![ফেঁসে যাচ্ছেন শীর্ষ এজেন্ট জামান-নুরুলসহ অনেকে](https://www.meherpurpratidin.com/wp-content/uploads/2023/08/555.jpg)
ফেঁসে যাচ্ছেন শীর্ষ এজেন্ট জামান-নুরুলসহ অনেকে
শামিম রেজা ওরফে শেখ বিজয়কে আটকের পর নতুন করে আবারও আলোচনায় অনলাইন জুয়া। শেখ বিজয়ের দেওয়া স্বীকারোক্তিতে আবার ফেঁসে যাচ্ছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকা জামান মাষ্টার, নরুল মাস্টারসহ ৬ শীর্ষ এজেন্ট। শেখ বিজয়ের আটকের পর পুলিশের এজাহার থেকে এসব তথ্য জানা গেছে। গত ১১ আগষ্ট মুজিবনগর থানায় এস আই খালিদুর আশিক বাদি হয়ে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৩০(২)/৩৫ ধারায় শেখ বিজয়সহ অজ্ঞাত ৬/৭ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছেন। যার নম্বর-১০।
মামলার এজাহারে জানা গেছে, মোবাইল ব্যাংকিং সেবার কতিপয় অসাধু সেলস্ রিপ্রেজেন্টেটিভের জোগসাজোশে অনলাইন জুয়া ওয়ান এক্স বেট, গেস মেলবেট সাব- এজেন্টরা ভূয়া তথ্য দিয়ে বিভিন্ন ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের নাম ব্যবহার করে ব্যবসায়ীক এজেন্ট সিম নিবন্ধন করে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি ব্যতিত অবৈধ ই-ট্রান্সজেকশন করছে।
মুজিবনগর উপজেলার শিবপুর গ্রামের অনলাইন জুয়ার এজেন্ট শামীম রেজা ওরফে শেখ বিজয় তার তিনতলা বিল্ডিংয়ের উপরে অনলাইন জুয়ার মাধ্যমে অবৈধভাবে সংগৃহিত বিকাশ এজেন্ট নাম্বার ০১৪০৩-৪১৮৯৬২ এর মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ টাকা অবৈধ ই-ট্রান্সজেকশন করছে এমন খবরের ভিত্তিতে পুলিশ সেখানে অভিযান পরিচালনা করে। সেখানে থেকে তিনটি এন্ড্রয়েড মোবাইল ফোন, অনলাইন জুয়ার এজেন্ট সীম উদ্ধারসহ শেখ বিজয়কে আটক করা হয়। পরে পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে শেখ বিজয় জানায়, সে একজন অনলাইন জুয়ার এজেন্ট। বিগত ২/৩ বছর যাবৎ সে অনলাইন জুয়ার এজেন্ট হিসেবে কাজ করিতেছে।
তার সহযোগী অনলাইন জুয়ার ব্যবসায়ীক পার্টনার হিসেবে রশিকপুর গ্রামের মোঃ তরিকুল ইসলাম (২৭) তার স্টেনলি মেইন বিকাশ নামের চ্যানেলটি বিগত ১ বছর আগে কোমরপুর গ্রামের জামান মাস্টার এর নিকট থেকে ৫৭ লাখ টাকায় ক্রয় করে।
শেখ বিজয়ের নিকট থেকে জব্দকৃত ফোনে ব্যবহৃত টেলিগ্রাম, স্কাইপি, ই-মেইল এবং ফোনের গ্যালারি পর্যালোচনা করে আসামীর অনলাইন জুয়ার চ্যানেলে বিভিন্ন সময়ে ক্রিপ্টোকারেন্সি ক্রয়ের তথ্য পাওয়া যায় এবং ক্রিপ্টোকারেন্সি পরবর্তীতে ইউএসডিটি’র রুপান্তরের তথ্য পাওয়া যায়। এছাড়া আসামীর নিকট থেকে জব্দকৃত ভিভো ভি২৭ই মডেলের মোবাইল ফোনে ব্যবহৃত রেড্ডি এ্যান্সে এবং ক্রোম ব্রাউজারের তথ্য পর্যালোচনা কওে ওয়ান এক্স বেট, গেস মেইল বেট এর অর্থ পরিচালনাকারী ওয়েবসাইট এ প্রবেশের তথ্য পাওয়া যায় এবং মেলবেট এ ইউএস ডলার জমাদানের তথ্য পাওয়া যায়।
এজাহাওে আলো উল্লেখ আছে, আসামী শখ বিজয় কে আরও জিজ্ঞাসাবাদে সে পুলিশকে জানায় যে, মেহেরপুরের মুজিবনগর উপজেলার কোমরপুর গ্রামের জামান মাস্টার, গোপালপুর গ্রামের নুরুল ইসলাম ওরফে লালন মাস্টার, কোমরপুরের মিঠু, সাহেবপুরের আরিফ, কোমরপুরের মুকুল, শিবপুরের লিপু গাজীসহ অনেকে অনলাইন জুয়া ওয়ান এক্স বেট গেস মেলবেটসহ রাশিয়া ভিত্তিক বিভিন্ন জুয়ার সাইটের এজেন্ট হিসেবে কাজ করছে।
ফিরে দেখা
গত বছরের ২৫ সেপ্টেম্বর মেহেরপুর প্রতিদিনে “ধরাছোঁয়ার বাইরে অনলাইন জুয়ার অন্যতম চার হোতা মুকুল-জামান-নুরুল-মাদার” শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছিলো। ওই প্রতিবেদনের পরে জামান, নুরুল, মুকুল বিভিন্ন মাধ্যমকে ম্যানেজ করে চলছিলো। পাঠকদের জন্য ওই প্রতিবেদনটি আবারো প্রকাশ করা হলো।
অনলাইন জুয়ার সংবাদ প্রকাশ ও পুলিশের অভিযান শুরু হওয়ার পর মেহেরপুর প্রতিদিনের সাথে যোগাযোগ করেন ক্ষতিগ্রস্থ এক অনলাইন জুয়ার এজেন্ট। তিনি মেহেরপুর প্রতিদিনকে দেওয়া ভিডিও সাক্ষাৎকারে দুর্লভ কিছু স্বীকারোক্তি দেন। স্বীকারোক্তিতে যাদের নাম জানান, তাদের নাম এখনো পর্যন্ত কোন সংবাদে কিংবা পুলিশের তালিকায় উঠে আসেনি। ওইসকল নামগুলো যাচাই বাছাইয়ে মেহেরপুর প্রতিদিনের অনুসন্ধান চলছে। অনলাইন জুয়ার এ সকল মাস্টারমাইণ্ডরা ধরা ছোঁয়ার বাইরে থেকে দেদারছে বুকফুলিয়ে জুয়া চালিয়ে যাচ্ছেন।
তার স্বীকারোক্তী থেকে জানা গেছে, ২০২০ সালে করোনাকালীন সময়ে মূলত কয়েকজন অনলাইন জুয়ায় জড়িয়ে পড়েন। তারা হলেন- কোমরপুর গ্রামের মুকুল ইসলাম, নুরুজ্জামান ওরফে জামান মাস্টার, নুরুল ইসলাম ওরফে লালন মাস্টার, মাদার আলী ওরফে মাদার মাস্টার এদের অন্যতম। তাদের মাধ্যমে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছে অনলাইন জুয়ার দূর্গ। তারাও হয়েছেন কোটিপতি। এদের রয়েছে প্রায় দু’ডজন এজেন্ট। যারা এই চারজনের চ্যানেল নিয়ে নিয়মিত অবৈধ ট্র্যানজেকশন করে চলেছেন।
চার হোতাদের মধ্যে নুরুজ্জামান ওরফে জামান মাস্টার ও নুরুল ইসলাম মাস্টার দুজনই মুজিবনগর আদর্শ মহিলা কলেজে শিক্ষকতা করেন। কিন্তু কলেজটি এখনো এমপিও ভুক্ত হয়নি। তারা দুজনই মুকুল ইসলামের মাধ্যমে অনলাইন জুয়ায় জড়িয়ে পড়েন। অপরদিকে, মাদার মাস্টার নিজেই এ অনলাইন জুয়ার হোতা হয়ে উঠেছেন।
নুরুজ্জামান মাস্টার ঢাকার একটি গার্মেন্টেসে চাকরি করতেন। চাকরি ছেড়ে তিনি নিজ গ্রামে চলে আসেন। কলেজ শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি নবাব ও মুকুলের মাধ্যমে অনলাইন জুয়ায় জড়িয়ে পড়েন। এর পর থেকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। কোমরপুর বাজারে ডাচ বাংলা ব্যাংকের এজেন্ট নিয়ে ব্যাংকিং ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েন। মূলত অনলাইনের লেনদেনগুলো যেন তার ব্যাংকে থেকেই করতে পারেন। পাশাপাশি কেউ যেন সন্দেহ করতেও না পারেন তাকে। কোথায় থেকে এত টাকা মালিক হচ্ছেন। বছর তিনেক আগে মাটির ঘরে বসবাস করলেও বর্তমানে আলিশান বাড়ি তৈরি করেছেন। ব্যবহার করেন দামি মোটরসাইকেলও। কয়েক মাস আগে তাকে পুলিশ তুলে নিয়ে এসেছিলো। অজানা কারণে তাকে ছেড়েও দেওয়া হয়েছে।
