ধাতুসুধায় লালনপাঠ

ধাতুসুধায় লালনপাঠ

মূলকথা
ঋষিমতে শব্দ পরাশক্তি বিশেষ। মানবিক বিভিন্ন চেতনা বর্ণকে আশ্রয় করে শব্দে রূপান্তরিত হয়। তাই শব্দ ও চেতনা একে অপরের পরিপূরক। কারও শব্দসংস্কৃতি থেকে তার চেতনা পরিমাপ করা যেতে পারে। শব্দ সংস্কৃত হয় তার অখণ্ড রূপ থেকে; আবার এই অখণ্ডতা বা সম্পূর্ণতা নির্মিত হয় মূলানুগ হলে। গোটা ভাব বা বস্তুকে যা দিয়ে ধরে রাখা যায় সেটাই তার মূল বা ধাতু। দেহ নানাপ্রকার প্রাণরস ধারণ করে টিকে থাকে, সেগুলোই দেহের ধাতু। ঠিক তেমনই শব্দ একটি ভাব বা চেতনার কাঠামো যা ধাতুকে ভর করে দাঁড়িয়ে থাকে। শব্দের গোটা ছবি দেখতে হলে ধাতুবিচার খুবই জরুরি। ধাতু বা মূলের বাইরে থেকে শব্দকে দেখা অনেকটা কুয়াশার ভেতর কিছু অস্পষ্ট দেখার মতো।

এই দৃষ্টিভঙ্গিতে শব্দার্থবোধ অনমনীয়, ভঙ্গুর, সঙ্কীর্ণ, অবৈজ্ঞানিক ও অসম্পূর্ণ হতে বাধ্য। যেমন দেহ ও শরীরÑএই দুটো শব্দ দিয়ে বিষয়টি ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। আমরা প্রায়শ দেহকে শরীর আবার শরীরকে দেহের সঙ্গে সমার্থক করে একাকার করে ফেলি। স্থূল বা প্রতীকী অর্থে তা সঠিক বটে। তবে মূল বা ধাতুবিচাওে দেহ কিন্তু শরীর নয়, শরীরও দেহ নয়। দেহ শব্দকাঠামোর ভেতরে দিহ্ ধাতু উপস্থিত। এর অর্থ বৃদ্ধি, প্রসারণ; জীবসত্তা ভ্রƒণাবস্থা থেকে ভূমিষ্ঠ হয়ে যতক্ষণ পর্যন্ত বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয় ততক্ষণ সেটা দেহ নামধারী।

জৈবিক নিয়মে এই বাড়ন্তভাব আবার উল্টোদিকে ধায় অর্থাৎ ক্ষয়িষ্ণু হতে থাকে; কায়াসত্তার এই ক্ষয়ে-যাওয়া-দশার নাম শরীর। শৃ বা শর ধাতুযোগে শরীর শব্দটি সাধিত। এর অর্থ হিংসা, বধ, পীড়ন। দেহের সীমানা পেরিয়ে জীবসত্তা শরীরের চৌহদ্দিতে ঢুকলে শর দ্বারা আক্রান্ত হয়। শরের একটি অর্থ তীর। তীরের কাজ বিদ্ধ করা। উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, হতাশা, অবসাদ, ক্লান্তি ইত্যাদির নাম মানসিক শর। উচ্চ রক্তচাপ, বহুমূত্র, কর্কট (ক্যান্সার), বাত প্রভৃতি হল কায়িক শর। অসংখ্য নমুনা থেকে মাত্র দুটো নমুনার ধাতুবিচার করে দেখা গেল শব্দ নিছক শব্দ নয়, এর পরিধি অনেক বিস্তৃত ও তলগামী।

লালন সাঁইজির পদাবলী বাংলা তথা বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে একটি বিরাট সম্পদ। তাঁর পদ বিভিন্ন সাধক ও সারস্বত সমাজ মূল্যায়ন করেছেন। এই অধম তাঁর পদগুলো ধাতুবিচারে দর্শন করার সযত্ন প্রয়াস অব্যাহত রেখেছে। “ইটিমোলজি” (শব্দের ব্যুৎপত্তি নির্ণায়ক শাস্ত্র) আমার একটি সর্বাত্মক অনুসন্ধানের বিষয়। দীর্ঘ প্রায় দু-দশক এই সন্ধানক্ষেত্রে চষে বেড়াচ্ছি। এতে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন ভাষার শব্দের আন্তরিক ঐশ্বর্য আমার চোখে পড়ছে। দশকজোড়ের অভিজ্ঞতায় এই বিশ্বাস জন্মেছে মূলবিচারে শব্দের স্বরূপ যেভাবে উন্মোচিত হয় অন্য কোনো উপায়ে তার রূপ সেভাবে ফোটে না।

