মেহেরপুরের বিস্তীর্ণ সবজির মাঠে তামাকের বীজতলা

‘সবজির থেকে কি তামাকের পুষ্টিগুণ (অর্থনৈতিক বিবেচনায়) বেশি? এমন প্রশ্ন যদি কিছু লোভী চাষীদের করেন তাহলে উত্তর আসবে হ্যাঁ। আর এসকল চাষীদের আরো প্রলোভন দিয়ে প্রণোদনার মাধ্যমে সবজির জমিতে তামাক চাষ করিয়ে নিচ্ছেন তামাক কোম্পানীগুলো।

সবজির ভান্ডার খ্যাত মেহেরপুর জেলার বিস্তীর্ণ সব্জীর মাঠে এখন চলছে তামাকের বীজতলা প্রস্তুতের কাজ। মেহেরপুর জেলা জুড়ে এখন প্রস্তুতি নিচ্ছেন এই তামাক চাষের। মাঠের পর মাঠ এখন ছেয়ে গেছে মাদকের সিঁড়ি তামাকের বীজতলাতে। অথচ আজ থেকে ১০ বছর আগেও এ চিত্র দেখা যেত না।

অথচ তামাক চাষে জমির উর্বরতা কমে, চাষীদের শারিরীক ক্ষতির পরিমাণ কোন অবস্থায় যায় তার কোন হিসেবে তারা বোঝে না।

স্থানীয় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও জেলা প্রশাসনের নাকের ডগায় এগুলো করলেও তারা রয়েছে দর্শকের ভূমিকায়। আর প্রশাসনের নির্লিপ্ততাই বৃটিশ আমেরিকান টোব্যাকো ও জাপান টোব্যাকো কোম্পানি চাষিদের বীজ, সার বিষ ও কীটনাশক লোন দিয়ে তামাক চাষে বাড়তি সুবিধা দিচ্ছেন।

কৃষি বিভাগ ও জেলা প্রশাসনের নজরদারি না থাকায় জেলা থেকে দিন দিন অর্থকারী ফসল চাষ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন কৃষকরা। ফলে হুমকির মুখে পড়ছে খাদ্য শষ্য উৎপাদন।

কৃষকরা বলছেন বেশি লাভের বাড়তি আশার সঙ্গে বাজারজাতের নিশ্চয়তায় তামাক চাষ করছেন চাষিরা। জেনে শুনে বিষ চাষের এই চিত্র শুধু মেহেরপুর জেলাতে নয়। মেহেরপুর জেলার পাশাপাশি কুষ্টিয়া ও চুয়াডাঙ্গাতেও, প্রতি বছরে বাড়ছে তামাকের চাষ।
সচেতন মহলের মতে তামাক চাষের ক্ষেত্রে আইনের প্রয়োগ না থাকায় কৃষকদের মাঝে সচেতনতার বালাই নেই। এই চাষ বন্ধে এখনই কার্যকরী উদ্যোগ গ্রহণ করতে না পারলে আগামী দিনে খাদ্য শষ্য ভান্ডার খ্যাত জেলা মেহেরপুর থেকে শাকসব্জী ও খাদ্য শষ্য উৎপাদন কমে যাবে।

জেলার কৃষকদের উৎপাদিত ধান, আলুসহ কৃষি ফসলের ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় তারা হতাশা। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে বিনামূল্যে তামাকের বীজ কৃষকদের হাতে তুলে দিচ্ছেন তামাকের কোম্পানির প্রতিনিধিরা।

মেহেরপুর জেলাতে জাপান টোব্যাকো ও বৃটিশ আমেরিকান টোব্যাকো কোম্পানির অগ্রিম ঋণে সার ও নগদ অর্থ দিয়ে থাকেন এবং ক্রয়ের শতভাগ নিশ্চিয়তা দেয়।

সরজমিনে দেখা গেছে, সদর উপজেলার মনোহরপুর, উজুলপুর. গাঁড়াবাড়িয়া, কাথুলি, সহগোলপুর, কালিগাংনী, নওপাড়া, মাইলমারি, ধলা.গাংনী উপজেলার রামকৃষ্ণপুর ধলা, ভাটপাড়া, সাহারবাটি, ধর্মচাকী, ভোমরদহ, ভরাট, দূর্লভপুর এলাকার বিস্তীর্ণ সব্জী ফসলের ক্ষেতের সমারোহ। অথচ, এই সব্জী ক্ষেতের সাথেই চলছে তামাকের বীজতলার কাজ।সব্জী ক্ষেতের মাঝেই উকি দিচ্ছে বিষাক্ত নিকোটিনের বীষবাস্প।

তামাক চাষে সরকারিভাবে কৃষকদের নিরুৎসাহিত করার কথা থাকলেও জেলা জুড়ে কৃষকরা নিচ্ছেন তামাক চাষের প্রস্তুতি। তামাক চাষেরে এই আগ্রাসনের প্রস্তুতি চলছে গোটা জেলা জুড়েই।

মোনাহারপুর গ্রামের তামাক চাষী নওশাদ বলেন, আমি ১০ কাঠা জমিতে তামাকের বীজতলা তৈরী করছি। এই ১০ কাঠা জমির বীজতলা থেকে ১০০ বিঘা জমিতে তামাক লাগানো যাবে।

উজুলপুর গ্রামের রাজিবুল ইসলাম বলেন, সারা বছর তো শস্যের আবাদ করি। দামের বেলায় পুঁজি বাঁচানোর চিন্তায় থাকতে হয়। অথচ, তামাক চাষের মধ্যে ওই টেনশন নেই। কোম্পানি থেকে বাড়তি সুবিধা পাওয়া যায়। আবার নিশ্চিত লাভও হয়।

কুলবাড়িয়া গ্রামের তামাক চাষী সোহেল রানা জানান, অন্যান্য ফসলের থেকে তামাক চাষে লাভ বেশি তাই করি। এবছরও করছি।
তামাক চাষে ক্ষতি হয়। তারপরেও কৃষকরা এই আবাদে ঝুঁকছেন। আমরা তামাক কোম্পানি থেকে লোন সুবিধার পাশাপাশি বীজ ও সার পাচ্ছি।বাজারজাত নিয়েও চিন্তা থাকে না।

হিসেব মতে, মেহেরপুর জেলায় প্রতি বছর প্রায় ১৫ হাজার হেক্টর জমিতে তামাক চাষ হয়ে থাকে। তবে, তামাক আবাদের ব্যাপারে কৃষি বিভাগের কাছে এই চাষের কোনো তথ্য থাকেনা। তাদের পক্ষ থেকে তামাক চাষে নিরুৎসাহিত করার কথা থাকলেও তারা সেটা করেনা।
গতকাল মঙ্গলবার (২০ সেপ্টেম্বর) সরেজমিনে জেলা সদরের গ্রামে এলাকায় দেখা যায় জমির উপরে নেট ও চারপাশে নেট দিয়ে ঘীরে তামাক ক্ষেতের বীজতলা তৈরী করছেন।

বৃটিশ আমেরিকান টোব্যাকো কোম্পানীর প্রতিনিধি মাহাত্বা উদ্দীন কৃষকদের বিভিন্নভাবে পরামর্শ দিচ্ছেন।

তামাকের বেড তৈরীর আগে কিভাবে সেচ প্রদান করতে হয় সেটা শিক্ষা দিচ্ছেন। এলাকার কৃষকরা ব্যস্ত সময় পার করছেন তামাকের বীজতলা তৈরীতে। তাদের তামাক বীজ তলা তৈরীর নীবিড় পরিচর্যা দেখে মনে হচ্ছে তাদের মধ্যে তামাক আবাদের উৎসব শুরু হয়েছে।
তামাক কোম্পানীর সুপারভাইজার ও কর্মকর্তারা প্রতিনিয়ত তামাক চাষীদের খোঁজ খবর রেখে সহযোগীতা করে আসছেন বলে জানালেন চাষীরা।

জেলা সদরের উজুলপুর, মনোহরপুর, গাংনী উপজেলার সহগলপুর, গাড়াবাড়ীয়া, কাথুলী, ধলা, সাহারবাটি, নওপাড়া, ভাটপাড়াসব এলাকার ফসলি মাঠে যেমন সবজী আবাদ হয় তেমনি সবজীর চেয়ে এখন তামাক চাষ বেশী হচ্ছে বলে জানালেন কালিগাংনীর কৃষক ছুরমান আলী।

এলাকাবাসির অভিযোগ, তামাক কোম্পানিগুলোর প্রলোভনে পড়ে চলতি মৌসুমে বোরো, গম, ভুট্টা সহ অন্যান্য রবিশষ্য আবাদ কমিয়ে দিয়ে তামাক চাষের প্রতি ঝুঁকেছেন চাষিরা।

তামাক কোম্পানিগুলোর আর্থিক সহযোগিতায় জেলাতে তামাক চাষ বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে সচেতন মহল জানায়। বিনা মূল্যে বীজ, বিনা সুদে ঋণ সার ও নগদ অর্থসহ তামাক ক্রয়ের নিশ্চয়তা দেয়া হচ্ছে কৃষকদের।