মুজিবনগরই বাংলাদেশের প্রথম রাজধানী

ঢাকা বাংলাদেশের রাজধানী। প্রথম রাজধানী ছিল মুজিবনগর। এ নিয়ে ভিন্নমত থাকার কথা নয়। যদিও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ কোন কোন অতি উৎসাহী পক্ষ প্রকৃত ইতিহাস কে অস্বীকার করে নিজেদের অনুকূলে নেয়ার অপচেষ্টা করছেন।

তাঁদের প্রতিশ্রদ্ধা রেখেই জানাতে চাই ——–

১। পাকিস্তানের নির্বাচনে সংখ্যা গরিষ্ঠতা অর্জনকারী দল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদের রেকর্ড করা এক বেতার ভাষণ শিলিগুড়ির এক বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের প্রথম সরকার গঠনের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেওয়া হয় ১১ এপ্রিল ১৯৭১ সালে।

মুক্তাঞ্চল তদানীন্তন মেহেরপুর মহকুমার বাগোয়ান ইউনিয়নের বৈদ্যনাথতলা গ্রামের বিশাল আম বাগানে ১৭ এপ্রিল উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি করে মন্ত্রীসভা শপথ গ্রহণ করেন। পৃথিবীর বুকে বাংলাদেশ নামে একটি নতুন রাষ্ট্রের আনুষ্ঠানিক অভ্যুদয় হয়।

প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের ১১ এপ্রিলের প্রথম বেতার বক্তৃতাকে বৈধ সরকার গঠণের সাথে সামঞ্জস্য পূর্ণ করার জন্য স্বাধীনতা আদেশ ঘোষণার তারিখ ১০ এপ্রিল ১৯৭১ বলে পরবর্তীতে ঘোষণা করা হয়।

প্রথম সরকারের শপথের স্থান বৈদ্যনাথতলা গ্রামের নতুন নাম করণ করা হয় নতুন রাষ্ট্রের প্রথম রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে ‘মুজিবনগর’। আর মুজিবনগর কে নতুন রাষ্ট্রের রাজধানী ঘোষণা করে নতুন সরকার। সেই ঘোষণা অনুসারে বাংলাদেশের প্রথম সরকারের সকল দলিল, নথি, প্রকাশনা ও সম্প্রচারে রাষ্ট্রের রাজধানীর নাম মুজিবনগর হিসাবে উল্লেখ করা শুরু হয়।

যুদ্ধকালীন সময়ে বাংলাদেশ, ভারত ও অপর বহু রাষ্ট্রের সরকারী দলিল-দস্তাবেজে এবং দেশ বিদেশের গণ মাধ্যমে মুজিবনগর কে বাংলাদেশ সরকারের রাজধানী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। সে কারণে অনেক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রথম সরকার কে ‘মুজিবনগর সরকার’ হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে।

২। মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলা কে মুজিবনগর হিসেবে নাম করণ করে রাজধানী ঘোষণার আগে, বাংলাদেশের প্রথম সরকার অপর কোন শহর, গ্রাম বা স্থানকে কখনোই রাজধানী ঘোষণা করেনি। পার্শ্ববর্তী চুয়াডাঙ্গা বা কুষ্টিয়া কেও নয়।

৩। ২৫ মার্চ রাতে নীরিহ বাঙালিদের উপর পাকিস্তানী সরকার ও সশস্ত্র বাহিনীর ঘৃণ্য আক্রমণের পর তাৎক্ষণিক প্রতিরোধ যুদ্ধের একটি উল্লেখ যোগ্য ঘাঁটি ছিল চুয়াডাঙ্গা। আমাদের মনে আছে এত দঞ্চলে প্রথম প্রতিরোধ যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল কুষ্টিয়াতে এবং সে যুদ্ধ পরিচালিত হয়েছিল চুয়াডাঙ্গা ও মেহেরপুর থেকে।

স্থানীয় রাজনৈতিক, সামরিক ও প্রশাসনিক শীর্ষ ব্যক্তিদের নেতৃত্বে প্রায় তিন সপ্তাহ চুয়াডাঙ্গা পাকিস্তান থেকে বিছিন্ন ও মুক্ত ছিল। স্থানীয় নেতৃত্বের সমন্বয়ে গঠিত কমিটির নির্দেশনায় প্রশাসন পরিচালিত হয়েছে মুক্তাঞ্চল চুয়াডাঙ্গায়। যেমন টি হয়েছিল মেহেরপুর ও টাঙ্গাইল সহ দেশের অপর কয়েক টি স্থানে। স্বাধীনতা যুদ্ধে চুয়াডাঙ্গার ঐতিহাসিক অবদান স্বীকার করতে কোন দ্বিধা নাই।

৪। তবে বাংলাদেশের প্রথম সরকার গঠণের আগে সরকার ছাড়া স্থানীয় ভাবে কোন স্থানকে রাজধানী ঘোষণা করা হয়ে থাকলে তা বৈধ বলে স্বীকৃত হওয়ার কোন সুযোগ নেই। কেননা সরকার ছাড়া যুদ্ধের কোন রাজনৈতিক বা সামরিক নেতা বা অপর কেউ কোন স্থান কে যদি রাজধানী ঘোষণা করেও থাকেন তাহলে সেই স্থানটি রাজধানী হয়ে যায় না।

৫। বাংদেশের প্রথম রাজধানী মুজিননগর। পরবর্তী রাজধানী ঢাকা। এর মধ্যে কোন বিতর্ক নেই, থাকতে পারে না। আমাদের সকলেরই জানা আছে যে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালিন সময়ে যাঁরা বাংলাদেশ সরকারের অধীনে কর্মরত ছিলেন তাঁদের মুজিবনগর সরকারের কর্মচারী হিসাবে বিবেচনা করা হয়েছে এবং চাকুরী কালিন সব সুযোগ সুবিধা দেয়া হয়েছে।

৬। প্রসঙ্গতঃ বলা যায়, ধরা যাক একটি ফুটবল টুর্ণামেন্ট চলছিল এবং ফাইনাল খেলা পড়ে মেহেরপুর জেলার সাথে পার্শ্ববর্তী জেলা চুয়াডাঙ্গার। কিন্তু কোন কারণ বশতঃ সে খেলাটি অনুষ্ঠিত হয় নি। তাই বলে কি চুয়াডাঙ্গা জেলা দাবী করতে পারবে যে তারা ফুটবল খেলায় বিজয়ী জেলা?

সুতরাং আসুন আমরা ইতিহাস স্বীকৃত বিষয় টি নিয়ে কোন বিতর্কে না যেয়ে সহজ ভাবে মানতে শিখি মুজিবনগরই হলো বাংলাদেশের প্রথম রাজধানী।

লেখকঃ সাংবাদিক জি টিভি, দৈনিক সংবাদ, ডেইলি অবজারভার।

মেপ্র/আরপি