কুষ্টিয়ায় বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙার কথা স্বীকার করেছে দুই মাদ্রাসাছাত্র

কুষ্টিয়ায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্মাণাধীন ভাস্কর্য ভাঙচুরের ঘটনায় সিসিটিভি’র ফুটেজ দেখে দুই মাদ্রাসা ছাত্র এবং মাদ্রাসা থেকে পালাতে সহযোগিতা করায় মাদ্রাসার দুইজন শিক্ষককে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।

রবিবার (৬ ডিসেম্ব) বিকেল সাড়ে ৩টায় সাংবাদিক সম্মেলনে পুলিশের খুলনা রেঞ্জের ডিআইজি ড. খন্দকার মুহিদ উদ্দিন এখবর জানান।

ভাস্কর্য ভাঙার কাজে জড়িত ছাত্ররা হলো শহরতলী জুগিয়া পশ্চিম পাড়া মাদ্রাসা ইবনে মাস্উদ (রাঃ) কওমী মাদ্রাসার হেফজ বিভাগের শিক্ষার্থী আবু বক্কর ওরফে মিঠন (১৯) ও সবুজ ইসলাম ওরফে নাহিদ(২০)। মিঠনের বাড়ি মিরপুর উপজেলার শিংপুর গ্রামে এবং নাহিদের বাড়ি দৌলতপুর উপজেলার ফিলিপনগর হোগলবাড়িয়া গ্রামে। গ্রেফতারকৃত মাদ্রাসা শিক্ষক আল আমিন (২৭)। বাড়ি মিরপুর উপজেলার ধুবইল গ্রামে অপর শিক্ষক ইউসুফ আলী (২৬) বাড়ি পাবনা জেলার আমিনপুর উপজেলার দিয়াড় বামন্দী গ্রামে।

খুলনা রেঞ্জের ডিআইজি সাংবাদিকদের জানান-ঘটনার ২৩ ঘন্টা পর হলেও মাত্র ১২/১৩ ঘন্টায় জেলা পুলিশের কর্মকর্তা এবং সদস্যদের আন্তরিক প্রচেষ্টায় সিসি ফুটেজ দেখে গ্রেফতারকৃত ছাত্রদের সনাক্ত করা হয়।

তিনি জানান, জেলা পুলিশ ঘটনার ভিডিও ফুটেজ দেখে জুগিয়া পশ্চিম পাড়ায় অবিস্থত মাদ্রাসা ইবনে মাসউদ এর জামাত বিভাগের ছাত্র আব্দুল্লাহ এবং আব্দুর রহমানকে আটক করে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ ও ফুটেজ দেখালে তারা তথ্য দেয় যে, এরা এই মাদ্রাসার হেফজ বিভাগের শিক্ষার্থী। পরে ওই শিক্ষার্থীদের বাড়িতে হানা দিয়ে শনিবার রাতেই তাদের গ্রেফতার করা হয়।

গ্রেফতারের পর ঘটনার সাথে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে তারা জানায়, মাওলানা মুহাম্মদ মামুনুল হক ও মাওলানা ফয়জুল করিমের বয়ানে উদ্বুদ্ধ হয়ে তারা এই ঘটনা ঘটিয়েছে।
গ্রেফতারকৃত ছাত্ররা পুলিশকে জানান, ৫ডিসেম্বর রাতে মাদ্রাসার সকল শিক্ষার্থী ঘুমিয়ে পড়লে তারা দুজন গোপনে মাদ্রাসা থেকে বের হয়ে পায়ে হেটে শাহিন কাউন্সিলারের বাড়ির পাশ দিয়ে কানাবিলের মোড় পাড় হয়। এর পর মজমপুর দিয়ে রেল লাইন দিয়ে ফজলুল উলুম মাদ্রাসার পাশ দিয়ে ৫রাস্তা মোড়ে ভাস্কর্যের কাছে আসে।

রাত ২টা ৫ মিনিট থেকে ২টা ১৩ মিনিট পর্যন্ত মাত্র ৮ মিনিটে বাঁশের চড়াতে ওই ভাস্কর্যে উঠে তাদের সাথে থাকা হাতুড়ি দিয়ে নির্মানাধীন ভাস্কর্যে স্বজোড়ে আঘাত করে। এতে হাত ও মুখের বিভিন্ন অংশ ভেঙ্গে ফেলে এবং বিকৃত করে। তারা আবার পায়ে হেটে মাদ্রাসায় গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।

সকালে ঘটনাটি মাদ্রাসার ২ শিক্ষক জানতে পেরে তাদের দ্রুত মাদ্রাসা থেকে পালিয়ে যেতে বলে। ছাত্রদের স্বীকারোক্তি মোতাবেক মাদ্রাসার শিক্ষকদের গ্রেফতার করে।

সাংবাদিক সম্মেলনে গ্রেফতারকৃত ২ ছাত্র ২ শিক্ষককে সাংবাদিকদের সম্মুখে হাজির করা হয়। সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে ডিআইজি বলেন, পুলিশ দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়ে ঘটনার সাথে জড়িতরে গ্রেফতার করেছে।