এ প্রসঙ্গে ঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের দৃষ্টিভঙ্গি উল্লেখ করা যেতে পারে। শাস্ত্রালোচনায় অনেক সময় তিনি তাঁর ভক্তদেরকে বিশেষ বিশেষ শব্দের তাৎপর্য বোঝাতেন মূল বা ধাতুবিচার করে। মরমী সাধক লালন ফকিরের পদও মরমী যা মর্ম (ধাতু) থেকে অনুভব করতে হয়। লোকপ্রিয় কথা লোকজ সুরে পরিবেশিত হয় বলে সাধারণ লোক সরফের কথা ও সুরের চটকে মুগ্ধ হন। ভেতরের বার্তা তাদের কাছে হয় ভাসাভাসা থাকে নতুবা একেবারেই বোধগম্য হয় না। তাই এই পদ অনেক সময় সম্পদ না হয়ে বিপদ তৈরি করে।

এই সম্পন্নপদকে কৌতূহলী পাঠকের দরবারে পদস্থ করতে আমি ধাতুসুধার আশ্রয় নিয়েছি যা “ধাতুসুধায় লালনপাঠ” শিরোনামে উপস্থাপিত হতে যাচ্ছে। এতে তাঁর পদাবলীর প্রত্যেকটি চরণ ও পারিভাষিক শব্দাবলী মূল থেকে অর্থাৎ ধাতুবিচারের মাধ্যমে বিশ্লেষণ করা হয়েছে।

           ১। ‘বলি মা তোর চরণ ধরে’

আর আমারে মারিস নে মা
বলি মা তোর চরণ ধরে ননী চুরি আর করব না।।

ননীর জন্যে আজ আমারে মারলি গো মা বেঁধে ধরে
দয়া নাই মা তোর অন্তরে স্বল্পেতে গেলো জানা।।

পরে মারে পরের ছেলে কেঁদে যেয়ে মাকে বলে
মা জননী নিঠুর হলে কে বোঝে শিশুর বেদনা।।

ছেড়ে দে মা হাতের বাঁধন যে দিকে যায় দুই নয়ন
পরের মাকে ডাকব এখন লালন তোর গৃহে আর থাকব না।।

‘আর আমারে মারিস নে মা
বলি মা তোর চরণ ধরে
ননী চুরি আর করব না।’
পদাবলীতে বর্ণিত শব্দমালা থেকে প্রথমে মা শব্দটি নিয়ে আলোচনা করা যাক। এখানে ‘মা’-কে মায়াবা প্রকৃতিস্বরূপ বিবেচনা করে এগোলে বাণীর অর্থ দিনের আলোর মতো স্বচ্ছ হয়ে ওঠে। আমরা জানি সংসারে মায়ার কারণে জীব মোহগ্রস্ত থাকে। মলিনতা তাকে ঘিরে ধরে; তার নবরূপে উত্তরণের সম্ভাবনা রুদ্ধ হয়। পুরুষÑপ্রকৃতির নিত্যলীলায় প্রকৃতি বা মায়ার যে লীলা তাকেই মায়ার মার হিসাবে আখ্যায়িত করা যায়। মায়ার উপদ্রব বা অত্যাচার থেকে রেহাই পাওয়ার আকুতি সাঁইজির বয়ানে এভাবে উঠে এসেছেÑ ‘আর আমারে মারিস নে মা।’ এবার ‘ননী চুরি’র বিষয়টি দেখা যাক। ননী চুরি থেকে ননী শব্দটির মর্ম উদ্ধার করি। নবনীত>নবনীঅ>ননীÑ মূলত ননী শব্দটি নবনীত থেকে বিবর্তনের মাধ্যমে ননীতে এসেছে। নবনীত অর্থাৎ নূতন অবস্থায় উন্নীত হওয়া; দুধের ভেতর থেকে জল নিষ্কাশন করলে তা ননী পর্যায়ে পৌঁছোয়। এটা দুধের একটি নতুন সত্তায় উত্তরণ ঘটা। ঠিক একইভাবে জাগতিক বন্ধনে আবদ্ধ জীব জলমেশানো দুধের মতো ভেজাল বা দূষিত। এই মায়ার পাশ কাটিয়ে জীব মুক্ত হতে সমর্থ হলে তার উত্তরণ ঘটে; আর এটি একটি নূতন বা নবরূপে উন্নীত হওয়া যাকে সাঁইজি ননী হওয়ার সঙ্গে তুলনা করেছেন।

