
মানবিকতা একটি জাতির সভ্যতার মাপকাঠি। শুধু প্রযুক্তি, অবকাঠামো বা অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিই একটি দেশকে উন্নত করে না। বরং মানুষের মধ্যে যদি পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা,সহানুভূতি না থাকে, তাহলে সেই উন্নয়ন অনেকাংশেই অর্থহীন। একটি মানবিক সমাজ গড়ে তুলতে হলে আগে মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখতে শিখতে হবে। উন্নয়ন তখনই টেকসই হয়, যখন তার ভেতর মানবিকতা থাকে। তাই “মানবিক বাংলাদেশ” গঠন আজ সময়ের দাবি। মানবিকতা মানে শুধু দয়া-সহানুভূতি নয়; এটি হলো মানুষে মানুষে শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, সহনশীলতা ও সহযোগিতার মনোভাব। ধর্ম, বর্ণ, ভাষা বা রাজনৈতিক মতভেদ ভুলে সবাইকে মানুষ হিসেবে মূল্যায়ন করাই মানবিকতার প্রকৃত রূপ।
সব ধর্মেই মানবিকতার শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। ইসলাম বলে, “যে ব্যক্তি একজন মানুষকে বাঁচায়, সে যেন সমগ্র মানবজাতিকে বাঁচাল।” অন্যান্য ধর্মও মানুষে মানুষে ভালোবাসা ও শান্তির বার্তা দেয়। তাই মানবিক বাংলাদেশ মানে ধর্মীয় মূল্যবোধের বাস্তব প্রয়োগ। তবে শুধু গণতন্ত্র,অর্থনৈতিক উন্নয়নই যথেষ্ট নয়, আমাদের প্রয়োজন একটি মানবিক বাংলাদেশ যেখানে মানুষে মানুষে ভালবাসা, সহানুভূতি, সহমর্মিতা এবং মানবিক মূল্যবোধ থাকবে। বাংলাদেশকে একটি মানবিক রাষ্ট্র হিসেবে দেখতে চাই। যে দেশে মানুষ মানুষকে সন্মান করবে, মানুষের সকল অধিকার নিশ্চিত হবে। যে দেশে কোন যুবক বেকার থাকবেনা। সকলের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা হবে। মিথ্যা শঠতা থাকবে না; থাকবে না অন্যকে অসম্মানিত না করা। নারী সে শিক্ষার্থী হোক বা কর্মজীবী হোক সবক্ষেত্রে সেজেনো নিরাপদ অনুভব করে;সেই স্বপ্নের দেশ চাই। এর জন্য প্রয়োজন দেশের সকল জনগণের সচেতনতা,সহযোগিতা ও সমর্থন ।
আমরা চাই মানবিক বাংলাদেশ। মানবিক বাংলাদেশ হবে এমন এক দেশ, যেখানে প্রতিটি মানুষ অন্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হবে; গরীব-ধনী, নারী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধ সবাই সমান সম্মান সমহিমায় পাবে; শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সেবা সকলের জন্য নিশ্চিত হবে; পথশিশু, অসহায় ও প্রতিবন্ধীরা সুযোগ পাবে স্বাভাবিক জীবনের; সহানুভূতি, সহমর্মিতা ও সামাজিক দায়িবোধ থাকবে প্রতিটি নাগরিকের মাঝে;ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে সকলে মিলেমিশে বসবাস করবে।
একটি মানবিক বাংলাদেশ গড়তে হলে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় নৈতিক শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। শিক্ষাকে রাজনৈতিক দৃষ্টি থেকে দেখা যাবে না। আমাদের সমাজে যে নৈতিক অবক্ষয়, আত্মকেন্দ্রিকতা ও সহানুভূতির অভাব দেখা দিচ্ছে, তা রোধ করতে হলে সামাজিক মূল্যবোধকে আবার কেন্দ্রে ফিরিয়ে আনতে হবে। শিশুদের ছোটবেলা থেকেই সত্যবাদিতা, শ্রদ্ধা, সহানুভূতি, দায়িত্ববোধ, ও মানবিকতা শেখাতে হবে। বাবা-মা ও অভিভাবকদের নিজেদের আচরণেও মূল্যবোধের দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে। গণমাধ্যমকে মানবিকতা বৃদ্ধির জন্য ইতিবাচক ভূমিকা পালন করতে হবে। সর্বোপরি, আমাদের প্রত্যেককে নিজের দায়িত্বে মানবিক আচরণ করতে হবে।
শুধু উন্নয়ন নয়, আমরা চাই একটি মানবিক বাংলাদেশ যেখানে মানুষের মধ্যে থাকবে ভালোবাসা, সহানুভূতি ও সম্মানবোধ। এই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে হলে রাষ্ট্র, সমাজ এবং ব্যক্তিপর্যায়ে সকলকে এগিয়ে আসতে হবে। মনে রাখতে হবে, মানবিক বাংলাদেশ গড়তে হলে আমাদের প্রত্যেককে আগে মানুষ হতে হবে। আমাদের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে যে প্রতিশ্রুতি জনগণকে দেওয়া হয়েছিল, সেখানেই জনগণের স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষার প্রতিধ্বনি ছিল। পরিষ্কারভাবে বলা হয়েছিল বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশকে একটি সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্র ঘোষণা করছি। অল্প কথায় কী অপূর্ব সুন্দর এবং তাৎপর্যপূর্ণ এক ঘোষণা!
