মতিন স্যার চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন

মেহেরপুরের জনপ্রিয় শিক্ষাবিদ, ক্রীড়া সংগঠক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন আবদুল মতিন মাষ্টার। মেহেরপুরের শিক্ষা ও ক্রীড়া উন্নয়নে তিনি আজীবন অক্লান্ত পরিশ্রম করে গেছেন। দেশ-মাটির স্বাধীনতার জন্য তিনি যেমন মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েছিলেন, তেমনি তিনি দেশ স্বাধীনের পর এই মাটির ভবিষ্যৎ সন্তানদের আদর্শ নাগরিক ও ক্রীড়াঙ্গনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য সারা জীবন পরিশ্রম করে গেছেন। কাউকে খুশি করার জন্য তিনি নয়, শুধু মাত্র দেশ-মাটিকে ভালবাসার তাগিদেই তিনি এ অঞ্চলের নতুন প্রজন্মকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন। শিক্ষা উন্নয়নে অবদান রাখার জন্য তিনি পাঁচবার মেহেরপুর জেলার শ্রেষ্ঠ শিক্ষক ও একবার রাষ্ট্রপতি পদক লাভ করেন। জাতীয় পর্যায়ে সেরা শিক্ষকের সম্মাননা ছাড়াও তাঁর বড় অর্জন অগণিত শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের ভালোবাসা ও সম্মান। শিক্ষাবিদ, ক্রীড়া সংগঠক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মতিন মাষ্টারকে মেহেরপুরের সর্বস্তরের মানুষ চিরকাল শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করবে।
আমার সৌভাগ্য হয়েছিল আমি তাঁর ছাত্র ছিলাম এবং আমাদের তিনি খুব ভালবাসতেন। শেষ জীবন পর্যন্ত তাঁর সাথে আমার যোগাযোগ ছিল। মেহেরপুরে গেলে স্যারের সাথে দেখা হতো, কথা হতো। স্যারের খবর আমি সবসময় আমি রাখতাম।

মনে পড়ে মাওলানা আব্দুল হাকিম ছিলেন মেহেরপুর বি.এম. প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক। তিনি নিজ হাতে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি প্রতিষ্ঠা করেন। তখন এর নাম ছিল মক্তব স্কুল। টিনের এই মক্তব স্কুলটি পরে বি.এম. প্রাথমিক বিদ্যালয়ে রূপ নেয়।

আবদুল মতিন স্যার স্নাতক ডিগ্রী অর্জনের পর ১৯৬৬ সালে মেহেরপুর শহরে মক্তব নামে পরিচিত এই বি. এম. প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন । এই বিদ্যালয়ে প্রায় চার দশক শিক্ষকতা করে প্রধান শিক্ষক হিসেবে তিনি অবসর গ্রহণ করেন। তিনি মেহেরপুর সরকারী বিএম সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকেই চাকুরি থেকে অবসর নেন ২০০৭ সালে। ১৯৮৫, ১৯৮৭, ১৯৯৩ , ১৯৯৮ ও ১৯৯৯ সালে জেলার শ্রেষ্ঠ শিক্ষক নির্বাচিত ছাড়াও ১৯৮১ সালে গণশিক্ষায় জেলার শ্রেষ্ঠ শিক্ষক হিসেবে রাষ্ট্রপতি পদক পান। ১৯৭১ সালে ‘মুজিবনগর কর্মচারী’ ডিগ্রী লাভ করেন। মতিন স্যার এই বি. এম. প্রাথমিক স্কুলটি বেশ জনপ্রিয় করে তোলেন এবং জেলার একটি আদর্শ বিদ্যালয় হিসেবে স্বীকৃতি অর্জন করতে সক্ষম হন।

আবদুল মতিন মাষ্টার ১৯৫০ সালের ৩০ জুলাই তৎকালীন মেহেরপুর মহকুমার করিমপুর থানার বিশোরপুর গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন।

আমি ১৯৬৫ সালে মক্তব স্কুলে ভর্তি হয়েছিলাম। মাওলানা আব্দুল হাকিম স্যার ছিলেন খুব কড়া শিক্ষক। পড়া না পারলে তিনি আমাদের বেত দিয়ে খুব মারতেন। আরো ছিলেন দাশু স্যার। তিনি খুব নরম প্রকৃতির শিক্ষক ছিলেন এবং ছাত্রদের আদর করতেন। ১৯৬৬সালে মতিন স্যার এই মক্তবখানায় সহকারি শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। ছাত্রদের তিনি খুব ভালবাসতেন এবং সুন্দরভাবে বুঝাতেন। মিডিয়া ব্যক্তিত্ব সৈকত রুশদীও ছিলেন স্যারের ছাত্র। মনে পড়ে আমাদের সাথে ছিল আযম খান দীপু, পল্লব ভট্টাচার্য(তরুণ), ইকবালসহ অনেকে। আমি পরের বছর মেহেরপুর হাইস্কুলের সকালের শিফটে ক্লাস থ্রিতে ভর্তি হলাম। কিন্তু পরবর্তী পর্যায়ে মতিন স্যারের সাথে আমার যোগাযোগ ছিলেন।

মনে পড়ে আমি যখন মেহেরপুর সরকারি হাইস্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্র। তখন মতিন স্যার মেহেরপুর কিছু তরুণ ছেলেদের ফুটবল খেলা শেখানোর জন্য একত্রিত করেছিলেন। তার মধ্যে আমিও ছিলাম। তখন আমি খুব পাতলা ছিলাম। স্যার আমাদের সবাইকে খুব সকালে হাইস্কুল মাঠের পশ্চিম পাশে ঈদগাহ মাঠে (এখন স্থান মহিলা কলেজের অংশ)শরীর চর্চা করাতেন ও ফুটবল খেলা শিখাতেন। মহকুমা পর্যায়ে বড় ফুটবল খেলা হলে আমাদের ড্রেস পিরিয়ে সম্মানের সাথে খেলা দেখাতেন।

