মেহেরপুরের মোদাচ্ছেরসহ শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের ৪ হোতা গ্রেপ্তার

হিডেন স্পাই ওয়্যারলেস কিট ব্যবহার করে সরকারি/বেসরকারি বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষায় উত্তীর্ণের নিশ্চয়তা দিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া সিন্ডিকেটের হোতাসহ চারজনকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)।

এর মধ্যে একজন হচ্ছেন মেহেরপুর সদর উপজেলার মৃত গোলাম মোস্তফা বিশ্বাসের ছেলে মো. মোদাচ্ছের হোসেন। তিনি মুজিবনগর সমাজসেবা অফিস থেকে ২০১৯ সালে অবসর নেন। বাকি ব্যক্তিরা হলেন- চক্রের হোতা সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ার মো. আমির হোসেনের ছেলে মো. ইকবাল হোসেন, তার সহযোগী গোপালগঞ্জের কাশিয়ানীর সেকেন্দার আলীর ছেলে রমিজ মৃধা, একই উপজেলার মৃত আব্দুল মান্নান তালুকদারের ছেলে মো. নজরুল ইসলাম।

বুধবার রাতে রাজধানী ও এর আশপাশে এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। এ সময় তাদের কাছ থেকে বেশকিছু ডিভাইস ও আলামত উদ্ধার করা হয়। এই ব্যাপারে বৃহস্পতিবার রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র‌্যাবের মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলন করে বিস্তারিত জানান সংস্থাটির পরিচালক (আইন ও গণমাধ্যম শাখা) কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।

 সংবাদ সম্মেলনে খন্দকার আল মঈন জানান, সম্প্রতি কিছু অসাধু ব্যক্তি/সংঘবদ্ধ প্রতারক চক্র বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র সুকৌশলে ফাঁস করে হিডেন স্পাই ওয়্যারলেস কিট ব্যবহার করে সরকারি/বেসরকারি বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষায় উত্তীর্ণের নিশ্চয়তা দিয়ে চাকরি প্রার্থী এবং তাদের অভিভাবকদের কাছ থেকে শর্তসাপেক্ষে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। আসছে ২০ মে অনুষ্ঠেয় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষাকে সামনে রেখে প্রতারক চক্রগুলো তাদের তৎপরতা বৃদ্ধি করেছে মর্মে র‌্যাব গোয়েন্দা সূত্রে জানতে পারে। এসব চক্রকে আইনের আওতায় নিয়ে আসার লক্ষ্যে র‌্যাব তাদের গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করে।

তিনি জানান, এরই ধারাবাহিকতায় গত রাত ১টার দিকে র‌্যাব-২ এর একটি আভিযানিক দল গোপন সংবাদের ভিত্তিতে রাজধানী ও তার আশেপাশের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে এই চার ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে।

জিজ্ঞাসাবাদের বরাতে খন্দকার আল মঈন জানান, প্রথমে তারা বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি নিয়োগ পরীক্ষা সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে। পরবর্তীতে ওই নিয়োগ পরীক্ষার পরীক্ষা নেওয়ার স্থান ও পরীক্ষার গার্ড সম্পর্কে তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করে। এ সময় চক্রের অন্যান্য সদস্যরা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের সরকারি/বেসরকারি চাকরি প্রত্যাশিদের খুঁজে বের করে ১০-১৫ লাখ টাকার বিনিময়ে পরীক্ষায় পাস এবং চাকরি পাইয়ে দেওয়ার নিশ্চয়তার মাধ্যমে তাদেরকে প্রলোভন দেখাত। পরবর্তীতে আগ্রহী পরীক্ষার্থীদের কাছে উদ্ধারকৃত  ডিভাইসগুলো প্রদান করে এর ব্যবহার বিধি প্রশিক্ষণ দিয়ে প্রাথমিকভাবে ১/২ দুই লাখ টাকা জামানত হিসেবে গ্রহণ করত। অবশিষ্ট টাকা চাকরি পাওয়ার পরে পরিশোধ করবে মর্মে চুক্তি করত। এভাবে তারা বিগত কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন চাকরি প্রার্থীদের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়।

তিনি আরও জানান, বিদেশ থেকে আনা এই ডিভাইসগুলো মূলত দুইটি অংশে বিভক্ত। ডিভাইসটির একটি অংশ পরীক্ষার্থীদের কানের ভেতর এবং অটোমেটিক কল রিসিভ হওয়ার সিম লাগানো অপর অংশটি শরীরের বিভিন্ন স্থানে বিশেষ কায়দায় লুকিয়ে তাদের পরীক্ষার হলে প্রবেশ করাত। পরবর্তীতে পরীক্ষার্থীরা নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের ছবি বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে তাদের নিকট পাঠাত। চক্রটি প্রশ্নপত্রের উত্তর দেওয়ার জন্য পূর্ব থেকেই মেধাবী শিক্ষার্থীদের সমন্বয়ে একটি টিম প্রস্তুত রাখত। পরীক্ষার হল থেকে পাঠানো প্রশ্নপত্রের উত্তরসমূহ মেধাবী শিক্ষার্থীদের সমন্বয়ে গঠিত টিমের মাধ্যমে খুঁজে বের করে চুক্তিবদ্ধ পরীক্ষার্থীদের বলে দিত।

র‌্যাব জানায়, চক্রের হোতা ইকবাল ২০০৮ সালে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক হিসেবে চাকরি পায়। নিজ এলাকায় শিক্ষকতা করছিলেন। এরই মধ্যে ২০১৫ সালে একই এলাকার অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারী আলতাফ হোসেন নামে এক ব্যক্তির সঙ্গে তার পরিচয় হয়। মূলত আলতাফের কাছেই বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষায় পাসের নিশ্চয়তা দিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেওয়ার বিষয়টি রপ্ত করে। পরবর্তীতে আলতাফ মারা গেলে তিনি নিজেই চক্রটি পরিচালনা করা শুরু করেন। তার বিরুদ্ধে উল্লাপাড়া থানায় একটি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা এবং বেশ কয়েকটি সাধরণ ডায়েরি (জিড) রয়েছে।

গ্রেপ্তার রমিজ এই প্রতারক চক্রের অন্যতম সহযোগী এবং একটি হত্যা মামলার পলাতক আসামি। গ্রেপ্তার এড়াতে পালিয়ে থাকার সময় ২০২০ সালে ইকবালের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। বিভিন্ন ইলেক্ট্রনিক্স ডিভাইস সম্পর্কে অভিজ্ঞতা থাকায় তাকে এই প্রতারক চক্রের সদস্য করেন ইকবাল।

আর নজরুল ১৯৯৪ সালে সমাজসেবা অধিদপ্তরে অফিস সহকারী-কাম কম্পিউটার অপারেটর পদে চাকরিতে যোগদান করেন। নজরুল এবং রমিজের বাড়ি পাশাপাশি হওয়ায় তারা একে অপরের পূর্বপরিচিত ছিলেন। তিনি দেশের বিভিন্ন এলাকার মানুষকে চাকরি দেওয়ার কথা বলে ইকবাল ও রমিজের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিতেন তিনি।

মোদাচ্ছের মেহেরপুর জেলার মুজিবনগর উপজেলার সমাজসেবা কার্যালয় থেকে সমাজসেবাকর্মী হিসেবে ২০১৯ সালে অবসর নেন। তিনিও সাধারণ চাকরি প্রার্থীদের খুঁজে বের করে  ইকবাল ও রমিজের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিতেন। গ্রেপ্তারকৃতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন।