মুজিবনগর সংগ্রাম কমিটির সভাপতি এখনো পাননি মুক্তিযোদ্ধা সনদ

মোমিন চৌধুরী মেহেরপুরের মুজিবনগর উপজেলার ভবেরপাড়া গ্রামের উজ্জল নক্ষত্রের নাম। ১৯৭১ সালের প্রথম অস্থায়ী সরকার গঠন হওয়ার সময় মুক্তিযুদ্ধকালীন মুজিবনগর সংগ্রাম কমিটির সভাপতি। মুজিবনগর দিবস সহ মুক্তিযুদ্ধের সাক্ষী হয়ে ৮০ পেরিয়েছেন।

স্বাধীনতার সূতিকাগার মুজিবনগর ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে মেহেরপুর প্রতিদিন কে দেওয়া বিশেষ সাক্ষাতকার-

মে.প্র: আপনি কেমন আছেন?
মোমিন চৌধুরী: আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। তবে বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে একটু আতঙ্কে আছি। সেই সাথে আফসোস হচ্ছে করোনা পরিস্থিতে এবার মুজিবনগর দিবসে অনাড়াম্বের কারনে।

মে.প্র: সংগ্রাম কমিটি গঠন সম্পর্কে কিছু বলেন?
মোমিন চৌধুরী: ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষনের পর আওয়ামীলীগের নেতৃত্বে ১০/১১ মার্চ ১৯৭১ তারিখে মরহুম ছহি উদ্দিনের অনুমতি নিয়ে ভবরপাড়া গ্রামে আমরা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করি। এদিকে সংগ্রাম পরিষদ গঠন করার পর মার্চ মাসে বর্ডারের অবস্থা সেরকম ভয়াভহ না থাকায় ইন্ডিয়া থেকে লোকজন আসতো। একই সাথে যুদ্ধ হচ্ছিলো। ইন্ডিয়া থেকে কিছু ঔষধপত্র, গোলাবারুদ এগুলো কিছু মানুষ এসে আমাদের অফিসে দিয়ে যেত। পরে ওগুলো আমরা আমাদের অফিস থেকে মেহেরপুর অফিসে পৌছায়ে দিতাম। এরপর ২৬ই মার্চ ইপিআর ক্যাম্পে থাকা পাকিস্থানের পতাকা নামিয়ে আমরা বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করি। পতাকা তোলার পর ২৮ই মার্চ থেকে ইপিআরক্যাস্প এখান থেকে চলে যায় চুয়াডাঙ্গাতে। ক্যাম্প চলে যাওয়ার পর আনসার সদস্যরা এখানে থাকে । আমরা তাদের খাওয়া-দাওয়ার ব্যাবস্থা করে দিই।

মে.প্র: ১৭ই এপ্রিলের আগের কিছু ঘটনা বলেন?
মোমিন চৌধুরী: ১৫ এপ্রিল আনুমানিক বিকাল ৪টা। আমি আর আমার সহকারী সুশিল মল্লিক বৈদ্যনাথতলা রাস্তায় ঘোরাফেরা করার সময় হঠাৎ ইন্ডিয়া থেকে দুইজন লোক এসে রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে আমাদের কাছে জিজ্ঞাসা করলো তোমরা কারা? তখন আমরা বললাম আমরা সংগ্রাম পরিষদের লোক, ভারত থেকে আসা বিভিন্ন সামগ্রী আসলে সেগুলো আমরা নিয়ে ক্যাম্পে পৌছায়ে দিই। পরে তিনারা আমাদের নাম জানতে চাইলে আমরা নাম বলে দিই। তারপর তারা বললেন, তোমাদের এখানে বৈদ্যনাথতলা কোথায় আছে।

তখন আমরা বলললাম বৈদ্যনাথতলা তো এইটা। তখন তারা বৈদ্যনাথতলার বাগান দেখতে চাইলে আমরা তাদের বাগান দেখাইয়ে দিলাম। এমন সময় তাদের ভিতর থেকে শুশিল কুমার নামের একজন লোক পরিচয় করায় দিলো ক্যাপ্টেন মুনসুর নামের সেনা সদস্যের সাথে। তারপর তারা আমাদেরকে বললো এখানে একটা ছোট সভা হবে। আপনারা জায়গাটা একটু পরিষ্কার করে কিছু দেবদারু গাছের পাতার একটা গেট ও কিছু চৌকি দিয়ে একটি স্টেজ তৈরি করে দিয়েন। তারপর তারা আমাদের এখানে ইপিআর ক্যাম্পে থাকলো। আমরা তাদের কথামত ১৬ এপ্রিল একটা গেট ও স্টেজ তৈরি করে ফেললাম। গেটের একপাশে লিখে দিলাম ওয়েলকাম ও আরেকপাশে লিখে দিলাম স্বাগতম।

মে.প্র: আপনার দেখা প্রথম ১৭ই এপ্রিল সম্পর্কে কিছু বলেন?
মোমিন চৌধুরী: মুজিবনগরে ইপিআর নামের একটি ক্যাম্প ছিলো। সংগ্রাম কমিটি গঠনের পর সেই ক্যাম্পে আনসার সদস্যরা থাকতো। তাদের সাথে আমরাও থাকতাম। ইন্ডিয়ায় থেকে যেসব মালামাল আসতো সেগুলো আমরা মেহেরপুর অফিসে পৌছায়ে দিতাম।
সে দিন ছিল ১৭ই এপ্রিল ভোর রাত। আমরা সকলে একসাথে বসে আছি। হঠাৎ দেখি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহম্মেদ , মুস্তাক আহম্মেদ, ইউসুফ আলী, কর্নেল এম এ জি উসমানীসহ কয়েকজন মানুষ মুজিবনগরে আসেন।

এদিকে ১৭ ই এপ্রিল সভা করার জন্য সকল ব্যাবস্থা সম্পন্ন। সবাই তখন মঞ্চে উপস্থিত হল। এসময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি ও সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপ-রাষ্ট্রপতি এবং তাজউদ্দীন আহমদ কে প্রধানমন্ত্রী করে সরকার গঠন করা হয়। এছাড়াও ক্যাপ্টেন এম মুনসুর আলীকে অর্থ, শিল্প ও বানিজ্য মন্ত্রনালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়। এ এইচ কামরুজ্জামান কে স্বরাষ্ট্র, ত্রাণ, পুনর্বাসন ও কৃষি মন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয়। বাংলার মীর জাফর নামে পরিচিত খন্দকার মুস্তাককে দেওয়া পররাষ্ট্র মন্ত্রীর দায়িত্ব।

হাজার হাজার উপস্থিত জনগনের সামনে ইউসুফ আলী প্রথম অস্থায়ী সরকারের শপথ বাক্য পাঠ করান। সভা শেষ করার পর যখন তারা চলে যাবে এমন সময় আমাদের কয়েকজন আনসার সদস্যরা গার্ড অব অনার প্রদান করে তাদের বিদায় দেয়।

মে.প্র: তৎকালিন সময়ে মেহেরপুরের আর কোন কোন নেতাকর্মী সেখানে ছিল? আপনার জানা আছে কি না?
মোমিন চৌধুরী: মেহেরপুরে বর্তমানে যারা রাজনিতি করছে তাদের ভিতর ঐ সময় কেউই উপস্থিত ছিলো না।

মে.প্র: নিজের সম্পর্কে কিছু বলেন?

মোমিন চৌধুরী: নিজের সম্পর্কে বলার কিছু নেই। স্বাধিনতার এতো বছর পরেও মুক্তিযোদ্ধার খাতায় আমার নাম নেই। মুক্তিযোদ্ধার জন্য দরখাস্ত করেছি। শুনেছি নাকি যাচাই- বাছাই পর্যায়ে আছে। জানিনা কি করলে নাম উঠবে। হয়তো এ জন্মে আর হবে না।

তবে আমার নিজের কাছে এই ভেবে ভালো লাগে দেশের স্বাধিনতার জন্য একটু হলেও আমি মোমিন চৌধুরী কাজ করেছি। এটাই আমার কাছে বড় পাওনা। ৮২ বছর পার করে ফেলেছি ,হয়তো আর কিছু সময়..। ২ ছেলে ৩ মেয়েকে নিয়েই ভালোই যাচ্ছে সময়।