বন্যাকে সঙ্গী করেই চলছে বাংলাদেশ

বর্ষা আসে, সঙ্গে আসে বন্যা। প্রতি বছরের মতো এ বছরও ধেয়ে এসেছে বন্যা। ভাসিয়ে নিয়ে চলেছে ফসলের খেত, খামার। উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল, বৃষ্টির পানির তোড়ে ডুবে গেছে শহর, গ্রাম।

এ বছর আষাঢ় মাসেই দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল ডুবে গিয়েছিল। সেই পানি যেখান দিয়েই নেমে আসছে সেসব এলাকাই তলিয়ে গেছে পানির নিচে। নদীর তীব্র স্রোত দুই পাড় ভেঙে বিলীন করে দিচ্ছে ঘরবাড়ি, জনপদ। পানির তীব্র স্রোত বাঁধ ভেঙে ভাসিয়েছে ফসলের খেত। দেশের প্রায় সব নদীর পানি বেড়ে বিপত্সীমার ওপর দিয়ে বইছে। এখন পর্যন্ত ৩১টি জেলার প্রায় ৪০ লাখে বেশি মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। ডুবে গেছে দেশের এক-তৃতীয়াংশ এলাকা। এখন শ্রাবণ চলছে ফলে সামনে শ্রাবণ পেরিয়ে ভাদ্র পর্যন্ত যে আরো কয়েক দফা বন্যা হতে পারে সে আশঙ্কা রয়েই গেছে। গত বছর ২০১৯ সালে তো ৬০ বছরের রেকর্ড ভেঙে অক্টোবরেও বন্যা হয়েছিল।

পানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্ষায় ঐতিহাসিকভাবেই বাংলাদেশে বন্যা হয়। কারণ, নদীবাহিত পলি জমে জমেই এই বদ্বীপের জন্ম। বাংলাদেশের জন্ম। বন্যায় এই পলি সমতলে ছড়িয়ে মাটির উর্বরতা বাড়ায়। তাই, বাংলাদেশের জন্য বন্যা একই সঙ্গে অভিশাপ ও আশীর্বাদ। তবে, এটা ঠিক মনুষের পরিবেশ বিধ্বংসী নানামুখী কার্যক্রমের কারণে বন্যার ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও ক্রমশ বাড়ছে।

এ প্রসঙ্গে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আরিফুজ্জামান ভুঁইয়া ইত্তেফাককে বলেন, বর্ষা মৌসুমে বাংলাদেশে বন্যা হয় এটা স্বাভাবিক। তবে, এবারের বন্যা স্বাভাবিকের চেয়ে কিছুটা দীর্ঘস্থায়ী রূপ নিয়েছে। এক মাসের বেশি হতে চলেছে। ১৯৯৮ সালের বন্যার পর এবারের বন্যাই দীর্ঘস্থায়ী রূপ নিয়েছে। তবে, এখন পর্যন্ত ১৯৮৭ ও ৮৮ সালে যেমন বন্যা হয়েছিল তেমন বন্যা হওয়ার আশঙ্কা এখন পর্যন্ত নেই বলে উল্লেখ করেন তিনি।

আরিফুজ্জামান ভুঁইয়া আরো বলেন, এ বছর মৌসুমি বায়ুর কারণে যে বৃষ্টিপাত হয় সেটা সারা দেশেই বিরাজমান। ফলে মেঘনা অববাহিকা থেকে উত্তরাঞ্চল সবখানেই বৃষ্টি হচ্ছে। সে কারণে পানি মেঘনা অববাহিকা দিয়ে দ্রুত নেমে যেতে পারছে না। সে কারণেই বন্যা দীর্ঘস্থায়ী রূপ পেয়েছে।

প্রকৃতিগতভাবেই বাংলাদেশ ভাটির দেশ। বাংলাদেশের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া পানির উত্পত্তিস্থল হচ্ছে ভারত, নেপাল ও চীন। এসব দেশ থেকে প্রবাহিত পানি বাংলাদেশের ওপর দিয়ে বয়ে গিয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়ে। উজানের দেশগুলো থেকে বয়ে আসা পানির প্রধান নির্গমন পথ হচ্ছে জিএমবি বেসিনস। অর্থাত্ গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা অববাহিকা।

গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা নদীর বার্ষিক সম্মিলিত বন্যার প্রবাহ একটিই নির্গমন পথ অর্থাত্ লোয়ার মেঘনা দিয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়ে। এ কারণে লোয়ার মেঘনার ঢাল ও নিষ্ক্রমণ ক্ষমতা কমতে থাকে। নদীর পানির স্তরের এই উচ্চতার প্রতিকূল প্রভাব সারা দেশেই পড়ে। কারণ বন্যার পানি নিষ্ক্রমণের অবস্থা ও ক্ষমতা দুটোই এর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এতে ছোট ছোট নদীর প্রবাহ কমে যায়।

প্রতি বছর বাংলাদেশের প্রায় ২৬ হাজার বর্গ কিলোমিটার অঞ্চল অর্থাত্ ১৮ শতাংশ ভূখণ্ড বন্যাকবলিত হয়। ব্যাপকভাবে বন্যা হলে সারা দেশের ৫৫ শতাংশের অধিক ভূখণ্ড বন্যার প্রকোপে পড়ে। প্রতি বছর গড়ে বাংলাদেশে তিনটি প্রধান নদীপথে মে থেকে অক্টোবর পর্যন্ত আর্দ্র মৌসুমে ৮ লাখ ৪৪ হাজার মিলিয়ন কিউবিক মিটার পানি প্রবাহিত হয়। বার্ষিক মোট প্রবাহের এটি ৯৫ শতাংশ। তুলনায় একই সময় দেশের অভ্যন্তরে ১ লাখ ৮৭ হাজার মিলিয়ন কিউবিক মিটার নদী প্রবাহ সৃষ্টি হয় বৃষ্টিজনিত কারণে।

বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে বন্যার সঙ্গে ফসলের একটা সম্পর্ক রয়েছে। দেশের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে একটি বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ তিস্তা ও ব্রহ্মপুত্র নদের ডান দিকের প্লাবনভূমিগুলোকে রক্ষা করছে। উত্তর-পূর্বাঞ্চলের প্লাবনভূমিসমূহকে তিনটি অঞ্চলে ভাগ করা যায়। ব্রহ্মপুত্র ও পদ্মার বাম প্লাবনভূমি; মধুপুর গড় দ্বারা ব্রহ্মপুত্র নদ থেকে বিচ্ছিন্ন পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদ উপত্যকা ও মেঘনা নদী অববাহিকা।

মেঘনা অববাহিকা মহা-সিলেট-অবনমন দ্বারা প্রভাবিত যেখানে সুরমা ও কুশিয়ারা নদী মিলিত হয়ে মেঘনা নাম নিয়েছে। মেঘনা নদীর পানির উচ্চমাত্রা বন্যার মৌসুমে ভাটিতে পদ্মা নদীর পানির মাত্রা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। বর্ষাকালের শুরুতেই মেঘনা নদী দ্রুত বন্যার পানিতে ভরে ওঠে এবং বর্ষা শেষ না হওয়া পর্যন্ত তা পানিতে টইটম্বুর থাকে। সরাসরি সাগরে পানি চালান দিয়ে থাকে বলে এই অববাহিকায় পানি নিষ্ক্রমণের হার কম।

বাংলাদেশে চার রকমের বন্যা হয়। মৌসুমি বৃষ্টির কারণে, বর্ষা মৌসুমে নদীর পানি উপচে উঠে প্লাবন, উজান দেশ থেকে ঢলের পানি ও জলোচ্ছ্বাস। এখন ভাটির দেশ হবার কারণে বাংলাদেশে বন্যা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয় না। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে পলি জমে নদীতল উঁচু হওয়া, উন্নয়ন প্রকল্প ও সড়ক-সেতু ইত্যাদির কারণে পানি নিষ্কাশন পথগুলো সংকুচিত হওয়া এবং বন্যা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমের ব্যর্থতা।

দেশে বন্যা নিয়ন্ত্রণে নির্মিত হয়েছে অসংখ্য বাঁধ। এসবে বন্যা না কমে বরং বেড়েছে। এ খাতে ব্যয় হওয়া বিপুল পরিমাণ ঋণের টাকা প্রতি বছরের বানের জলে ভেসে গেছে বললে খুব একটা ভুল বলা হয় না। এই বন্যার প্রকোপ কমিয়ে যদি এই পানির প্রবাহকে নিয়ন্ত্রণ করতে হয় তবে তা করতে হবে উজানে।

বাংলাদেশে প্রলয়ংকরী কয়েকটি বন্যার চিত্র

১৮২২ সালের বন্যায় বাকেরগঞ্জ বিভাগ ও পটুয়াখালী মহকুমা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ৩৯ হাজার ৯৪০ ব্যক্তি ও ১৯ হাজার গবাদিপশু মারা যায়। ১৩ কোটি টাকার সম্পদ ধ্বংস হয়। বরিশাল, ভোলা ও মনপুরা দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত।

১৮৭১ সালে রাজশাহী ও আরো কিছু জেলায় ব্যাপক বন্যা হয়। শস্য, গবাদি পশুসহ জানমালের ব্যাপক ক্ষতি হয়। এটি ছিল রাজশাহীতে রেকর্ডকৃত এ যাবত্কালের সবচেয়ে ভয়ংকর বন্যা।

১৮৭৬ সালে বরিশাল ও পটুয়াখালী দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মেঘনা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৬ দশমিক ৭১ মিটার উঁচু হয়ে গলাচিপা ও বাউফলের ব্যাপক ক্ষতির হয়। ২ লাখ ১৫ হাজার মানুষের জীবনহানি হয়। বন্যার অব্যবহিত পরে কলেরাতেও মানুষের মৃত্যু হয়।

১৯১৫ সালে ময়মনসিংহে তীব্র বন্যা হয়। ১৮৫৯ সালে ব্রহ্মপুত্র নদীর গতিপথ পরিবর্তনের কারণে তিস্তা নদীর যে বন্যা হয়েছিল তার সঙ্গে সেই বছরের বন্যার ক্ষয়ক্ষতি ছিল সমান।

১৯৫৪ সালের ২ আগস্ট ঢাকা শহর পানির তলে নিমজ্জিত হয়। ১ আগস্ট সিরাজগঞ্জে যমুনা নদীর পানির উচ্চতা ছিল ১৪.২২ মিটার এবং ৩০ আগস্ট হার্ডিঞ্জ ব্রিজের কাছে গঙ্গা নদীর পানির উচ্চতা ছিল ১৪.৯১ মিটার।

১৯৫৫ সালে ঢাকা জেলার ৩০ শতাংশ এলাকা প্লাবিত হয়েছিল। বুড়িগঙ্গা ১৯৫৪ সালের সর্বোচ্চ সীমা ছাড়িয়ে যায়।

১৯৬৬ সালে ঢাকা জেলার অন্যতম প্রলয়ংকরী বন্যাটি হয় ৮ জুন। ১৫ সেপ্টেম্বর ৫২ ঘণ্টা একনাগাড়ে বৃষ্টির ফলে ঢাকা শহর প্রায় ১২ ঘণ্টা ১.৮৩ মিটার পানির নিচে তলিয়ে ছিল।

১৯৮৭ সালে জুলাই-আগস্ট মাসে বন্যায় বড় ধরনের বিপর্যয় হয়। প্রায় ৫৭ হাজার ৩০০ বর্গকিলোমিটার এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত (সারা দেশের ৪০ শতাংশ এর বেশাি)। এ ধরনের বন্যা ৩০ থেকে ৭০ বছরে একবার ঘটে। দেশের ভিতরে এবং বাইরে অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতই বন্যার প্রধান কারণ ছিল। ব্রহ্মপুত্রের পশ্চিমাঞ্চল, গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র একীভূত হওয়ায় নিচের অঞ্চল, খুলনা এবং মেঘালয় পাহাড়ের সংলগ্ন অঞ্চল বন্যা কবলিত হয়।

১৯৮৮ সালে আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে বন্যায় ভয়ংকর বিপর্যয় নেমে আসে। প্রায় ৮২ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয় (সারা দেশের ৬০ শতাংশ এর বেশি)। এ ধরনের বন্যা ৫০ থেকে ১০০ বছরে একবার ঘটে। বৃষ্টিপাত এবং একই সময়ে (তিন দিনের মধ্যে) দেশের তিনটি প্রধান নদীর প্রবাহ একই সময় মিলিত হওয়ার ফলে বন্যার এই প্রলয়ংকরী রূপ দেখা দেয়। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা শহরও প্লাবিত হয়। সেই বন্যার স্থায়িত্বকাল ছিল ১৫ থেকে ২০ দিন।

১৯৯৮ সালের বন্যায় সারা দেশের দুই-তৃতীয়াংশের বেশি এলাকা দুই মাসের অধিক সময় বন্যা কবলিত থাকে। বন্যার ব্যাপ্তি অনুযায়ী এ বন্যাকে ১৯৮৮ সালের বন্যার সঙ্গে তুলনা করা হয়ে থাকে।

সূত্র- ইত্তেফাক