টিক্কা খানের কলমাছানি

মার্চ ১৯৭১। পরিস্থিতি বদলে গেল ১ তারিখেই। জাতীয় পরিষদ অধিবেশন স্থগিত করলেন জেনারেল ইয়াহিয়া খান। এদিন দুপুরে রেডিও পাকিস্তানের ঢাকা কেন্দ্র থেকে বাংলা এবং উর্দুতে প্রচার হল তার অধিবেশন স্থগিতের ঘোষণা। সঙ্গে সঙ্গে উঠল প্রতিবাদের ঝড়। ঢাকা পরিণত হল বিক্ষোভের নগরীতে। হোটেল পূর্বাণীতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বৈঠকে বসল আওয়ামী লীগের পার্লমেন্টারি পার্টি। সংবাদ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু অধিবেশন স্থগিতের প্রতিবাদ জানালেন এবং ২ মার্চ ঢাকায়, ৩ মার্চ সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে হরতাল এবং ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে জনসভার কর্মসূচি ঘোষণা করলেন। মেহেরপুরে ১ মার্চ সন্ধ্যায় বিবিসির খবরে ইয়াহিয়ার ঘোষণার পর্যালোচনা এবং বঙ্গবন্ধুর কর্মসূচির খবর জানা গেল। স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা বসলেন বৈঠকে। সত্তরের নির্বাচনে নির্বাচিত এমএনএ (এমপি) মোঃ ছহিউদ্দিনের হাতে তখন মেহেরপুরের নেতৃত্ব। তাঁর বাড়িতেই হলো বৈঠক। এতে যোগ দিলেন মেহেরপুর মহকুমা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতারাও। রাতেই তাঁরা বিক্ষোভ মিছিল করেন ইয়াহিয়ার ঘোষণার প্রতিবাদে। এদিন থেকে মার্চের প্রতিটি দিনই মেহেরপুর ছিল বিক্ষোভে উত্তাল। এর রেশ ছিল ১৭ এপ্রিল বৈদ্যনাথ তলায় মুজিবনগর সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্যদের শপথ গ্রহণের দিন পর্যন্ত। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি , সৈয়দ নজরুল ইসলামকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও তাজউ্িদন আহমদকে প্রধানমমন্ত্রী কওের মুজিনগর সরকার গঠন করা হয়েছিল। ২৬ মার্চ থেকে ১৭ এপ্রিল পর্যন্ত মেহেরপুর ছিল মুক্তাঞ্চল। যার ফলে এখানকার মানুষ তাদের যুদ্ধ কৌশল বেশি দেখা ও দেখানোর সুযোগ পেয়েছিলেন। মেহেরপুরের সীমান্তপথ দূর- দুরান্তের মানুষের জন্য নিরাপদ রুট।

১৮ এপ্রিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনী দখল নিয়েছিল মেহেরপুরের। আর তাদের কবল থেকে মুক্ত হয়েছিল ৬ ডিসেম্বর। তাদের হত্যা, নির্যাতন, অগ্নিসংযোগের বর্বরতায় অনেক মূল্য দিতে হয় মেহেরপুরবাসীকে। তারপরও দেশ-মাকে মুক্ত করতে তাঁরা কখনও পিছপা হননি। বরং অন্যান্য এলাকার চেয়ে মুক্তিযুদ্ধে মেহেরপুরবাসীর অবদান বেশিই। ১৯৭১-এর মার্চ-এপ্রিলের, বিশেষ করে মার্চের ঘটনাবলীর দিকেই এ লেখায় প্রধানত দৃষ্টিপাতের চেষ্টা করি।

২ মার্চ ১৯৭১ মেহেরপুর স্কুল-কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরা বিশাল মিছিল বের করেন। আমরা তখন গভর্নমেন্ট হাইস্কুলের ছাত্র। আমরা এই মিছিলে যোগদানের মধ্য দিয়ে শুরু করি আমাদের অগ্রযাত্রা। প্রতিদিনই মিছিলে যোগ দিই। স্লোগানে-স্লোগানে প্রতিদিনই প্রকম্পিত হয়ে ওঠে রাজপথ। ২ মার্চের বিক্ষোভে শুধু ছাত্র-ছাত্রীরাই নয়, সর্বস্তরের মানুষ যোগ দেন। একদিকে যেমন দোকানপাট বন্ধ করে ব্যবসায়ীরা রাস্তায় নেমে আসেন, তেমনই আইনজীবী ও অন্যন্য পেশার এবং গ্রাম-গ্রামান্তরের মানুষ লাঠি- সড়কি আর বল্লম নিয়ে বিক্ষোভ কওে অচল করেদেন মেহেরপুরকে।

৩ থেকে ৬ মার্চ মেহেরপুর শহরে হরতাল পালিত হয়। ৩ মার্চ পূর্ণদিবস এবং ৪ থেকে ৬ মার্চ অর্ধদিবস হরতাল পালিত হয়। মেহেরপুর পরিণত হয় মিছিলের শহরে। বের করা হয় মশাল মিছিলও। ৩ মার্চ থেকে ঘরে ঘরে কালো পতাকা উত্তোলনও করা হয়। ৭ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা দেন- ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণ রেডিওতে প্রচারের কথা থাকলেও তা সেদিন প্রচার করা হয় নি। সন্ধ্যায় বিবিসির খবরে বঙ্গবন্ধুর ওই ভাষণের খবর প্রচারিত হয়। ৮ মার্চ ভাষণটি রেডিওতে প্রচার করা হয়। ভাষণ প্রচার না করায় ৭ মার্চ শহীদ শামসুজ্জোহা পার্কে প্রতিবাদ সমাবেশে পাকিস্তানের জাতীয় পতাকা পোড়ানো হয়। এর আগে মিছিল বের করা হয়। সেদিন থেকে মার্চজুড়ে মেহেরপুরে প্রতিদিনই মিছিল, সমাবেশ হতে থাকে। এসব মিছিলÑসমাবেশে মেহেরপুরের মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নেন। ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত গঠন করা হয় সংগ্রাম পরিষদ। মেহেরপুর মহকুমা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক ছিলেন মোঃ ছহিউদ্দিন।
১৫ মার্চ মেহেরপুর থানাভবনে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। পরবর্তী দিনগুলোও মেহেরপুর মিছিলে উত্তাল থাকে। মিছিলে শ্লোগান ওঠে- জয়বাংলা, জয়বাংলা, তোমার দেশ আমার দেশ বাংলাদেশ বাংলাদেশ, তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা মেঘনা যমুনা। সেই মিছিলে মেহেরপুরের স্থানীয় দুটি শ্লোগান আজও মনে গেঁথে আছে-
১. এক সের দুধে দু’সের পানি, টিক্কা খানের কলমাছানি ।(মেহেরপুরে কুলখানিকে কলমাছানি বলা হয়)।
২. ডাল নুন তেল তরকারি, ইয়াহিয়া খানের বউ সরকারি।

তখন মুক্তিকামী প্রতিটি বাঙালির কাছে ইয়াহিয়া খান আর টিক্কা খান ছিল ঘৃণিত, যার বহিঃপ্রকাশ এই দুই স্লোগানে উঠে এসেছে।

২৫ মার্চ দিবাগত গভীর রাতে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা মেহেরপুরে এসে পৌঁছায়। নেয়া হয় মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি। মেহেরপুরের স্কুল-কলেজের ছাত্রদের আগে থেকেই ডামি রাইফেল দিয়ে অস্ত্রচালনার ট্রেনিং দেয়া হয়। মেহেরপুর গভর্নমেন্ট হাইস্কুলে আমরা যারা স্কাউট করতাম তাদেরকে স্কুলে থাকা ডামি রাইফেল দিয়ে অস্ত্রচালনা শেখানো হয়েছিল। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে প্রতিরোধে কলেজ ছাত্রদের নেতৃত্বে এসময় গড়ে তোলা হয়েছিল বন্দুকবাহিনী। ছাত্র-যুবক যিনি যেভাবে পেরেছেন, তিনি সেভাবে তাঁর প্রিয় মেহেরপুরকে রক্ষার চেষ্টা করেছেন। প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলেছেন। পাকিস্তানিরা যাতে মেহেরপুর প্রবেশ না করতে পারে সেজন্য ২৬ মার্চের পর থেকে খলিসাকুণ্ড সেতুতে প্রতিরোধব্যুহ গড়ে তোলা হয়। মেহেরপুর-চুয়াডাঙ্গা সড়কে গাছ কেটে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আসার পথ রুদ্ধ করা হয়। এক পর্যায়ে গ্রামে ও ভারতে যেতে বাধ্য হতে হয় মেহেরপুর শহরের সিংহভাগ মানুষকে। মেহেরপুরের মুক্তিযোদ্ধারা অসীম সাহসের সাথে লড়েছেন পাকিস্তানি সেনা ও তাদের এদেশীয় সহযোগীদের বিরুদ্ধে এবং বিজয় ছিনিয়ে এনেছেন।

৩০ মার্চ দিবাগত রাতে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে কুষ্টিয়া প্রতিরোধযুদ্ধে মেহেরপুরের আনসার-মুজাহিদ বাহিনীর দুই শতাধিক সদস্য অংশ নেন। এই যুদ্ধে আনসার-মুজাহিদদের সঙ্গে সর্বস্তরের মানুষ অংশ নেন। পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের এই বিজয় ছিল প্রথম বিজয়। বিখ্যাত টাইম পত্রিকা এ যুদ্ধে বিজয়গাঁথা তুলে ধরে প্রচ্ছদ কাহিনী করেছিল, যার শিরোনাম ছিল ‘ব্যাটল অব কুষ্টিয়া’।

সে সময় মেহেরপুরের এসডিও তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেন ও অস্ত্র চেয়ে পাঠান। থ্রিনট-থ্রি’র জায়গায় উন্নত অস্ত্রশস্ত্র ও অন্যন্য সহায়তা দিয়েছিল ভারত ও রাশিয়া। ভারত এদেশের কোটি মানুষকে আশ্রয় দিয়েছিল।
ইয়াহিয়া খান , টিক্কা খানরা মেহেরপুরসহ বৃহত্ত কুষ্টির মাটিকে ‘তামা’ কওে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছিল, কিন্তু তাদের শেষ পর্যন্ত পরাজয় স্বীকার করতে হয়েছে। এর ফলে এদেশের মানুষ কার্যত তাদের ‘কলমাছানিই’ কওে ছেড়েছে।
বাংলাদেশ আজ বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে দাড়িঁয়েছে। এখন এই দেশকে আরও এগিয়ে নিতে হবে।

লেখক: কবি ও সাংবাদিক, ঢাকা।