ছাত্র জীবনে দেখেছি, মতিন স্যার চমৎকার ফুটবল খেলতেন। তিনি ও রহমান স্যার ফুটবলের জগতে সেরা ছিলেন। পরবর্তী পর্যায়ে তার দুজনই রেফারী হিসেবেও বেশ নাম করেছেন। সেসময়ে মেহেরপুরে

র সেরা সেরা ফুটবল খেলাতে তিনি অত্যন্ত দক্ষতার সাথে রেফারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।

আমি যখন কলেজের ছাত্র। তখন আমরা মেহেরপুরের ছেলেমেয়েদেরকে সাহিত্য-সংস্কৃতিতে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য ধারাপাত খেলাঘর আসর প্রতিষ্ঠা করি। এই সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক ছিলাম আমি। আর মতিন স্যারকে সভাপতি করেছিলাম। তিনি অত্যন্ত আগ্রহের সাথে আমাদের সকল কার্যক্রমে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। আমাদের সাথে ছিলেন মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিন মীরু, আবদুর রাজ্জাক মাস্টার, ননী গোপাল ভট্টাচার্য, মীর রওশন আলী মনা, আমার ক্লাসমেট পল্লব ভট্টাচার্য(তরুণ), আগাহেলালী মুক্তা, তন্ময় ভট্টাচার্য, নফিজউদ্দিন খান, মানস চৌধুরীসহ অনেকে। আমরা স্যারের নেতৃত্বে বিভিন্ন জাতীয় দিবসে পাবলিক লাইব্রেবীতে অনুষ্ঠান করতাম এবং ছেলেদের নিয়ে মেহেরপুরের বিভিন্ন গ্রামে শিক্ষা সফর করতাম। সফর শেষে সফর নিয়ে রচনা প্রতিযোগিতার আয়োজন করতাম। তখন মেহেরপুরে শিশুদের সংগঠন মানেই ধারাপাত খেলাঘর আসর। জাতীয় পর্যায়েও আমরা একবার দেয়াল পত্রিকা প্রতিযোগিতায় তৃতীয় স্থান অর্জন করেছিলাম।

মনে পড়ে মতিন স্যার বিএম স্কুলে শিক্ষার্থীদের সাহিত্য ক্ষেত্রে আগ্রহী করতে নিয়মিত দেয়াল পত্রিকা প্রকাশ করতেন। তিনি প্রাক্তন ছাত্র হিসেবে আমাকে দেয়াল পত্রিকাটি নিয়মিত প্রকাশের দায়িত্ব দিয়েছিলেন।

স্যার আমাকে খুব ভালবাসতেন বলেই যে কোন ভাল কাজে আমাকে ডাকতেন। মনে পড়ে, বিএম স্কুলে তিনি গণ শিক্ষা কার্যক্রম চালু করলেন। আমাকে বললেন, তুমি এখানে শিক্ষকতা করবে। দীর্ঘদিন স্যারের কথামত সেখানে শিক্ষকতা করেছি কোন বেতন ছাড়াই। তবে

সম্মান পেতাম রাস্তাঘাটে। স্কুলের বয়স্ক ছাত্ররা রাস্তায় স্যার স্যার করতেন, তখন ভালই লাগতো।

তিনি ছিলেন মেহেরপুরের একজন সম্মানী মানুষ। তিনি সারা জীবনে ইসলাম ধর্মের সকল নিয়ম-কানুন পুরাপুরি মেনে চলেছেন। সর্বস্তরের মানুষ তাঁকে সম্মান করতো।আমার সৌভাগ্য হয়েছে এই গুণী মানুষটিকে পদক দিয়ে সম্মান জানানো।

গত ১৫ মে ‘১৫ শুক্রবার সন্ধ্যা ৬টায় মেহেরপুর জেলা শিল্পকলা একাডেমীতে এই গুণী সংবর্ধনা অনুষ্ঠিত হয়। আয়োজনে ছিলো আমার গ্রেটার কুষ্টিয়া নিউজ ও মেহেরপুরের শিকড় পরিবার । অনুষ্ঠানে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ আব্দুল মতিন স্যারের সাথে আরো যারা পদক পান তারা হলেন বিশিষ্ট সাংবাদিক ও কবি দৈনিক বাংলাদেশ বার্তার সম্পাদক আবদুর রশীদ চৌধরী, বিশিষ্ট গবেষক ও শিক্ষাবিদ ড. মুহাম্মদ ফজলুল হক, বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক অধ্যাপক হাবিব আনিসুর রহমান, বিশিষ্ট গবেষক ও শিক্ষাবিদ অধ্যক্ষ হামিদুল হক মুন্সী, বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক, কবি ও শিক্ষাবিদ রফিকুর রশীদ, বিশিষ্ট চিকিৎসক আবদুস শহীদ, বিশিষ্ট সাংবাদিক ও দৈনিক মাথাভাঙ্গার সম্পাদক সরদার আল-আমিন ও বিশিষ্ট ক্রীড়া সংগঠক আব্দুর রহমান।

পরিশেষে প্রার্থনা করি, আল্লাহ যেন মেহেরপুরের সর্বজন শ্রদ্ধেয় আবদুল মতিন স্যারের রূহকে জান্নাতুল ফেরদৌসে চিরশান্তি

প্রদান করেন। তাঁর পরিবারের সকল সদস্য, বন্ধুবান্ধব ও ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য রইলো আন্তরিক সমবেদনা।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিষ্ট ও সম্পাদক গ্রেটার কুষ্টিয়া নিউজ