জাগতিক মায়া ষড়রিপুর জালে জীবকে আটকে রাখতে চায়; কেউ কেউ এই জাল ছিন্ন করে বের হওয়ার চেষ্টা করে। আর ঠিক তখনই মায়া সংহার-মূর্তি ধারণ করে মারমুখী হয়ে ওঠে। তবে এখানে ‘ননী চুরি আর করব না’ কিন্তু মায়ার সঙ্গে আপোষকামিতা নয়। ভাবখানা এমন যেন তোমাকে ভজনা বা আরাধনা করেই সাধনের গোপন কর্মটি সম্পন্ন করব। এ প্রসঙ্গে সাধক রামকৃষ্ণের অতুল্য উপমার উল্লেখ করা যেতে পারে। তাঁর মতে লক্ষ্মণÑসীতাÑরাম একই পথে চলছে অথচ লক্ষ্মণ রামকে দেখতে পাচ্ছে না সীতার কারণে। মায়ারূপী সীতা মাঝখানে থাকায় জীবরূপী লক্ষ্মণ পরম রামকে দর্শন করতে ব্যর্থ হচ্ছে। মায়াবেড়ি ভেঙে বের হওয়ার শাস্তি সাঁইজির বাণীতে এভাবে ধরা পড়েছেÑ ‘ননীর জন্যে আজ আমারে মারলি গো মা বেঁধে ধরে।’
এর পরের চরণ দুটিÑ
‘দয়া নাই মা তোর অন্তরে
স্বল্পেতে গেল জানা।’
মায়া তোর ভেতর দয়া নেইÑএ কথাটিকে সাঁইজি বলেছেনÑ ‘দয়া নাই মা তোর অন্তরে।’ বস্তুত দয়া ও মায়া একসঙ্গে থাকতে পারেনা; কারণ এরা একে অন্যের সম্পূর্ণ বিপরীত। সর্বভূতে উপকার সাধনের নাম দয়া অর্থাৎ এটি একটি সার্বজনীন করণ ও সাধন, পক্ষান্তরে মায়া একান্তই মমতার সমার্থক যা শুধু নিজের ক্ষুদ্র গণ্ডিতেই তার চলনকে সীমিত রাখে। আর এই দয়া ও মায়ার ফারাক জানা যায় ফারুক হলে, যা আবার সূক্ষ্মজ্ঞান বা বোধি নির্দেশক। এই সূক্ষ্মতার হিসেব নিকেশকে সাঁইজি বললেনÑ ‘স্বল্পেতে গেল জানা।’

‘পরে মারে পরেরছেলে
কেঁদে যেয়ে মাকে বলে।’
এখানে ‘পর’ ও ‘ছেলে’ শব্দদ্বয়ের ভেদ উন্মোচন হওয়া আবশ্যক। ‘পর’ এখানে ‘পরম’ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। লালন সাঁইজি তাঁর একটি পদে সরাসরি ‘পর’ অর্থে ‘পরম’-কে নির্দেশ করেছেন। ‘আমার ঘরখানায় কে বিরাজ করে’-এই পদাবলীর আভোগাংশে ‘লালন বলে পর বলতে পরওয়ার’-চরণটিই তার জলজ্যান্ত প্রমাণ। এই সূত্রে ‘পরের ছেলে’-বাগি¦ধির অর্থ দাঁড়ায় পরমের সন্তান। সন্তান অর্থ বিস্তার; আদি(পুরুষ) তার শক্তি নিয়ে অর্থাৎ আদ্যাশক্তিতে মহাজগতে আবির্ভূতÑএটাই মূলত পরমের সন্তান বা ছেলে।

