বিকাশকর্মী থেকে কোটি কোটি টাকার মালিক আনোয়ার,নেপথ্যে অনলাইন জুয়া

বিকাশের ডিস্ট্রিবিউটর সেলস অফিসার (ডিএসও) পদে চাকরিকালীন মাসে বেতন পেতেন সাড়ে ১১ হাজার টাকা। করোনার অতিমারিতে অনলাইন জুয়ার কার্যক্রম শুরু হলে জুয়াড়িদের কাছে বিকাশের এজেন্ট সিম সরবরাহ করতে আবিষ্কার করে তিনি নিজেই অনলাইন জুয়ার হোতা বনে যান। আর এই দুই বছরে সাড়ে ১১ হাজার টাকা বেতনের সেলস প্রতিনিধি এখন কোটি কোটি টাকার মালিক।

আরব্য রজনির রুপকথা আলাদিনের চেরাগকে হার মানানোর গল্প এটি। এবারের গল্পের নায়কের নাম আনোয়ার হুসাইন। বয়স আনুমানিক ৩০ বছর। মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার গাড়াডোব গ্রামের কিয়াম উদ্দিনের ছেলে। ইতোমধ্যে গাড়াডোব অনলাইন জুয়ার দ্বিতীয় দূর্গ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। যে গ্রামে ৩০ থেকে ৪০ জন তরুন অনলাইন জুয়ার এজেন্ট হিসেবে কাজ করছেন।

মুলত ২০২০ সালে করোনার সময় তিনি অনলাইন জুয়ার এজেন্ট মাদার আলীকে সিম সরবরাহ করতে গিয়ে অনলাইন জুয়ায় জড়িয়ে পড়েন। যখন কোনমতে বিকাশের বেতন থেকে সংসার চালাতেন। মাত্র দেড়বছর যেতে না যেতেই কোটি কোটি টাকার মালিক হতে থাকেন তিনি। অনলাইন জুয়ার আয় থেকে শুরু সম্পদ কেনা ও ব্যবসা বাণিজ্য। তবে বদরুদ্দোজা রয়েল প্রথম আটক হওয়ার পর সে পুলিশের কাছে আনোয়ার হোসেনের নাম জড়িয়ে দিলে তারপর থেকে পলাতক জীবন যাপন শুরু করে। মাঝে মধ্যে বিভিন্ন মহলকে ম্যানেজ করে এলাকায় আসেন। কাজ শেষ করে আবার আত্মগোপনে থাকেন।

আনোয়ার হোসেনের সম্পদ অনুসন্ধান করতে গিয়ে জানা গেছে, আনোয়ার হোসাইন অনলাইন জুয়া থেকে আয় করা টাকা দিয়ে ২০২১ সালের ২১ ডিসেম্বর মেহেরপুর শহরের তাহের ক্লিনিকের সামনে সড়কের (মেহেরপুর-কুষ্টিয়া সড়ক) পাশে চার কাঠা জমি কিনেছেন। যার দলিল মূল্য করা হয়েছে ৯৪ লাখ টাকা। যে জমি রেজিষ্টি করত্রে ও মহুরী খরচ লেগেছে আরো ১০ লাখ টাকা। যার দলিল নম্বর ৬৯৮২/২১।

মেহেরপুর-কুষ্টিয়া সড়কের কাটাইখানার সামনে আজিজুল হকের মেয়ে সুমনা হকের কাছে থেকে চলতি ২০২২ সালেল ১৯ জুলাই ৯ শতক জমি কিনেছেন। যার দলিল মূল্য করা হয়েছে ৪৫ লাখ টাকা। দলিল নম্বর-৪২৭০/২২।

শহরের পিয়াদা পাড়ায় সুমনা হকের ভাই রাসেল হকের কাছে থেকে ২০২২ সালের ২৮ জুন তারিখে সাড়ে ১৪ শতক জমি কিনেছেন। যার দলিল মূল্য করা হয়েছে ৪০ লাখ টাকা। যার দলিল নম্বর-৩৮৪১/২২। রেজিস্ট্রি ও মহুরী খরচ লেগেছে আরো ৬ লাখ টাকা।
২০২১ সালের ২২ জুন তারিখে ফৌজদারি পাড়ার আশরাফুল ইসলাম ও তার ভাইদের সাথে ৬ কাঠা জমি কিনেছেন। যার দলিল মূল্য করা হয়েছে ৬০লাখ টাকা। যার দলিল নম্বর-৩৫৬৬/২১।

গাংনীর গাড়াডোব গ্রামের কাঁচারি বাজারে মরিয়ম হার্ডওয়ার এন্ড ইলেকট্রনিক্স নামে চারটি দোকান নিয়ে ব্যবসা শুরু করেছেন। ধানখোলা ইউনিয়ন পরিষদ থেকে ট্রেড লাইসেন্স গ্রহণ করেছেন চলতি বছরের ১৩ অক্টোবর। চারটি দোকানের জন্য জামানাত দিয়েছেন সাড়ে ১১ লাখ টাকা। মালামাল তুলেছেন প্রায় এক কোটি টাকার। দোকানটি পরিচালনা করেন তার এক ভাইরা।

জানা গেছে, গত বছরের ২৫ আগষ্ট বদরুদ্দোজা ওরফে রয়েলকে আটক করে মেহেরপুরের সাইবার ক্রাইম বিভাগ। রয়েল সাইবার ক্রাইমের কাছে ১৫ জনকে অভিযুক্ত করে স্বীকারোক্তি দেন। ওই ১৫ জনের মধ্যে আনোয়ার হোসাইনের নামও ছিল। কিন্তু এখনো আনোয়ার হোসাইন অধরা রয়েছে।

আরো জানা গেছে, অনলাইনে জুয়া খেলা পরিচালনার জন্য (ওয়ানএক্সবিট, বেট ৩৬৫ ডটকম, প্লেবেট ৩৬৫ ডটকম, বিডিটি ১০ ডটকম, উইনস ৬৫ ডটকম ও বেটস্কোর২৪ ডটকমসহ ২৩০ টি সাইটের মাধ্যমে এই জুয়া খেলা পরিচালিত হচ্ছে। মেহেরপুর জেলার অনলাইন জুয়ার এই চক্রটির মাধ্যমে প্রতিমাসে ৩৮০ থেকে ৪০০ কোটি টাকা বিদেশে পাচার হচ্ছে। সে হিসেবে বছরে হাজার হাজার কোটি টাকার বেশি অর্থ পাচার হচ্ছে। যেটি অবৈধভাবে হুন্ডির মাধ্যমে যাচ্ছে বিদেশে।

মেহেরপুর জেলা থেকে দুই শতাধিক এজেন্ট অনলাইন জুয়া সাইটের মাধ্যমে রাশিয়াসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পাচার করছেন প্রায় ৪০০ কোটি টাকা। দেদারছে জুয়া খেলে কোটিপতি বনে যাচ্ছেন এসব এজেন্টরা। আর পথে বসছেন হাজার হাজার তরুণসহ জুয়া খেলার জড়িত ব্যক্তিরা। সঠিক নজরদারি না থাকায় অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে প্রতিদিনই কোটি টাকা পাচার হচ্ছে দেশের বাহিরে। এতে রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ক্ষতির পাশাপাশি বিপথে যাচ্ছেন তরুণ ও যুবকরা।

এ ব্যাপারে অনলাইন জুয়ার এজেন্ট আনোয়ার হোসাইন অভিযোগ স্বীকার করে বলেন, অভাবের তাড়নায় এ জুয়া খেলা শুরু করেছিলাম। একসময় খেলেছি, অনেক টাকা আয়ও করেছি। কিন্তু এখন এ কাজের সাথে জড়িত নয়।
তবে মেহেরপুর প্রতিদিনের অনুসন্ধানে এখনো তার জড়িত থাকার তথ্য রয়েছে।

মেহেরপুরের পুলিশ সুপার রাফিউল আলম, পিপিএম (সেবা), সম্প্রতি বলেছেন, আইন শৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশ কাজ করে যাচ্ছে। অনলাইন জুয়া নিয়েও পুলিশ কাজ করছে। ইতোমধ্যে অর্ধশত অনলাইন জুয়াড়িকে আটক করা হয়েছে। সংশ্লিষ্টতা পেলে কেউ ছাড় পাবে না।
(আনোয়ার হোসেনের বাকি তথ্য নিয়ে আরেকটি পর্বে বিস্তারিত প্রকাশ করা হবে। )