রাষ্ট্র যেসব সুবিধা তার নাগরিকদের দেওয়ার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ তা সকলের জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য হবে, এই হলো সাম্যের সহজ মানে। অর্থাৎ আপনার আর আমার সামাজিক অবস্থান-ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণি-পেশা আলাদা হতেই পারে, কিন্তু রাষ্ট্র আমাদের আলাদা চোখে দেখবে না, বরং রাষ্ট্রের সুবিধাদি পাওয়ার অধিকার আমাদের সমান থাকবে। সামাজিক ন্যায়বিচার মানে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক অধিকারসমূহের সমবণ্টন। আর মানবিক মর্যাদা মানে মানুষ হিসেবে আপনার-আমার সম্পূর্ণ মর্যাদা পাওয়ার অধিকার। মুক্তিযুদ্ধের পর জনগণ বারবার আন্দোলন-সংগ্রামের ভেতর দিয়ে তাদের অধিকার ফিরে পেতে চেয়েছে। নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থান আর চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান জনগণের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে দুটো মাইলফলক হয়ে থাকবে।
মুক্তিযুদ্ধ আমাদের বাতিঘর, যেকোনো সংকটে মুক্তিযুদ্ধই আমাদের পথ দেখাবে। সুতরাং, এই মুহূর্তের করণীয় হলো, স্বাধীনতার ঘোষণার কাছে ফিরে যাওয়া। মুক্তিযুদ্ধ-স্বাধীনতা-দেশ-রাষ্ট্র এসব কিছুর মালিকানা জনগণকে বুঝিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করে জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করাই এখনকার প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত। একটা কথা মনে রাখা দরকার, সাম্য না থাকলে সমাজের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়। দীর্ঘকালের অপশাসনে আমাদের সমাজের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে গেছে। সেজন্যই এত অস্থিরতা চারদিকে, এত বিকার, এত উগ্রতা।
জনগণের অধিকার আদায়ের ক্ষেত্রে গণঅভ্যুত্থান অবশ্যই শক্তিশালী একটি মাধ্যম। আমেরিকান তাত্ত্বিক ভাষাবিজ্ঞানী, শিক্ষাবিদ, দার্শনিক ও সমাজ সমালোচক আভ্রাম নোয়াম চমস্কির ভাষায়, ‘যখন একটি সরকার জনগণের মৌলিক অধিকার ও চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হয় তখন গণঅভ্যুত্থান অপরিহার্য হয়ে ওঠে।’ গণঅভ্যুত্থানের প্রক্রিয়া ও ফলাফল সব সময় একইরকম নাও হতে পারে। এর মধ্যদিয়ে জনগণ তার ইচ্ছাশক্তির বহিঃপ্রকাশ ঘটায় এবং ঐক্যবদ্ধভাবে একটি পরিবর্তন আনার সংগ্রামে মিলিত হয়। তবে একটি ইতিবাচক পরিবর্তনের জন্য জনগণের সমর্থনের পাশাপাশি সঠিক নেতৃত্ব অপরিহার্য। অন্যথায় তা প্রায়শই বিশৃঙ্খলা ও অস্থিতিশীলতায় পর্যবসিত হয়। জনসমর্থন হচ্ছে এর শক্তির দিক, দিশাহীনতা হচ্ছে দুর্বলতার দিক।
