পিরোজপুরে সংঘর্ষের জেরে অর্ধশত পরিবার গ্রাম ছাড়া

একদিকে প্রতিপক্ষের হামলার ভয়, অপরদিকে পুলিশের গ্রেফতার আতঙ্ক। দুই আতঙ্কে মেহেরপুর সদর উপজেলার পিরোজপুর গ্রামের প্রায় অর্ধশত পরিবারের শতাধিক নারী-পুরুষ এখন পলাতক জীবন যাপন করছেন। গ্রামের দু’টি পাড়া এখন জনমানব শুন্য। খা খা করছে পিরোজপুর গ্রামের দু’টি পাড়ার শতাধিক বাড়ি ঘর। তবে, পাড়া দুটিতে লোকজনের দেখা না মিললেও কোনো ধরণের অপ্রিতীকর ঘটনা এড়াতে পুলিশের টহল চলছে রাত দিন।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে বাড়ির লোকজন পলাতক থাকায় এখন খা খা করছে ওই পরিবারের মধ্যে। পুলিশের পাহারা চললেও গ্রামের মানুষের মাঝে বিরাজ করছে আতংক।

ক্রিকেটের একটি ব্যাট নিয়ে সৃষ্ঠ তুচ্ছ ঘটনায় দুজনের মধ্যে বাক বিতন্ড হলেও এখন সেটি ক্ষমতাশীন দলের দুটি পক্ষের পেশী শক্তির আধিপত্য বিস্তারের বিষয় বস্তুতে পরিণত হয়েছে।

এ ঘটনায় এখন ৪ জন আহত হয়েছে। আহতরা হলেন, ফিকির বিশ্বাসের ছেলে আব্দুল হামিদ ও হারু বিশ্বাসের ছেলে বকুল হোসেন। অপর পক্ষের আহতরা হলেন, আশকর আলীর ছেলে মতিরুল ইসলাম ও অপর আশকর আলীর ছেলে আব্দুর রাজ্জাক। আহতদের মেহেরপুর ২৫০ শয্যার জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

এদের মধ্যে মতিরুল ইসলাম নামের একজন বর্তমানে ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। তার অবস্থা আশংকাজনক বলে দাবী তার পরিবারের।

জানা গেছে, ২ বছর আগে খোকন মোল্লার ছেলে বাবু হোসেনের কাছ থেকে আব্দুল কুদ্দুছের ছেলে টুটুল হোসেন একটি ক্রিকেট ব্যাট নেন। খেলা খেলতে গিয়ে সেই ব্যাটটি ভেঙ্গে যায়। বাবু তার ব্যাটটি দেওয়ার জন্য টুটুলের কাছে বারবার আবেদন জানালেও সেটি ফিরিয়ে দেননি। গত ২৭ অক্টোবর বিকালে এ নিয়ে বাবু ও টুটুলের মধ্যে বাক বিতন্ড হয়। এক পর্যায়ে তাদের মধ্যে হাতাহাতি হয়ে বাড়ি ফিরে গিয়ে টুটুলের পরিবারের লোকজনকে জানালে কুদ্দুছের নেতৃত্বে ২০/২৫ জন লোক ধারালো অস্ত্র দা, লাঠি শোঠা নিয়ে এসে বাবুর বাড়িতে হামলা চালায়। পরে বাবুর লোকজনও তাদের প্রতিরোধ করতে গিয়ে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়।

ওই গ্রামের বাসিন্দা সাইদুল ইসলাম সাধন বলেন, ছোট ঘটনা নিয়ে সংঘর্ষ হলেও এখন আর বিষয়টি ছোট অবস্থায় নেই। এটা এখন বড় রাজনৈতিক নেতাদের মাথায় আছে। আহত আব্দুল হামিদ ও বকুল বর্তমান চেয়ারম্যান আব্দুস সামাদ বাবলু বিশ্বাসের লোক। এছাড়া অপর আহত মতিরুল ইসলাম ও আব্দুর রাজ্জাক পিরোজপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুস সালামের লোক। এখন বিষয়টি রাজনৈতিক দ্বন্দ্বে মোড় নিয়েছে।

স্থানীয় দোকানদার মোস্তফা বলেন, গ্রামে এখন পুলিশে পাহারা দিচ্ছেন। তবে, সুযোগ পেলে দু পক্ষই মারামারিতে লিপ্ত হবে বলে আশঙ্কা রয়েছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে দুই যুবক বলেন, মতিরুল ইসলাম ও আব্দুর রাজ্জাক মুলত সদস্য সমাপ্ত ইাউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের স্বতন্দ্র প্রার্থী আব্দুস সালামের পক্ষে কাজ করেন। এঘটনার পর থেকেই পিরোজপুর গ্রামের এই দুই প্রার্থীর কর্মী সমর্থকদের মধ্যে দ্বন্দ্ব ফ্যাসাদ চলে আসছিল। এলাকায় দুই নেতার আধিপত্য বিস্তার নিয়ে পেশি শক্তি খাটানোর জন্যই এখন চলছে লড়াই। একে অপরকে ঘায়েল করতে চলছে নানা ষড়যন্ত্র। তবে, আব্দুস সামাদ বাবলু বিশ্বাস জনপ্রশাস প্রতিমন্ত্রীর ভগ্নিপতি ও বর্তমান পিরোজপুর ইউপি চেয়ারম্যান হওয়ায় প্রশাসনিকভাবে কিছুটা হলেও আব্দুস সালামের লোকজনকে ঘায়েল করতে পারছে। কৃষক রেজাউল হক ও চা দোকানি গোলাম খাঁ বলেন, এটা ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের জের। দুই পক্ষই দীর্ঘদিন যাবৎ আধিপত্যে বিস্তারের চেষ্টা চালাছিল। মারামারির পর এখন এই গ্রামের প্রায় ৫০/৬০ টি পরিবারের লোকজন পালিয়ে গেছে। এখন পলাতক লোকদের বাড়ি ঘরগুলো খা খা করছে।

তারা বলেন, মতিরুল হাসপাতালে মৃত্যুর মুখে থাকলেও তার অপর দুই ভাই আনারুল ও জহুরুল, গ্রামের আব্দুর রাজ্জাক, খোকন, জবেদ আলী, ইস্রাফিল হোসেন, মিকাইল হোসেন, জানু মন্ডল, মুজিবুল , সাইদুল, খোকন, উজ্জল, আনারুল-২, রাজন, আজাহার, ডিকলার, লেবু বিশ্বাস, সাবদার আলী, রাবুল, তুফান হোসেন, বল্টু হোসেনসহ ৫০/৬০ টি পরিবার পলাতক রয়েছে।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেলো আহত মতিরুলের বাড়িতে এখন শুন্য। তার মা রহিমা খাতুন তালা দেওয়া ঘরের সামনে বসেই তার তিন ছেলের বাড়ি পাহারা দিচ্ছেন। তিনি বলেন, আমার ছেলে গ্যানজাম শুনে সেখানে গিয়েছে। তাকে ধারালো দা দিয়ে পায়ে, মাথায় ও শরীরের বিভিন্ন স্থানে কুপিয়ে রক্তাক্ত করেছে। আমার ছেলে আর কিছুই করতে পারবেনা। প্রতিদিনই দু একবার করে ৪০/৫০ জন লোক বাড়ির উপর খুঁজতে আসছে। নানা ভাবে ভয়ভীতি দেখাচ্ছে।

তবে মেহেরপুর সদর থানার ইন্সপেক্টর অপারেশন শেখ শাহিনুর রহমান জানান, পিরোজপুরের সংঘর্ষের ঘটনায় উভয়পক্ষই মামলা দায়ের করেছেন। আব্দুস সামাদ বাবলু বিশ্বাসের সমর্থক হারুন বিশ্বাস বাদী হয়ে এজাহার নামীয় ১১ জন ও অজ্ঞাত ৪/৫ জনকে আসামি করে একটি মামলা দায়ের করেন যার ,মামলা নং ৪১, তারিখ ৩০/০৮/২০২২ ইং। অপরদিকে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুস সালামের সমর্থক জানু মিয়া বাদী হয়ে এজাহার নামীয় ১২ ও অজ্ঞাত ৩/৪ জনকে আসামি করে একটি মামলা দায়ের করেন যার মামলা নং ৪২, তারিখ ৩১/০৮/২০২২।

মামলার ঘটনায় পুলিশ অভিযান চালিয়ে সংঘর্ষের প্রধান হোতা আব্দুল কুদ্দুছ তার ছেলে ফরহাদ হোসেন ও একটি মামলার বাদী জানু বিশ্বাসকে গ্রেফতার করে জেল হাজতে প্রেরণ করেছে। তবে ইতোমধ্যে জানু বিশ্বাস জামিনে মুক্ত হয়েছেন।
ইন্সপেক্টর অপারেশন শেখ শাহিনুর রহমান আরো বলেন, দায়ের করা দুটি মামলার আসামিদের গ্রেফতারে পুলিশ অভিযান চালাচ্ছে। এছাড়া এলাকায় শান্তি শৃংখলা রক্ষার্থে নিয়মিত টহল অব্যাহত রয়েছে।

পিরোজপুর পুলিশ ক্যাম্পের ইনচার্জ এসআই সাইদুর রহমান বলেন, সংঘর্ষের পর এলাকায় আর কোনো অপ্রিতীকর ঘটনা যাতে না ঘটে, সে ব্যাপারে পুলিশ সজাগ রয়েছে। এই গ্রামে এখন পুলিশী টহল বাড়ানো হয়েছে।

পিরোজপুর ইউপি চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামীলীগের সহ-সভাপতি আব্দুস সামাদ বাবলু বিশ্বাস বলেন, এটা সদ্য সমাপ্ত ইউপি নির্বাচনেরই জের। মুলত আমার প্রতিপক্ষ পরাজিত প্রার্থী আব্দুস সালাম ভোটে হারার পর থেকেই আমার কর্মী সমর্থকদের নানাভাবে হুমকী ধামকী দিয়ে আসছিল। সে প্রায় দিনই তাদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে হুমকী দিয়েছে। সালাম ও তার লোকজন বেছে বেছে আমার লোকের উপর হামলা করতে গেছে।

তিনি আরো বলেন, মেহেরপুর শহরের রাজাকারের ছেলে ইব্রাহিম শাহিন উকিল ও বেশ কয়েকজন নেতা উস্কানি দিয়ে আমার বিরুদ্ধে আব্দুস সালামকে নির্বাচনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল। এর সাথে জেলা পর্যায়ের আরো অনেক নেতা জড়িত। কিন্তু তাকে পরাজিত হতে হয়েছে। এখন এলাকায় আমার নির্বাচনী মাঠের কর্মী সমর্থকদের উপর হামলা ও প্রতিশোধ নেওয়ার চেষ্টা করছে সে। তিনি বলেন, শান্তিপূর্ণ পরিবেশকে অস্থিতিশীল করার পায়তারা করছেন আব্দুস সালাম তার লোকজন। তিনি বলেন,

এদিকে আব্দুস সালাম বলেন, ২০১৪ সালের জামায়াত বিএনপির নেতা আবুল হোসেনের বংশের লোক। যারা রাস্তায় টায়ার জালিয়েছেন তারা এবার বাবলু বিশ্বাসের নৌকার ভোট করে আওয়ামী লীগ হয়ে গেছে। মুলত বাবলু বিশ্বাসের পক্ষে এ গ্রামে আওয়ামীলীগের কোনো লোক ভোটে নামেনি। তাই জামায়াত বিএনপির লোক নিয়ে সে আওয়ামীলীগের লোকজনকে পরিকল্পিতভাবে উস্কানি দিয়ে মারধর করেছে। তিনি বলেন, আমার বাবাসহ আমার পরিবারে ৫ জন মুক্তিযোদ্ধা রয়েছে। অথচ, রাজাকারের ছেলে বাবলু বিশ্বাস মন্ত্রীর বোনের সাথে বিয়ে করে আজ তার সাহসে আমার মুক্তিযোদ্ধা বাবাকে নিয়ে কটাক্ষ করে। এই গ্রামের আওয়ামী লীগের লোকজন তাকে ভোট না দেওয়ায় আওয়ামী লীগের প্রকৃত লোকজনকে সে নানাভাবে নির্যাতন চালাচ্ছে। এবং সে আমাকে নানাভাবে হত্যার ষড়যন্ত্র করছে।