তবে মাস খানেক আগে তার ব্যাংকে গিয়ে তার সাথে কথা বলে মেহেরপুর প্রতিদিনের একটি টিম। তিনি বলেন, জুয়া কি জিনিস আমি জানি না। কিভাবে বা কারা এসব খেলে তাও জানিনা। কিন্তু বিভিন্ন জন এই ব্যাংক দেওয়ার পর থেকে আমাকে জুয়ার সাথে জড়িত থাকার অভিযোগ তোলে। এর আগে পুলিশও আমাকে সন্দেহ করে উঠিয়ে নিয়ে গিয়েছিলো বলে তিনি স্বীকারও করেন।
নুরুল ইসলাম মাস্টার গরিব ঘরের সন্তান। তিনি মুজিবনগর আদর্শ কলেজের শিক্ষক। তিনিও জড়িয়ে পড়েন অনলাইন জুয়ায়। শুরু করেন লাইনবেট অনলাইন জুয়ার এজেন্ট হিসেবে। পরবর্তিতে তিনি কেদারগঞ্জ বাজারে সিটি ব্যাংকের এজেন্ট নিয়েছেন। তার পাশে মার্কেন্টাইল ব্যাংক নামের আরেকটি ব্যাংকের এজেন্ট নিয়েছেন। পরবর্তিতে আরো একটি ব্যাংকের এজেন্ট নেন। তিনি স্থানীয়দের ভাষ্যমতে, কয়েকমাস আগে তিনি একই দাগে প্রায় কয়েক বিঘা জমি কিনেছেন প্রায় কোটি টাকা দিয়ে। দুই তলা বিশিষ্ট বাড়িও করেছের নিজ গ্রামে। আর এ সবকিছুর উৎস অনলাইন জুয়া।
মাদার আলী ওরফে মাদার মাস্টার। তিনি কোমরপুরের স্থায়ী বাসিন্দা হলেও সদর উপজেলার সাহেবপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের লাইব্রেরিয়ান হিসেবে কর্মরত। অথচ কোটি টাকা খরচ করে ২তলা বিশিষ্ট রাজপ্রাসাদ বানিয়েছেন তিনি। বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, ১০ থেকে ১২টি লাইনবেট সাইটের এজেন্ট তিনি। তিনি নিজেও এই লেনদেনের সাথে জড়িত এবং তার ছেলে অনিক ঢাকা থেকে তার এসকল লেনদেন করে থাকেন বলে অভিযোগ রয়েছে। ছেলে অনিক ঢাকার বাসা ভাড়া থেকে পুলিশের হাতে আটক হয়েছিলো।
এই তিনজনই স্থানীয় প্রভাবশালী এক নেতার সানিধ্য থেকে নিজেদের বড় রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে দাবী করেন। এমনকি সুযোগ পেলেই জনপ্রতিনিধিদের সাথে ছবি তুলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দিয়ে নিজেদের জানান দেন। অভিযোগ রয়েছে তাদের নাম যেন কোন সংবাদে না আসে কয়েকজনকে সাংবাদিককেও মাসোহারা দিয়ে থাকেন।
স্থানীয় কয়েকজন জানান, জামান মাস্টার ও নুরুল মাস্টারের অর্থনৈতিক অবস্থা হঠাৎ করে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছের মত হয়ে যাওয়ার মত হয়েছে। এবং মাদার মাস্টারের অবস্থাও খুব বেশি ভালো ছিল না। কিন্তু হঠাৎ করে এই তিনজনের আলাদিনের চেরাগ পাওয়ার মত অবস্থা হয়ে গিয়েছে।
অপরজন, মুকুল ইসলাম। তিনি অনলাইন জুয়ার মূল হোতা। তিনি কোমরপুর গ্রামের ইজারুল ইসলামের ছেলে। তিনি লেখাপড়ার পাশাপাশি ইনকামের নেশায় মাহফুজুর রহমান নবাবের সাথে অনলাইন জুয়া খেলায় জড়িয়ে পড়েন। পরবর্তিতে তার মাধ্যমে অনলাইন জুয়ার এজেন্ট চ্যানেল দিয়ে পুরো এলাকা অনলাইন জুয়ায় ছাপিয়ে দেন। বিভিন্ন জনের কাছে থেকে বিভিন্ন অংকের টাকা নিয়ে তিনি লাইনবেটের এজেন্ট বিক্রি করেন। এবং একই সঙ্গে নিজেও জুয়া খেলেন। অভিযোগ রয়েছে বিভিন্ন জনের কাছে থেকে তিনি চ্যানেল বিক্রির নামে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন কিন্তু অনেককেই চ্যানেল দিতে পারেননি। তিনি নিজেও জুয়া খেলে চ্যানেল বিক্রির টাকা নস্ট করে সর্বশান্ত হয়েছেন। অন্যান্যরা কোটিপতি হলেও তিনি জুয়ায় হেরে ধীরে ধীরে নি:স্ব হচ্ছেন বলেও খবর পাওয়া গেছে।