বিশ্বব্যাপী মহাসংকটে অর্থনীতিতে ঘুরে দাঁড়িয়েছে দেশ

ইতিহাসের কঠিনতম একটি বছর পার করল বাংলাদেশের অর্থনীতি। মহামারী করোনাভাইরাসের ছোবলে অর্থনীতির এমন কোনো খাত নেই যেটি আক্রান্ত হয়নি। এমনকি সে ধাক্কা কাটিয়ে ওঠার আগেই আবার নতুন করে করোনা সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ লেগেছে। গত মার্চ থেকে মে সময়ে কৃষি আর জরুরি খাদ্যপণ্য বাদে প্রায় সব ধরনের উৎপাদন বন্ধ ছিল টানা দুই মাসের বেশি। অথচ অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তিই হলো উৎপাদন। মাসের পর মাস কলকারখানায় ঝুলেছে তালা। খোলেনি মার্কেটের প্রধান ফটক। দোকানপাটের শাটারও ওঠেনি। কর্মীরা ছিলেন দিশাহারা। কর্মহীন হয়ে পড়েন জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক। পরিবহন খাতের চাকাও ঘোরেনি। ইঞ্জিন বন্ধ ছিল লঞ্চ, বিমান, হেলিকপ্টারসহ সব ধরনের যানবাহনের। সরকারিন্ডবেসরকারি অফিসেও ছুটিন্ডঅর্ধছুটি ঘোষণা করা হয় মহামারীর সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে। পরবর্তী সময়ে প্রায় শতভাগ অফিশিয়াল কার্যক্রম চলে আসে অনলাইনে, যার কিছু অংশ এখনো বিদ্যমান। ফলে মানুষ ছিল ঘরবন্দী। এমন রুদ্ধশ্বাস নিয়েই প্রায় পুরো একটি বছর পার করেছে দেশের অর্থনীতি।
করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে বিশ্ব অর্থনীতিও স্মরণকালের ভয়াবহ রকমের সংকটময় একটি বছর পার করল। দুন্ডএকটি বাদে বিশ্বের প্রায় সব দেশই নেতিবাচক প্রবৃদ্ধিতে চলে গেছে করোনার ধাক্কায়। বাংলাদেশের অর্থনীতিও বছরের শুরুতে থমকে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু সব শ্রেণির মানুষের কর্মস্পৃহা ও সরকারের চেষ্টায় দ্রুততম সময়েই আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে দেশের অর্থনীতি। তাৎক্ষণিকভাবে ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজগুলোর বাস্তবায়নে দ্রুত সংকট সামলে নেয় সামষ্টিক অর্থনীতি। ফলে মহামারীতেও ৫ শতাংশের ওপরে প্রবৃদ্ধি পেয়েছে বাংলাদেশ। তবে আইএমএফ বলছে, ডিসেম্বর শেষে প্রবৃদ্ধি হতে পারে ৩ দশমিক ৮ শতাংশ, যদিও কর্মসংস্থান ও বিনিয়োগের পথ এখনো রুদ্ধ। দ্রুত বাড়ছে বেকার ও দারিদ্র্যের হার। নতুন কর্মসংস্থান প্রায় বন্ধ। বিদেশেও নতুন করে যাচ্ছে না কোনো কর্মী। তবে প্রবাসী আয়ের ক্ষেত্রে বছরের শুরুতে ভাটা পড়লেই পরবর্তী সময়ে তা আবার ঘুরে দাঁড়ায়। ফলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে নতুন নতুন রেকর্ড হয়েছে সংকট সত্ত্বেও। ইতিহাসের সর্বোচ্চ রেকর্ড ৪২ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছে রিজার্ভ।
তবে বিশ্বব্যাপী এ মহাসংকট সত্ত্বেও স্বল্প সময়েই ঘুরে দাঁড়িয়েছে দেশের অর্থনীতি, যদিও এ সময়ের মধ্যে দ্বিগুণ হয়ে গেছে দারিদ্র্যের হার। প্রায় ৭৫ শতাংশ মানুষের আয় কমে গেছে। শিল্প খাতে নেমে এসেছিল স্থবিরতা। বড় বড় শিল্পের মালিক থেকে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা এখনো ধাক্কা সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন। পাশাপাশি ধস নেমেছে বিদেশি বিনিয়োগ নিবন্ধনে। কর্মহীন হয়ে পড়েছে বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠী। বিদেশফেরত