‘মা জননী নিঠুর হলে
কে বোঝে শিশুর বেদনা।’
জননীর মধ্যে জনন বা সৃজন রয়েছে; সুতরাং ‘মা জননী’ শব্দযুগলের অর্থ মায়া সৃষ্টিকারী সত্তা; এই সত্তার অভেদ্য বলয় অত্যন্ত কঠিন বা নিষ্ঠুর। মায়ার ঘেরায় বাসকারী মূঢ়জন দয়া, কোমলতা, নবীনতা যা কিনা শিশুসত্তার গুণাবলী সে সম্পর্কে সংবেদনশীল থাকে না। আর এই অবস্থাকে সাঁইজি বাণীবদ্ধ করেছেন এভাবেÑ‘মা জননী নিঠুর হলে কে বোঝে শিশুর বেদনা।
‘ছেড়ে দে মা হাতের বাঁধন
যেদিকে যায় এই দুই নয়ন।’
উপর্যুক্ত দুটি চরণে মায়া বা মুগ্ধতার থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার মিনতি প্রকাশিত হয়েছে।
‘পরের মা কে ডাকবে এখন লালন
তোর গৃহে আর রবে না।’
পদাবলীর সর্বশেষ দুটি পঙক্তিতে পরের মা অর্থাৎ পরম মা (পরম মান) অন্য কথায় পরমপ্রকৃতিকে আশ্রয় করে সাঁইজি মায়ার গৃহ ত্যাগ করার সুস্পষ্ট ঘোষণা দিয়েছেন। জগৎসংসারের ভগ্নাংশ মান (মায়া) থেকে বেরিয়ে মহাজাগতিক পূর্ণমান (পরের মা)-এ পৌঁছানোর জন্য ননী চুরির অপরিহার্যতাই এই পদাবলীর মূল প্রতিপাদ্য।

২। সত্য বল সুপথে চল
সত্য বল সুপথে চল ওরে আমার মন
সত্য সুপথ না চিনিলে পাবি নে মানুষের দরশন।।

খরিদদার মহাজন যেজন বাটখারাতে কম তারে কসুর করবে যম
গদিয়াল মহাজন যেজন বসে কেনে প্রেমরতন।।

পরের দ্রব্য পরের নারী হরণ করো না পারে যেতে পারবে না
যতবার করিবে হরণ ততবার হবে জনম।।

লালন ফকির আসলে মিথ্যে ঘুরে বেড়ায় তীর্থে তীর্থে
সই হলো না একমন দিতে আসলেতে তার প’লো কম।।

‘সত্য বল সুপথে চল
ওরে আমার মন
সত্য সুপথ না চিনিলে
পাবি নে মানুষের দরশন।’
উদ্ধৃত বাণীগুচ্ছের বক্তব্য বেশ সাদামাটা হলেও মানুষ শব্দটির মর্মার্থ অনুসন্ধান জরুরি। প্রতিটি ব্যক্তি মনের অধিকারী। ঐ মনের মধ্যে মানুষের উপস্থিতি টের পাওয়া যায় সত্য উচ্চারণে এবং সুপথ গমনে। অর্থাৎ সত্যই ‘বল’ মিথ্যা দুর্বল, আবার সুপথই হল ‘চল’ বিপথ অচল। ‘মানুষ’ এখানে পুরুষের সমার্থক। মহাজগতের পুরা(পূর্ণ) ও পুরু সত্তাই মূলত পুরুষ দ্যোতক। জীবাত্মক মন নিত্য চেতনায় (সত্য) বিচরণ করলে পূর্ণতার মানে উঠে আসে তখন এই মন ঐ মানুষ (পুরুষ)-কে দেখতে পায়। যা লালনভাষ্যে এভাবে ধরা দেয়Ñ
‘সত্য সুপথ না চিনিলে
পাবি নে মানুষের দরশন।’

‘খরিদদার মহাজন যেজন
বাটখারাতে কম
তাদের কসুর করবে যম;
গদিয়াল মহাজন যেজন
বসে কেনে প্রেমরতন।’
পদাবলীর এই অংশে খরিদদার মহাজন ও গদিয়াল মহাজন অর্থে দুটি পক্ষের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। উল্লিখিত যুগল পক্ষের একটি অপূর্ণতা বা ঘাটতি সূচক (খরিদদার মহাজন) অন্যটি পূর্ণতাব্যঞ্জক (গদিয়াল মহাজন)। সাধারণ জীবসত্তার মান ‘একমন’-এর থেকে ঊন বা হীন তাই তা ওজনে (বাটখারা) কম। মানসম্মত (একমণ) ওজন থেকে কমতির ফলে জীবসত্তা ত্রুটিপূর্ণ (কসুর) হয়ে খণ্ডিত (যম) হয়। সোজা কথায় একমন (বাহ্যিক ওজনের একক এবং অভ্যন্তরীণ অখণ্ডতার একক) থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার দরুণ অদ্বৈত থেকে দ্বৈততার দিকে যে যাত্রা তাকেই সাঁইজি ‘তাদের কসুর করবে যম’ বলে অভিহিত করেছেন। পক্ষান্তরে যেজন পূর্ণমান (গদিয়াল) অর্জন করে সেই মানুষ (পুরুষ) এর সঙ্গে অভিন্ন হয়েছেন তিনি থিতু হয়ে মনের মানুষের সঙ্গে রমণ (প্রেমরতন) করতে সক্ষম হন। প্রেমারতির এই দিকটি লক্ষ্য করে লালন গেয়ে ওঠেনÑ ‘গদিয়াল মহাজন যে জন বসে কেনে প্রেমরতন।’