গ্রেফতারকৃতদের বিরুদ্ধে কুষ্টিয়া মডেল থানায় বিশেষ ক্ষমতা আইনের ১৫(৩) তৎসহ ৪২৭/৩৪ পেনাল কোড রুজ্জু করা হয়েছে। তাদের পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদে এঘটনার সাথে আরো কোন ব্যক্তি বিশেষ ও সংগঠন জড়িত থাকলে তাদের সনাক্ত করা হবে।

ডিআইজি আরো জানান, এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে কেউ ঘোলাটে পরিবেশ করতে চাইলে তা কঠোর হস্তে দমন করা হবে। আর এ ঘটনার পর আইন শৃংখলা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তিনি জানান-ইতোমধ্যে জেলার সর্বত্র যেখানে মুর‌্যাল ও ভাস্কর্য রয়েছে সেখানে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন রাখা হয়েছে।

এসময় অতিরিক্ত ডিআইজিসহ কুষ্টিয়ার পুলিশ সুপার এস এম তানভীর আরাফাতসহ সংশ্লিষ্টরা উপস্থিত ছিলেন।

পুলিশের সামনে ফাঁকা গুলি:
এদিকে শনিবার সন্ধ্যা ৭টার দিকে কুষ্টিয়া শহরের ব্যস্ততম এলাকা পাঁচ রাস্তা মোড়ে ভাস্কর্যের কাছে এক যুবক একটি মইক্রোবা যোগে এসে পুলিশের উপস্থিতিতে পিস্তল উচিয়ে দুই রাউন্ড ফাঁকা গুলি ছুড়ে। পরে দ্রুত মাইক্রোবাস যোগে মজমপুরগেট হয়ে চৌড়হাসের দিকে চলে যায় মাইক্রোটি।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান সন্ধ্যা ৭টার দিকে একটি নুহা প্রাইভেট গাড়ি ভাস্কর্য এলাকায় পৌঁছায় সেখান থেকে একজন যুবক উচ্চস্বরে গালিগালাজ করতে থাকে। এক পর্যায়ে তার হাতে থাকা পিস্তল উচিয়ে ২রাউন্ড ফাঁকা গুলি ছুড়ে মাইক্রোযোগে ঘটনাস্থল ত্যাগ করে।

এসময় ঘটনাস্থলের পাশে পুলিশসহ বিপুল সংখ্যাক জনগণ দাঁড়িয়ে থাকলেও ভয়ে কেউ এগিয়ে আসেনি। যুবকটি ঘটনাস্থল পরিত্যাগের পরই পুলিশের টনক নড়ে। সাথে সাথে সর্বত্র খবরটি ছড়িয়ে দিলেও এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত ওই যুবকের সন্ধান পাওয়া যায়নি। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন জেলা পুলিশের কর্মকর্তারা।

বিএনপি অফিসে ভাঙচুর:
এদিকে বঙ্গবন্ধু ভাস্কর্য ভাঙচুরের ঘটনার পর শনিবার বিকেলে এবং রাত ৯টার দিকে কুষ্টিয়া শহরে জেলা বিএনপি কার্যালয়ে দফায় দফায় ভাঙচুর করেছে একদল দৃর্বত্ত।

রাতে জেলা বিএনপি’র সাধারণ সম্পাদক অধ্যক্ষ সোহরাব উদ্দিনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এসবি কাউন্টারে হামলা-ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। হামলার ছবি তুলতে গিয়ে দুই গণমাধ্যমকর্মী গুরুতর আহত হয়েছে। তাদেরকে কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।

শহরে নিরাপত্তা জোরদার:
ভাস্কর্য ভাঙচুরসহ কুষ্টিয়া শহরে বেশকিছু অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটে যাওয়ায় জেলা শহরে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করেছে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। জেলা বিএনপি কার্যালয়ে ভাঙচুরের ঘটনায় জেলা বিএনপির পক্ষ থেকে এ ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানানো হয়।

জেলা বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক জানান-কিছু দিন পর পর বিএনপি অফিস ভাঙচুর করে কিন্তু আইন শৃংখলা বাহিনীর কোনো পদেক্ষেপ নেয় না। তিনি এ ঘটনায় নিন্দা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আইন শৃংখলা বাহিনীর উচিত দোষীদের আইনের আওতায় এনে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।

তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি:
বঙ্গবন্ধুর নির্মাণাধীন ভার্স্কয ভাঙচুরের ঘটনায় তিন সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ ঘটনায় পৌর সচিব কামাল উদ্দিন বাদি হয়ে কুষ্টিয়া মডলে থানায় অজ্ঞাত কয়েকজনকে আসামি করে মামলা দায়ের করেন।

রোববার বেলা সাড়ে ১১ টায় কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসক মো. আসলাম হোসেনের সভাপতিত্বে জেলা প্রশাসকের সভা কক্ষে বঙ্গবন্ধু ভার্স্কয নিরাপত্তাজনতি বিষয় নিয়ে এক জরুরী বঠৈকে অতরিক্তি জেলা ম্যাজিস্ট্রট সিরাজুল ইসলামকে আহবায়ক, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ডিএসবি) মো. ফরহাদ হোসেন ও গণর্পূত অধিদফতরের নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুল ইসলামকে সদস্য করে তিন সদস্য বিশিষ্ঠ তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। আগামী তিন দিনের মধ্যে তদন্ত রিপোর্ট জমা দিতে হবে। সভায় উপস্থিত ছিলে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ।