
মেহেরপুরের গাংনী উপজেলাতে গ্রামীণ অবকাঠামো সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ২০২৪-২৫ অর্থ বছরে টিআর, কাবিখা-কাবিটা প্রকল্পের প্রায় সাড়ে ৫ কোটি টাকা বরাদ্দের অধিকাংশ টাকা হরিলুটের অভিযোগ উঠেছে প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) মনসুর রহমানের বিরুদ্ধে।
প্রতিটি প্রকল্পে ১৩ থেকে ১৫ শতাংশ কমিশন নিয়ে পিআইসি সভাপতিদের দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন অধিকাংশ পিআইসিরা।
এ ধরণের অভিযোগের ভিত্তিতে মেহেরপুর প্রতিদিনের অনুসন্ধান টিম গত এক সপ্তাহ ধরে গাংনী উপজেলার বেশ কিছু ইউনিয়নের প্রায় ২০টি প্রকল্প পরিদর্শন করে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির প্রমান পেয়েছে। ১ম পর্বে ডিসি ইকোপার্কের ৬টি প্রজেক্টের বরাদ্দের অনিয়ম নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করা হয়। দ্বিতীয় পর্বে গাংনী উপজেলার মটমুড়া, রাইপুর, সাহারবাটি, কাথুলী ইউনিয়নের বেশ কয়েকটি প্রকল্প সরেজমিন পরিদর্শন, স্থানীয় জনগণ ও পিআইসি সভাপতির সাথে কথা বলে পিআইও মনসুর রহমানের আরও অনিয়ম ও দুর্নীতির চিত্র উঠে এসেছে।
কাবিটা-কাবিখা প্রকল্পের ১ম ও ২য় কিস্তির কাজ চলতি বছরের ৩০ এপ্রিলের মধ্যে এবং ৩য় কিস্তির কাজ চলতি বছরের ১৫ মে’র মধ্যে বাস্তবায়ন করার নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু গেল অর্থবছরে কোন কাজ না করে ১ম ও ২য় কিস্তির পুরোটাকা উত্তোলন করেছেন। তবে ৩য় কিস্তির টাকা উত্তোলন করার চেষ্টা করলেও ইউএনও’র হস্তক্ষেপে ৬৭টি প্রকল্পের টাকা পিআইসি সভাপতিদের নামে পে অর্ডার করে রেখেছেন।
গাংনী প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০২৪-২৫ অর্থ বছরে কাবিটাতে ৭৮টি প্রকল্পের অনুকুলে ২ কোটি ৪০ লাখ ৫৩৭২ টাকা, টিআরের ১২৫টি প্রকল্পের অনুকুলে ২ কোটি ১৬ লাখ ৬৭২৪ টাকা এবং কাবিখার ৪৭টি প্রকল্পের অনুকুলে ১৩৬ মেট্রিক টন চাল এবং ১৩৬ মেট্রিক টন গম, যার বাজার মূল্য প্রায় ৯০ লাখ টাকা। সবমিলিয়ে গাংনী উপজেলায় তিন প্রকল্পে বরাদ্দ প্রায় সাড়ে ৫ কোটি টাকা।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, গাংনী উপজেলার চেংগারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠে মাটি ভরাটের জন্য ৭.৭৭৩৪ মেট্রিক টন গম যা টাকার পরিমাণে প্রায় ২ লাখ ২০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মিজানুর রহমান জানান, কোন মাটি এখানে দেওয়া হয়নি। অথবা এ প্রকল্প সম্পর্কে তিনি কিছু জানেনও না।
কাথুলী ইউনিয়নের গাড়াবাড়িয়া গ্রামের রোজীবালার বাড়ি হতে রশিদের বাড়ি পর্যন্ত এইচবিবিকরণ ও মাটি দ্বারা মেরামত বাবদ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৩ লাখ ৫ হাজার টাকা। কিন্তু কোন কাজ হয়নি বলে নিশ্চিত করেছেন স্থানীয় আব্দুল নামের এক ব্যক্তি। প্রকল্পের খইরুদ্দিনের বাড়ি থেকে ভৈরব নদী পর্যন্ত এইচবিবিকরণসহ মাটি ভরাট বাবদ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ২ লাখ টাকা।
এ দুটিসহ তিনটি প্রকল্পের সভাপতি স্থানীয় ইউপি সদস্য জিনারুল ইসলাম বলেন, বৃষ্টির কারণে একটা কাজ এখনো শুরু হয়নি। তবে বাকি ২ টা কাজ হয়েছে। কাথুলী ইউনিয়নের সব কাজে প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) ১৩ শতাংশ টাকা কেটে নিয়েছেন। তিনি আরও বলেন, কমিশন কাটা নিয়ে কাথুলী ইউনিয়নের মেম্বারদের সাথে পিআইও’র সম্পর্ক খারাপ হয়েছে। তবে অন্যান্য ইউনিয়নের ১৫ শতাংশ ও তার বেশি কেটেছে বলে শুনেছি।
৩য় কিস্তিতে গাড়াবাড়িয়া হলদেপাড়া ঈদগাহে ওয়াল প্লাস্টার, রংকরণ ও টাইলসের কাজে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ২ লাখ টাকা। তবে প্রকল্পের সভাপতি আকতারুজ্জামান বলেন, এখনো স্টিমেট হাতে পায়নি বলে কাজ বন্ধ আছে।