‘পরের দ্রব্য পরের নারী
হরণ করো না
পারে যেতে পারবে না।’
এখানে পরের দ্রব্য, পরের নারী ও পারÑএই তিনটি শব্দের মূলানুগ বিচারে মৌলিক বার্তার উন্মোচন হতে পারে। শুরুতে ‘দ্রব্য’ শব্দটির ধাতুবিচার: কোনো বস্তুকে দ্রব্যবাচক হতে গেলে তার ভেতর দ্রুতি বা গতি থাকতে হয়; বস্তু রসাত্মক হলে গতি হয় নিশ্চিত। তার মানে দ্রব্য, দ্রবণ একই ধাতুগোষ্ঠীর সদস্য। মহাজগতে যে রসের কারবার চলছে তা বিভিন্ন দ্রব্যে সন্নিবেশিত রয়েছে। প্রতিটি মানুষ এক একটি বিশাল রসের আধার। এই রসায়নের খবর পেতে হলে রস ধারণ বা সাধন অবশ্যকর্তব্য। যে রস ধারণ করলে মানুষ বীর(পুরুষ), বলবান হয় তা-ই পরম দ্রব্য (পরের দ্রব্য) প্রধান সাধনবস্তু।

এবারে পরের নারী। নারী শব্দটি ‘নর’ এর সঙ্গে ‘ঈ’ প্রত্যয়যোগে নিষ্পন্ন। নর একা চলতে পারে না তাকে কিছু ধরতে হয় যাকে আমরা নরের ধর্ম বলতে পারি। অর্থাৎ নরের ধর্মই নারী; সুতরাং পরম নরধর্মকে পরের নারী বলা যায়। যা আসলে পরমাপ্রকৃতির নামান্তর।

এখন ‘পার’-এর পালা। জগৎসংসারে এসে মানুষ নিষ্কর্মা হয়ে বসে থাকতে পারে না; কর্ম করার অর্থই হল মোহপাশে আটকে যাওয়া; তবে কি কর্মবিমুখ হতে হবে? ঠিক তা নয়Ñ সংসারসমুদ্রে কর্মের সততা অসততা বিচার করে অর্থাৎ কর্মসম্পাদনের ভেতর দিয়ে তীরে পৌঁছুতে হবে। এর নাম কর্মসমাপ্তি যা বোঝাতে সাঁইজি ‘পার’ শব্দ ব্যবহার করেছেন। তাহলে ‘পরের দ্রব্য পরের নারী হরণ করো না/পারে যেতে পারবে না।’ চরণযুগলের ভাষ্য দাঁড়ায়Ñ পরম সাধন বস্তু ও পরমা প্রকৃতিকে লুণ্ঠন করে কর্মসম্পাদন অসম্ভব।
‘যতবার করিবে হরণ
ততবার হবে জনম।’
গর্ভ থেকে যোনিপথে নিঃসরণের নাম জনম। সুতরাং যতক্ষণ কর্ম অসম্পাদিত থাকবে ততক্ষণ জীব বিভিন্ন যোনিতে পরিভ্রমণ করবে।
‘লালন ফকির আসলে মিথ্যে
ঘুরে বেড়ায় তীর্থে তীর্থে।’

