মেহেরপুরে চার শতাধিক ব্যবসায়ীর পেশা বদল

করোনা প্রাদুর্ভাবে পেশা বদল করেছে মেহেরপুরের পর্যটন এলাকা কেন্দ্রিক ব্যবসায়ীরা। পর্যটন এলাকায় দীর্ঘদিন জনসমাগম না থাকায় এমনটি হয়েছে বলে জানিয়েছে ব্যবসায়ীরা। মেহেরপুরে ছোট বড় তিনটি পর্যটন এলাকা হিসেবে দেশ ব্যাপী পরিচিত। ইতোমধ্যে মেহেরপুরের মুজিবনগরকে আন্তর্জাতিক মানের পর্যটন কন্দ্রে হিসেবে গড়ে তোলার কাজ চলছে। কিন্তু করোনার কারণে সেটি আপতত বন্ধ আছে। এছাড়াও ব্রিটিশদের স্মৃতি বিজড়িত আমঝুপি নীলকুঠি ও গাংনী উপজেলার ভাটপাড়ায় ডিসি ইকোপার্ক।

এইসব পর্যটন এলাকাকে কেন্দ্র করে চার শতাধীক ব্যবসায়ী তাদের জীবিকা নির্বাহ করতো। পর্যটন এলাকার চারিপাশে বিভিন্ন খাদ্য সামগ্রী, চায়ের স্টল, খেলনা সামগ্রী, খাবারের দোকান ইত্যাদি সাজিয়ে বসেছিল ব্যবসায়ীরা। এই ব্যবসার মাধ্যমে তাদের সংসার চলতো। কিন্তু গত মার্চ মাসের শেষের দিক থেকে এখন পর্যন্ত করোনার প্রার্দুভাবে এইসব পর্যটন এলাকায় মানুষের আনাগোনা নেই বললেই চলে। একারনেই দোকানপাট গুলো ইতোমধ্যেই বন্ধ হয়ে গেছে। সংসার চালাতে বেছে নিয়েছে ভিন্ন পেশা। কেউ কেউ দোকান খুলে বসে থাকলেও সংসার চালানোর মত উপার্জন হয়না।

মেহেরপুরের সবচেয়ে বড় পর্যটন এলাকা হচ্ছে স্বাধীনতার সূতিকাগার ঐতিহাসিক মুজিবনগর। বছরের শুরুতে পর্যটকদের উপচেপড়া ভিড় থাকলেও সারা বছরই দেশ বিদেশ থেকে পর্যটকদের আনাগোনা থাকে ব্যাপক। কিন্তু এখন তার ভিন্ন চিত্র। অবকাঠামো ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ে না।

এ এলাকার ব্যবসায়ীরা বাধ্য হয়ে পরিবর্তন করেছে তাদের পেশা। কেউ পরের জমিতে কৃষি কাজ করে, কেউ সবজি বিক্রি করছে, কেউ মৌসুমি ফল আমের ব্যবসার সাথে জড়িত হয়েছে, কেউ বিভিন্ন জায়গায় শ্রমিক হিসেবে কাজ করছে।

সোনাপুর গ্রামের আব্দুল কুদ্দুস ২২ বছর ধরে মুজিবনগর আমবাগানের ভিতর চা বিক্রি করে আসছেন। দিন গেলে দেড় থেকে দুই হাজার টাকা উপার্জন করতো। সংসার চালিয়ে কিছু টাকা জমা করে রাখতেন ভবিষ্যতের কথা ভেবে। এখন জমা করাতো দুরের কথা ঠিকমত সংসার চালানোই মুশকিল তার জন্য। পেশা বদল করে তিনি এখন আমের ব্যবসা করেন। কাঁচা আম কিনে পাকানোর পর বাজারে বসে খুচরা দরে বিক্রি করেন। কুদ্দুস বলেন “আমের সিজিন শেষ। এখন কি করবো বুঝতে পারছি না। বয়সও হইছে কঠিন কাজতো করতে পারবো না। দেখা যাক ভাগ্যে কি আছে” ?

কসমেট্রিক্স ব্যাবসায়ী পলাশ বলেন,করোনার কারনে দীর্ঘদিন ধরে দোকান বন্ধ আছে। পর্যটক না থাকায় দোকানে বেচাকেনা হচ্ছে না। তাই দোকান বন্ধ রেখেছি। আমি এখন আম পাড়ার লেবার হিসেবে কাজ করছি।
হোটেল ব্যবসায়ী মিহিদুল ইসলাম জানান, করোনার কারনে দীর্ঘদিন ধরে হোটেল বন্ধ রেখেছি। খাওয়ার লোক নেই। নিজের কিছু জমি আছে সেই সাথে অন্যের কিছু জমি লিজ নিয়ে চাষাবাদ করছি।

