রাতের ঢাকায় ‘অন্যরকম’ দৃশ্য

ঘটনাস্থল জিরোপয়েন্ট। রাত তখন নয়টা। একটি মাইক্রোবাস থামতেই চিৎকার। নানা বয়সি ছুটছে। হাঁক চলছে, ‘এদিকে আয়। দৌড় দে।’ এরপর ‘আমারে দেন, আমারে দেন।’ চেঁচামেচি আর জটলা। মাইক্রোবাসটি থেকে কয়েক প্যাকেট খাবার ছুঁড়ে দিতেই ভিড় বাড়তে লাগল। দূর থেকে মনে হচ্ছিল, এ যেন মৌচাকে ঢিল।

গোলাপ শাহ মাজার চত্বর থেকে জিরো পয়েন্ট। মাঝখানে রমনা ভবন, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ আর পীর ইয়ামেনি। পুরো চত্বরটি মুহুর্তের মধ্যেই একটি গুমোট পরিবেশের তৈরি হলো। গাড়িটি ক প্যাকেট খাবার দিয়েই দ্রুত বেগে চলে গেল। যারা কাছাকাছি ভিড়েছে, খাবার মিলেছে তাদের।

এমন দৃশ্য আগে কখনও চোখে পড়েনি। এ ঢাকা যেন অন্য ঢাকা। কিছুদিন আগেও যে রাতের ঢাকা ছিল ট্রাকের নগরী। ঘর ফেরা মানুষের পদভারে ক্লান্ত পিচের পথ থাকত অস্তির, নিশুতি রাতে খুঁজে ফিরতো স্বস্থি। অন্ধকারে ছিনতাইকারীর দল উৎ পেতে থাকত অলি গলিতে। অন্ধকারে আলতা পায়ে খদ্দেরের অপেক্ষায় থাকত নিশিকন্যারা। রাজপথের মোড়গুলো দখলে থাকত টহল পুলিশের।
দৃশ্যপট বদলাতে থাকে । করোনা দুনিয়া কাঁপিয়ে জ্বর তোলে ছাপান্ন হাজার বর্গমাইলেও। পঁচিশে মার্চের পর থেকে বদলাতে থাকে শহরের দিন রাত। কার্যত লকডাউন সেই রাত থেকেই।

প্রথমদিকে লকডাউন ছিল অনেকটাই অঘোষিত। সামাজিক দূরত্বের জন্য ঢাকা হয়ে যায় ফাঁকা। ছিন্নমূল মানুষেরা ঠাঁয় নেয় শহরের ফুটপাত আর অলি গলিতে। আর নিরন্ন সেই সকল মানুষেরা একমুঠো খাদ্যের জন্য দিনে কড়া নাড়ে বিত্তবানদের দরোজায়, রাতে রাস্তার মোড়ে, ফুটপাতে।

জিরোপয়েন্টের এ দৃশ্য যেন মনে করিয়ে দেয় আবুল বাশারের সেই বিখ্যাত চরিত্র ফজল আলীর কথা। ফজল আলী একমুঠো ভাতের জন্য ছুটে আসে মহানগর কলকাতায়। প্রশ্ন জাগে, লকডাউনে কর্মহীন দরিদ্র মানুষেরাও কি ছুটছে ফজল আলীর মতোই। সময়ই হয়তো এর উত্তর দেবে।

শুধু জিরোপয়েন্ট নয় এমন চিত্র রাজধানীর গুলিস্তান, সদরঘাট, কাকরাইল, মগবাজার, মহাখালী, টিএসসি, শাহবাগ, মোহম্মদপুরের বিভিন্ন সড়কপথে। রোববার রাতে সরজমিন এসব এলাকায় চিত্র ছিল এমনই। রাত ১১টার দিকে ফকিরাপুল, কাকরাইল, নয়াপল্টন, বেইলিরোডের অফিসার্স ক্লাব এলাকায় দেখা যায় অকষ্মাৎ একটি পাজেরো জিপ থামিয়ে চাল, ডাল, আলুর প্যাকেট চটজলদি দিয়ে চলে যেতে। একাধিকবার এ এলাকায় এ দৃশ্য চোখে পড়েছে।

টিএসসি এলাকায় ত্রাণ দেয়ার আগে অনেককেই দেখা গেছে টোকেন দিয়ে যেতে। পরে টোকেন নিয়ে যারা এসেছে তাদের ত্রাণ দেয়া হয়েছে। প্রবল বন্যা বা অন্যকোন দুর্যোগে চাল-ডালের জন্য মানুষকে এভাবে দাঁড়াতে দেখা যায়নি নিকট অতীতে।
ফুটপাতে অপেক্ষায় থাকা মোবারক, আরশাদুল, আসিয়ার সঙ্গে কথা হয়। এরা বুয়েট ও বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার। দিনমজুরি আর বাসায় ঝিয়ের কাজ করে যা আয় হতো তা দিয়েই চলত সংসার। করোনায় সবকিছু বন্ধ বলে তাদের মাথায় হাত। অনেক বিত্তবান পরিবারের পক্ষে নীরবে রাতে ত্রাণ দেয়া হয় বলে তাদের অপেক্ষা।

 

 

সুত্র-মানবজমিন