বহন করে শান্ত এবং সহিষ্ণুভাবে। বৃক্ষ শুধু আমাদের ফুল ফলই দেইনা প্রশান্তির ইঙ্গিতও বহন করে। ফুল আমাদের সুন্দর হতে শেখায়, মনে আনন্দের যোগান দেই। বৃক্ষের এ র্সাথকতা আমাদের অন্তর দৃষ্টি দিয়ে দেখতে হয়, তার ভাষা আমাদের শুনতে হয় অনুভুতির কান দিয়ে।

তিনি বিশ্বাস করতেন যার অন্তরে সৌন্দর্যবোধ বাসা বাধে সে মানুষ কখনো নির্মম ও নিষ্ঠুর হতে পারে না। যারা ফুলেরর শক্তির মূল্য না দিয়ে বন্দুক-বারুদের শক্তিকে বড় মনে করে এবং তাকে সৌভ্যতা মনে করে তারা সুস্থ্য নয়। তাদের সুস্থ্যতার লক্ষে তিনি তাদের বৃক্ষে প্রতিই দৃষ্টি দিতে বলতেন। তিনি বলতেন সৌন্দর্যবোধের চেতনায়ই মানুষকে পরিবর্তন করতে পারে, যা জীবনের কাঠিন্যকে সহজতর করে, জীবনকে করে উন্নততর। তার এই অখন্ড সত্যকে সামনে রেখে আজ ১৯ অক্টোবর তার প্রয়ান দিবসে তার অগণিত ভক্তের ভক্তিপূর্ণ শ্রদ্ধার সাথে আমরাও জানাই তার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা। আল্লাহ তাকে বেহেস্ত নসিব করুক।

আজ পৃথিবী জুড়ে বৃক্ষ নিধনের প্রভাব আমরা বেশ বুঝতে পারি আমাদের চারিপাশে প্রকৃতি পরিবেশের দিকে তাকিয়ে। মানুষের দেওয়া সহস্র অযুত ক্ষত চিহ্ন বুকে নিয়ে চলে অশান্ত পৃথিবী। এমনই দুঃসময়ে প্রকৃতি প্রেমিক কলমের হাত ধরে গড়ে ওঠে উদ্যান প্রাণ পায় প্রকৃতি, পরিবেশের রং বদল হয়, যে পাখি উড়ে চলে অলক্ষিত পথে পায় না খুঁজে একটিও র্নিভাবনার নিম বাবলা, সিসু শিমুল গাছ, সে পাখি আসে গান গায়, বাসা বাধে কলম উদ্যান’ই হয় তার একমাত্র ঠিকানা। আর এই ঠিকানায় অভ্যস্ত পথে যারা এখনো পা বাড়িয়ে চলেছেন সেই প্রিয় ভক্তরা, যাদের প্রতি বর্ধিত বিবেচনায় গভীর আনন্দ নিয়ে কলম উম্মুক্ত করে দিতো উদ্যান, যার নির্মল আচরনে মুগ্ধ হতো সবায় সে কলম’কে তারা পায় না, একমূর্হত সাক্ষাতের বাসনা পূর্ণ হয় না। এক অকাল বিচ্ছেদের বানী আকান্ত করে তাদের অন্তরকে।

কলমের সহধর্মিনী হাসিনা বেগম বসে থাকে পুকুর পাড়ে একটি মাচার উপর। তার অবসাদমাখা মুদ্রিত চোখে ভেসে আসে দিকহীন দিশাহীন আগামী। বেলা শেষ হয়ে আসে হাসিনা বেগম পুকুরের পানির দিকে তাকায়। পানিতে অসংখ্য ঝিলিমিলি ঢেওয়ের মাঝে নিজেকে সে দেখতে পায় অতি ক্ষুদ্র করে সহস্র বিভাজনে । আজ সময়ের ঢেওগুলি তার কাছে পৃথিবীর চেয়েও বড় মনে হয়। পতিক্ষার নিশ্চল বেদনাহত হাসিনা বেগম প্রতিদিনের মত ঘরে ফিরে আসে। সামাজিক ভাবে যোগ্যতম তিনটি পুত্র সন্তান রেখে গেছেন কলম। বাবার স্মৃতি বিজড়িত স্বপ্ন সাধের উদ্যানটির কথা তারা অন্তরে কিভাবে লালন করেন আমরা ঠিক জানি না। বোবা অতিতের সব প্রশ্ন গেছে থেমে। কালের নিলামে নিজেদেরকে সঁপে দিয়ে বৃক্ষতরু সিমাহীন সকরুনতায় সহস্র র্নিলিপ্ত চোখে চেয়ে আছে অসীম আকাশের দিকে। আমরা সুপারিশ করি সময়ের কাছে, জগৎ জীবনের সব বাধা পেরিয়ে উদ্যানটি প্রতিনিয়ত আরো নব বৈচিত্রে বিশ্ব-প্রকৃতির অঙ্গনে বিশ্বদ্ধ স্বরুপে পূর্নতা লাভ করুক। আর বিশ্ব সত্বার শেকড়ে প্রাণে অন্তহীন প্রবাহিত থাকুক কলমের সমগ্র জীবনায়োজন ।