মুজিবনগর আমবাগানে চট বিছিয়ে খেলনা বিক্রি করতেন মোজাম্মেল হক। এখন তিনি পাখি ভ্যান চালান। যদিও তাতেও রয়েছে কঠোর নির্দেশনা। তারপরও জীবিকার তাগিদে ভ্যান চালাতে বাধ্য হয়েছেন ৫৫ বছরের মোজাম্মেল।

কসমেট্রিক্স ব্যবসায়ী আব্দুর রাজ্জাক জানান,আমি মাঠে কাজ করতে পারি না। কসমেট্রিক্স ব্যবসায়ের উপর আমার সংসার চলতো। করোনার কারনে মুজিবনগরে পর্যটক না আসায় দীর্ঘদিন ধরে দোকানে কোন কাস্টমার নেই। তারপরও খুলে রেখেছি স্থানীয়দের আশায়।

পাইকারী খেলনা ব্যবসায়ী শরিফুল মোল্লা জানান, আমরা সাধারণত খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে খেলনা বিক্রি করে থাকি। করোনার কারনে মুজিবনগরে পর্যটক না আসায় খুচরা ব্যবসায়ীরা তাদের মালামাল বিক্রি করতে পারছি না। এতে করে ঘরে মালামাল বোঝায় করে রেখেছি। মালামাল গুলো বিক্রি করতে না পেরে আমরা লোকসানের মুখে পড়েছি।

গাংনী উপজেলার ভাটপাড়া ডিসি ইকোপার্ক। এই পর্যটন এলাকাকে কেন্দ্র করে ছোট বড় মোট ১৫ জন বিভিন্ন ধরনের ব্যবসায়ী ছিল। এখন একটি মাত্র দোকান খোলা থাকে, বাকি গুলো সব বন্ধ। এছাড়াও পার্কের বিভিন্ন ধরনের বিনোদনের ব্যবস্থাও ছিল। এগুলো চালিয়ে জিবিকা নির্বাহ করতো স্থানীয় কিছু নিম্ন আয়ের মানুষ। করোনা প্রাদুর্ভাবে পর্যটক না থাকায় বেছে নিয়েছে ভিন্ন পথ।

টয়ট্রেনের মালিক আকবর আলী জানান, ইকো পার্কে দর্শনার্থী না থাকায় ব্যবসার সকল কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। টয়ট্রেনের পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত শ্রমিকেরা কাজ ছেড়ে জীবিকার তাগিদে দিন মজুর হিসেবে অন্যের জমিতে কামলার কাজ করছেন।

নাগরদোলার মালিক জয়নাল আবেদীন বলেন, আমি একটি সমবায় সমিতির সাথে জড়িত। ব্যবসা না থাকায় সমিতি নিয়ে ব্যস্ত আছি। তবে এগুলি লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে তৈরি করা হলেও চালু না থাকায় মরিচা পড়ে নষ্টের পথে।

পার্ক সংলগ্ন কাজলা নদীতে নৌকা পরিচালনাকারী কানু মিয়া জানান, আমি একজন স্যালোইঞ্জিন মিস্ত্রি। আমি নৌকা ছেড়ে দিয়ে মিস্ত্রি পেশায় নিজেকে নিয়োজিত করেছি।

ইকো পার্কের চটপটি ব্যবসায়ী জুয়েল রানা জানান, আমি এখানে একটি দোকান বরাদ্দ নিয়ে চটপটি বিক্রি করে সংসার চালাতাম। বর্তমানে এ ব্যবসা ছেড়ে ক্ষেত খামারে দিনমজুরের কাজ করছি।

আজব গুহার মালিক ইয়ারুল ও সুমন আহাম্মেদ জানান, আমি অনেক টাকা ধার দেনার মধ্যে পড়েছি। বর্তমানে অন্য পেশায় যেতে চাইছি। কবে নাগাদ সবকিছু ঠিকঠাক হবে আল্লাহ ছাড়া কেই জানেনা। তাই পেটতো চালাতে হবে।

মেহেরপুর সদর উপজেলার আমঝুপিতে অবস্থিত নীলকুঠি। বিট্রিশ শাসনামলের নীল চাষের সাক্ষী। সারা বছরই কমবেশি লোকজন আসে এই নীলকুঠি দেখতে। তবে বিশেষ দিনে এখানে পর্যটক হয় অনেক। এখানে তেমন একটা ব্যবসায়ী না থাকলেও স্থানীয় কয়েকজন অস্থায়ীভাবে চা-পানের দোকান চালাতেন। জনসমাগম না থাকায় ইতোমধ্যে একটি দোকান বন্ধ হয়ে গেছে। আরেকটি কোন রকমে টিকে আছে। স্থানীয় কিছু তরুণদের কল্যাণে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন রাসেল।

প্রতিবেদনটি তৈরিতে সহযোগীতা করেছেন গাংনী প্রতিনিধি আক্তারুজ্জামান ও মুজিবনগর প্রতিনিধি শাকিল রেজা।

মেপ্র/এমএফআর