কর্মীদের নিয়েও দিশাহারা সরকার। বছরের শুরুতে বিশ্ব অর্থনীতি নিয়ে ভয়াবহ সংকটের আভাস দেয় বিশ্বব্যাংক, আইএমএফসহ বিভিন্ন সংস্থা। তবে এশিয়াসহ বিশ্বের অনেক উন্নত দেশের তুলনায় অভাবনীয় সফলতার সঙ্গে করোনা মোকাবিলা করেছে বাংলাদেশের অর্থনীতি। অনেক উন্নত দেশে লাখ লাখ মানুষ বেকার হয়েছে। চাকরি হারানোর ঝুঁকিতে পড়ে প্রায় ৩ দশমিক ৫ কাটি মানুষ। পরিস্থিতি সামাল দিতে দেশের ব্যাংকন্ডবীমাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কমানো হয় কর্মীদের বেতন। কোথাও কোথাও চলে গণছাঁটাই। গণমাধ্যম ও রপ্তানি খাতও বাদ যায়নি এমন পরিস্থিতি থেকে। তৈরি পোশাক খাতের কয়েক বিলিয়ন ডলারের অর্ডার স্থগিত/বাতিল হলেও স্বল্প সময়ের মধ্যে সেগুলো আবার ফিরে পায় বাংলাদেশ। ফলে দ্রুত অর্থনৈতিক সংকট কাটিয়ে ওঠার লড়াইয়ে অনেকে শক্তিশালী দেশের তুলনায় এগিয়েই রয়েছে উন্নয়নশীল বাংলাদেশ।
বিশেষজ্ঞদের মতে এ দেশের মানুষের চাহিদার বেশির ভাগই মেটানো হয় অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে। আর বিশ্ব পরিমন্ডলে বাংলাদেশের কৃষির অবস্থান খুবই শক্তিশালী। ফলে মহাসংকট সত্ত্বেও বাংলাদেশে খাদ্য ঘাটতি হয়নি। না খেয়ে থাকেনি কোনো মানুষ। হয়তো প্রয়োজনের চেয়ে কম খেয়েছে। এর আগের বছর ২০১৯ সালের শুরুটা ছিল দেশের অর্থনীতির জন্য খুবই স্বস্তিদায়ক। কেননা সে সময় টানা ১১ বছর ধরে একই মতাদর্শের সরকার দেশ শাসন করায় উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর কাজ হয়ে আসছিল বেশ দ্রুতগতিতে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিও ছিল উচ্চ। মাথাপিছু আয়ও দ্বিগুণের বেশি হয়েছিল। কিন্তু অনিয়মন্ডদুর্নীতি আর বিশ্বমন্দার বাড়তি মাত্রা যোগ হওয়ায় সে বছরের শেষ দিকে এসে দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলা সামষ্টিক অর্থনীতি আচমকা হোঁচট খেয়ে বসে। এর সঙ্গে যুক্ত হয় চলতি বছরের শুরু থেকেই চলে আসা করোনা মহামারীর প্রচন্ড ধাক্কা। এক ধাক্কায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে সামগ্রিক অর্থনীতি, যার রেশ এখনো শেষ হয়নি। বরং প্রথম ঢেউয়ের ধাক্কা পুরোপুরি কেটে ওঠার আগেই শুরু হয়েছে দ্বিতীয় ঢেউয়ের ধাক্কা। ফলে একমাত্র প্রবাসী আয় ছাড়া এখন পর্যন্ত দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির সব প্রধান সূচক নেতিবাচক ধারায় রয়েছে। এর ফলে সামনের দিনগুলোয় অর্থনীতির গতিবিধি কী হতে পারে তা অনুুমান করাটাও মুশকিল বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ও বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে প্রায় টানা এক দশক ধারাবাহিকভাবে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে দেশ। ২০০৯ সালে ৫ শতাংশের বৃত্ত ভেঙে ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের মধ্য দিয়ে নতুন এক অধ্যায় শুরু করে বাংলাদেশ। সব শেষ ২০১৮ন্ড১৯ অর্থবছরে ৮ দশমিক ১৫ শতাংশ অর্জিত হয়েছে। এরপর করোনা মহামরীতে বিশ্বের প্রায় সব দেশই নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি পেলেও বাংলাদেশ ৫ দশমিক ২৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করে। আর চলতি অর্থবছর শেষে বাজেটের টার্গেট অনুযায়ী ৮ দশমিক ২ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হবে বলে আশা করা হচ্ছে। ২০২২ সালের আগেই ডবল ডিজিট (২ অঙ্ক) প্রবৃদ্ধি অর্জিত হবে বলে আশা করা হচ্ছে। একইভাবে ২০০৯ সালে মাথাপিছু আয় ছিল ৭০৯ মার্কিন ডলার। এখন তা ১৯০০ ডলার অতিক্রম করেছে। সে সময় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ১০ বিলিয়ন ডলার। এখন তা ৪২ বিলিয়ন অতিক্রম করেছে। রপ্তানি ছিল ১০ বিলিয়ন ডলার। ২০১৯ সালে তা ৩৫ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। আগামীতে ৫০ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি আয়ের স্বপ্ন দেখছে বাংলাদেশ। স্থায়ী কর্মসংস্থানে খুব একটা আশানুরূপ প্রবৃদ্ধি না হলেও অস্থায়ী কর্মসংস্থান, বিকল্প কর্মসংস্থান এবং কর্মমুখী শিক্ষার প্রসারের মাধ্যমে কর্মক্ষম মানুষ আর শ্রমশক্তিকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করেছে সরকার। কিন্তু করোনা মহামারী এসে এসব অর্জনে প্রচন্ড আঘাত হানে। ফলে ২০২০ সালে বহুসংখ্যক মানুষ বেকার হয়। দেশে দারিদ্র্যও বাড়ে দ্বিগুণ হারে। এ বছর ৭৫ থেকে ৮০ ভাগ মানুষের আয় কমে গেছে, যার একটা বড় নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে সামষ্টিক অর্থনীতির ওপর। এদিকে আসন্ন দিনগুলোও দেশ ও বৈশ্বিক অর্থনীতির জন্য হবে কঠিন চ্যালেঞ্জের। বাংলাদেশসহ বিশ্বের প্রায় সব দেশে অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম থেমে গেছে। একই সঙ্গে পরিবহন, পর্যটন, হোটেল, মোটেল, বিশ্ব চিত্রজগৎ, বিনোদন কেন্দ্রসহ সব ধরনের ব্যবসান্ডবাণিজ্য স্থবির হয়ে পড়েছে। বিপুল লোকসানের মুখে পড়ে বহু কোম্পানি বন্ধ হয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হচ্ছে। বিশ্বব্যাপী মহামারী রূপ নেওয়া প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের সংক্রমণ কতটা দীর্ঘায়িত হবে এর ওপর নির্ভর করছে অর্থনীতির ক্ষতির বিষয়টা। ইতিমধ্যে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) বলেছে, করোনাভাইরাসের প্রভাবে বিশ্বব্যাপী অন্তত আড়াই কোটি মানুষ চাকরি হারাবে। আর বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (ডব্লিউটিও) বলছে, ২০০৮ন্ড২০০৯ সালের বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দাকেও হার মানাবে এবারের করোনাভাইরাসের আর্থিক ক্ষতি। অন্যদিকে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ সব সদস্য দেশকে এ বিষয়ে সতর্ক করেছে। সংস্থা দুটি বলেছে, বিশ্ববাণিজ্য থমকে গেছে।
সম্প্রতি এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) বলেছে, বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাসের প্রভাবে বাংলাদেশের অর্থনীতি মন্দার মুখে পড়তে পারে। অবস্থা খারাপের দিকে গেলে ৩০২ কোটি ১০ লাখ ডলার পর্যন্ত অর্থনৈতিক ক্ষতির মুখে পড়তে পারে বাংলাদেশ। সংশ্লিষ্টরা জানান, করোনার কারণে যে সংকট চলছে তাতে কয়েক ট্রিলিয়ন ডলার পর্যন্ত ক্ষতির মুখে পড়তে পারে বৈশ্বিক জিডিপি। কর্মস্থলে অনুপস্থিতি, উৎপাদন হ্রাস, সরবরাহ ব্যাহত হওয়ার কারণে বিনিয়োগ এবং বাণিজ্যও কমে যাচ্ছে। এ জন্য বছরজুড়েই বিনিয়োগকারীরা ছিলেন উদ্বিগ্ন।