কাথুলী গ্রামের ঈদগাহ পাড়ার সবাফতের বাড়ির সামনের পুকুরের প্যালাসাইডিং নির্মাণ ও মাটি ভরাটের কাজে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৩ লাখ টাকা। প্যালাসাইডিংয়ের কাজ হলেও মাটি ভরাট করা হয়নি।
মটমুড়া ইউনিয়নের হোগলবাড়িয়া গ্রামের শামসুলের বাড়ি হতে কবরস্থান মুখী রাস্তা এইচবিবি সহ মাটি ভরাট কাজে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৪ লাখ টাকা। স্থানীয়দের অভিযোগ ১৫০ ফুট থেকে ১৮০ ফুট হেয়ারিং এর কাজ হয়েছে তিন নম্বর ইট দিয়ে, এবং রাস্তার দুই পাশে মাটির কাজ থাকলেও বাইরে থেকে কোন মাটি দেওয়া হয়নি, আশেপাশের মাটি কেটে ভরাট করা হয়েছে। তবে এ প্রকল্পের সভাপতি আইজুদ্দিন মেম্বার কাজ হয়েছে বলে জানালেও কতটাকার কাজ সেটা জানাতে পারেননি।
রায়পুর ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ড সালদহ গ্রামের ফজলুর বাড়ি থেকে ঠান্ডুর বাড়ি অভিমুখী এইচবিবিকরণ, প্যালাসাইডিং ও মাটি ভরাট ৪ লাখ ১৯ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। তবে এখনো কোন কাজ করা হয়নি।
প্রকল্পের সভাপতি প্যানেল চেয়ারম্যান সারজিদুল ইসলাম বলেন, পিআইও অতি চালাক মানুষ। সময় শেষের দিতে ইউএনও স্যারকে বলে টাকাটা তুলে নিয়েছে যাতে ফেরৎ না যায়। সেই টাকা আমরা পেয়েছি ২৬ তারিখে। যে কারণে কাজ করতে পারিনি। তবে টাকা দেওয়ার আগে প্রতিটি কাজের জন্য ১৪ পার্সেন্ট করে কেটে নিয়েছে। বৃষ্টি ছাড়লেই কাজটা শুরু করবো।
মটমুড়া ইউনিয়নের মটমুড়া গ্রামের ঈদগাঁ পাড়া ঈদগাঁয়ের ব্রিকসাইডিং নির্মাণ ও মাটির কাজ বরাদ্দ ১২ মেট্রিক টন চাউল, ওই হিসেবে ৪ লাখ ৫৬ হাজার টাকা। এ প্রকল্পে শুধুমাত্র প্যালাসাইডিংয়ের কাজ হয়েছে মাটি দেওয়া হয়নি।
তবে, এ বিষয়ে গাংনী উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মনসুর রহমানের সাথে। কাজ হয়নি স্বীকার করে তিনি বলেন, ‘৩০ জুনের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও চলতি বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত কাজ করতে পারবো।’
কাজ না করে টাকা উত্তোলনের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘জুনের মধ্যে টাকা তোলার নিয়ম আছে তাই ২৬ জুন টাকা উত্তোলন করেছি। ৩য় কিস্তির ৬৭টি প্রকল্পের বিলের চেকও দেখান তিনি। তবে ১ম ও ২য় কিস্তির বিল উত্তোলনের কথা বলতে তিনি পিআইসির মাধ্যমে বিল উত্তোলন করা হয়েছে।” তবে ১৫ শতাংশ কমিশন নেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেন।
গাংনী উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো: আনোয়ার হোসেন মেহেরপুর প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমি মে মাসে জয়েন করেছি। তার আগে এ প্রকল্পগুলো গ্রহণ করা হয়েছে। প্রকল্পের অর্থ নয়ছয় হচ্ছে এমন কিছু অভিযোগ পেয়ে আমি পিআইওকে বলেছি পুরো কাজ বুঝে নেওয়া হবে। ৩য় কিস্তির টাকা উত্তোলন করে পে-অডার করে রাখার নির্দেশে আমি দিয়েছি এবং পিআইসি সভাপতিদের বলেছি সরকারি টাকা তছরুপাত করা যাবে না। তবে, প্রকল্পের কাজ স্টিমেট অনুযায়ী বুঝে নেওয়া হবে। বুঝে না পেলে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
আগামী পর্বে পড়ুন পিআইসি মনসুর রহমান এই প্রকল্পগুলো থেকে কমিশন নিয়ে লক্ষ লক্ষ টাকা নিয়ে কি করেছেন, কাকে কাকে কমিশনের ভাগ দিতে হয়েছে। এমনকি পিআইও কিছু পিআইসিকে নাম মাত্র সভাপতি কেন পুরো কাজ নিজেই করছেন। এবং গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য বরাদ্দকৃত সরকারি টাকা এভাবে লুটপাট করায় সংশ্ষ্টি কর্তৃপক্ষ অভিযুক্ত পিআইও’র বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা গ্রহণ করলেন তাও দেখতেও চাই সাধারণ মানুষ। আমরা এমন কিছু মানুষের বক্তব্যও তুলে ধরার চেষ্টা করবো।