একটা বিষয় মনে রাখা দরকার তা হলো, প্রজন্ম ও প্রজন্মের দৃষ্টিভঙ্গি কোনো স্থির বিষয় নয়; যুগে-যুগে প্রজন্মের রুচি-রূপ এবং দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টায়। কিন্তু ইতিহাস তার জায়গায় ঠিকই থেকে যায়, থেকে যায় মুক্তির আকাঙ্ক্ষা। তাই ক্ষমতার পরিবর্তনই যথেষ্ট নয়, প্রয়োজন আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক ব্যবস্থার পরিবর্তন। যার মধ্যদিয়ে আমরা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় প্রকৃত অর্থে বৈষম্য নিরসন করে সাম্যের বাংলাদেশ গড়ে তুলতে সক্ষম হবো। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা মাথায় রেখে মানবিক রাষ্ট্র গঠনে নতুন দৃষ্টিভঙ্গিরাষ্ট্র পরিচালিত হবে। রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য শুধু নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা নয়; নিরাপত্তার বিষয়টি যখন মাটি-পানি-বায়ু ও প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীল, তখন একটি রাষ্ট্রের আদর্শ হতে হবে পরিবেশবান্ধব।
মানবিক দেশ গড়ার কাজ শুধু রাষ্ট্রের দায়িত্ব নয়; বরং ব্যক্তি পর্যায় থেকে শুরু করে আমাদের সবারই দায়িত্ব। সর্বত্র মানবিক মূল্যবোধ ছড়িয়ে দিতে পারলে কোথাও থাকবে না কোনো অশান্তি ও বিশৃঙ্খলা। আমরা গড়তে পারব শান্তি-সৌহার্দ-সম্প্রীতির মানবিক বাংলাদেশ। মানবিক বাংলাদেশ গড়ার ব্যাপারে যে চ্যালেঞ্জগুলো রয়েছে তাহলো সব ক্ষেত্র দুর্নীতিমুক্ত করা;স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার নীতি প্রতিষ্ঠা করা;আইনের শাসন যথাযথভাবে প্রতিষ্ঠা করা;দরিদ্র ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর অধিকারের প্রতি বিশেষ মনোযোগী হওয়া; জনগণের মৌলিক অধিকার ও মানবাধিকার নিশ্চিত করা;ভ্রাতৃত্ব, সহনশীলতা ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা করা;সংখ্যালগু বলতে কোনো কিছু থাকবে না; থাকবেনা পাহাড়ী বাঙ্গালী মতভেদ বা ভিন্ন দৃষ্টি ভঙ্গী।
এই নতুন সময়ে দাঁড়িয়ে প্রত্যাশা করি, নিশ্চিহ্ন হোক প্রতিহিংসা, দেশের মানুষ তাদের মানবিক মর্যাদা ফিরে পাক, সুশাসন,সাম্য ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হোক। ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্তের রাজনীতি বন্ধ হোক। দেশে একটা অবাধ এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু হোক। জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নিক। যারাই নির্বাচিত হবেন তারা যেন মনে রাখেন, ‘শাসনক্ষমতা’ নয়, তাদের দেওয়া হয়েছে ‘রাষ্ট্র পরিচালনা’র দায়িত্ব। আমরা আর শাসক ও শাসন দেখতে চাই না, দেখতে চাই যোগ্য পরিচালক ও জনবান্ধব সরকার। প্রকৃত গণতন্ত্র ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত না হলে রাষ্ট্রের নাগরিকদের মানবাধিকার পদে পদে ভূলুণ্ঠিত হয়। সাধারণ মানুষের অধিকার সুরক্ষার জন্য শক্তিশালী গণতন্ত্র অপরিহার্য। আর গণতন্ত্রের জন্য প্রয়োজন আইনের শাসন।
লেখক: সিনিয়র তথ্য অফিসার জনসংযোগ কর্মকর্তা ভূমি মন্ত্রণালয়