পদাবলীর ভণিতাংশে সাঁইজি আমজনতার দরবারে নেমে এসে ভনেÑ লালন ফকির আসলে মিথ্যে; এখানে ‘আসল’ শব্দের আসলত্ব খোঁজা যাক। আসল বা খাঁটি বস্তুটি হল ‘একমন’ (যার ব্যাখ্যা আগে দেওয়া হয়েছে)। দুটো সত্তার (জীব ও পরম) এক বা অভিন্ন হওয়াটাই হল আসল। আর এই আসলের জায়গা থেকে সাধারণের কাতারে নেমে আসা লালন মিথ্যে বা নকল। পদাবলীর অনেক ভণিতায় সাঁইজি তাঁর ভূমিকাকে সাধারণীকরণ করে নিজেকে উপস্থাপন করেছেন।
‘ঘুরে বেড়ায় তীর্থে তীর্থে’

এক হতে ব্যর্থ হওয়ায় বিচ্ছিন্নতার ফলে জীবসত্তা ভ্রমের মধ্যে থাকায় তার ভ্রমণ চলছেই। এটিকেই তিনি ‘ঘুরে বেড়ায় তীর্থে তীর্থে’Ñবলে পদবদ্ধ করেছেন। তীর বা কর্মসম্পাদনে থিতু হওয়াটাই মূলত তীর্থ।
যখন ওজনের একক একমণ ও অদ্বৈতের একক একমন সই বা শুদ্ধ হয় না তখন একমণে/মনে ঘাটতি থেকে যায় যেটিকে লালন ছন্দোবদ্ধ করেছেন এভাবেÑ ‘সই হলো না একমন দিতে/আসলে তার প’লো কম।’

৩। তিন পাগলে হলো মেলা
তিন পাগলে হলো মেলা নদেয় এসে
তোরা কেউ যাসনে ও পাগলের কাছে।।

একটা পাগলামি করে জাত দেয় সে অজাতেরে দৌড়ে গিয়ে
আবার হরি বলে পড়ছে লুটে ধুলোর মাঝে।।

একটা নারকেলের মালা তাতে জল তোলাফেলা করঙ্গ সে
পাগলের সাথে যাবি পাগল হবি বুঝবি শেষে।।

পাগলের নামটি এমন বলিতে অধীন লালন হয় তরাসে
ও সে চৈতে নিতে অদ্বয় পাগল নাম ধরে যে।।

‘তিন পাগলে হলো মেলা নদেয় এসে
তোরা কেউ যাসনে ও পাগলের কাছে।’
উল্লিখিত শব্দমালার তিন পাগল ও ‘নদে’ শব্দজোড়ের রহস্য উদ্ঘাটন হলে এর ভেতরের অর্থ আমাদের বোধগম্য হবে। ‘নদে’: এটিকে অনেকেই একটি স্থাননাম হিসেবে অনুবাদ করে থাকে। মধ্যযুগে শ্রীচৈতন্যসহ তিন আত্মতত্ত্ববিদের নদীয়া ভূখন্ডে যে মিলন মেলা রচিত হয়েছিল তাকে কেউ কেউ ‘তিন পাগলে হলো মেলা নদেয় এসে’-বলে অভিহিত করে থাকেন। এই অভিমত মেনে নিলে সাঁইজির পদনিহিত বার্তা একটি বিশেষ স্থান-কাল পাত্রে আবদ্ধ হয়ে যায়। একজন কালোত্তীর্ণ পুরুষের বাণী কখনও সীমিত স্থানকালে বন্দি হতে পারে না। তাঁর মুখনিঃসৃত বাণী সনাতন ও শাশ্বত হওয়াই স্বাভাবিক। এই পদাবলীর অন্তিমে সাঁইজি তিন পাগলের নামগুলি সুস্পষ্ট ঘোষণা করে তাদের সার্বজনীন স্বরূপ নিশ্চিত করেছেন। সুতরাং এই নদ যে ভৌগোলিক নদীয়া নয় তা সুনিশ্চিত। এখানে প্রবাহ অর্থে ‘নদ’কে বোঝানো হয়েছে। মানবদেহে ঈড়া, পিঙ্গলা, সুষুম্না নাড়ির ধারা প্রবাহিত। তাদের সম্মিলিত ধারা মিলেছে কুলকুণ্ডুুলিনীতেÑএটাকে সাঁইজি ‘তিন পাগলে হলো মেলা নদেয় এসে’Ñবলে বর্ণনা করেছেন। ‘তোরা কেউ যাসনে ও পাগলের কাছে’Ñ এটি হল একধরণের প্রচ্ছন্ন হুঁশিয়ারী। ঈড়া, পিঙ্গলা, সুষুম্না নাড়ীত্রয়ের সাধন অসম্পূর্ণ থাকলে দেহ সংস্কার হয় না, বিকারগ্রস্ত থাকে। এই বিকৃত মানসিকতায় পরমপ্রেমে আত্মহারা পাগলের কাছে ভেড়াটা ঠিক নয়।
‘একটা পাগলামি করে
জাত দেয় সে অজাতেরে দৌড়ে গিয়ে।’
পাগলের ‘আমি’(ঝবষভ)-র মধ্যে যে ভাব তার নাম পাগলামি। লালনঘোষিত পাগলত্রয়- চৈতে, নিতেই, অদ্বয়Ñএটা মূলত উপনিষদের সৎ-চিৎ-আনন্দ বা সচ্চিদানন্দ সত্তা। চিৎস্বরূপ সত্তা চৈতে, নিতাই হল নিত্যানন্দ এবং অভেদ দ্বৈততাহীন ব্রহ্ম সত্তাই হল সাঁইজি নির্দেশিত অদ্বয়। আবার সাঁইজির এই তিন পাগল রামকৃষ্ণের ভাবসঙ্গীতে মূর্ত হয়েছে এভাবেÑ
‘বামে অদ্বৈত আর দক্ষিণে নিতাই
তার মাঝে নাচে আমার চৈতন্য গোঁসাই।’
উক্ত ভাষ্যের আলোকে এটা সুনির্ণীত যে ‘চৈতে-নিতে-অদ্বয়’ এই ত্রয়ীসত্তা একে অপরের পরিপূরক। নিত্য চেতনায় একাকার হলে মানুষের উত্তরণ অর্থাৎ দ্বিতীয় জন্ম বা দ্বিজপ্রাপ্তি ঘটে। এটাকে সাঁইজি ‘জাত দেয় সে অজাতেরে’-বলে পদায়ন করেছেন।
‘আবার হরি বলে পড়ছে
লুটে ধুলোর মাঝে।’
চৈতে, নিতে, অদ্বয়-এর যে কোন একটি আহরিত হলে মানুষ হরিদশায় পৌঁছে যায়। তখন নমঃ নমঃ ভঙ্গি তার নিত্যসঙ্গী। নিজেকে মনে হয় মহাপ্রভুর একান্ত দাস। নিবেদন তার অস্থিমজ্জায়।

‘একটা নারকেলের মালা
তাতে জল তোলাফেলা করঙ্গ সে।’
নারকেলের মালাই হল করঙ্গ। এটি সাঁইজির একটি গুরুত্বপূর্ণ শব্দভেদ। মাথার খুলি, শরীরাস্থি, দেহ ইত্যাদি অর্থে শব্দটির প্রচলন আছে। করঙ্গ ও কমণ্ডলু সমার্থক। সন্ন্যাসী বা ব্রহ্মচারীর ব্যবহৃত কাঠ বা মাটি দিয়ে তৈরি জলপাত্রকে কমণ্ডলু বলে। তাহলে দেখা যাচ্ছে নারকেলের মালাÑকরঙ্গÑকমণ্ডলু একই দ্রব্যসামগ্রী। কমণ্ডলুর মধ্যে যে মুণ্ড্ আছে তার ধাতুগত অর্থ হল হর্ষ বা আমোদ। ‘নারকেলের মালাতে জল তোলাফেলার’-আগমিক অর্থ সাধক দেহের বীররসের প্রবাহ শক্তি কুলকুণ্ডলিনীর মাধ্যমে জাগিয়ে তুলে মুণ্ডু অর্থাৎ মস্তিষ্কেও সহস্রারে চালনা করে প্রসাদ লাভ করতে পারে। অন্যদিকে রসের স্খলনে অবসাদগ্রস্ত হতে পারে। তবে এ সাধনকর্মের ভেদ বুঝতে হলে চৈতে-নিতে-অদ্বয় পাগলের সঙ্গী হতে হবে। অন্যকথায় সচ্চিদানন্দ বিহার জরুরি। যাকে সাধক লালনÑ ‘পাগলের সঙ্গে যাবি/পাগল হবি বুঝবি শেষে’ অভিধায় ভূষিত করেছেন।

‘পাগলের নামটি এমন
বলিতে অধীন লালন হয় তরাসে।’
ভণিতায় যথারীতি খাস লালন আমদরবারে আত্মতত্ত্বের খবর দিতে ভয় পাচ্ছে। এই ভীত হবার কারণটি পূর্বেই আলোচিত হয়েছে।