রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি মেলেনি শহীদ উজির আলী মালিথ্যার

একাত্তরের ১৫ আগস্ট। জমাট মেঘে ঢাকা আকাশ, মাঝে মধ্যে হালকা বৃষ্টি। সন্ধ্যা নামতে না নামতেই গাংনী থানার সাহারবাটী গ্রামে নেমে আসে ঘুটঘুটে আঁধার। চারদিকে সুনসান নিরবতা। মুক্তিপাগল তরুণ-যুবকরা গ্রাম ছেড়ে আন্ডার গ্রাউন্ডে চলে গেছেন। বাড়িতে একাই পায়চারি করছেন উজির আলি মালিথ্যা। ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধুর পক্ষ থেকে স্বাধীনতা যুদ্ধ ঘোষণার পরপরই বড় ছেলে আক্কাস আলির নেতৃত্বে গড়ে ওঠে সাহারবাটী ইউনিয়ন সংগ্রাম পরিষদ।

মেজ ছেলে আকরাম আলি মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ গ্রহণের উদ্দেশ্যে যুদ্ধের শুরুতেই সীমান্ত পাড়ি দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার বেতাই ক্যাম্পের আশে পাশে অবস্থান গ্রহণ করেন। স্থানীয় রাজাকারদের হুমকি ও আত্মীয়-স্বজনদের অনুরোধ সত্ত্বেও তিনি দেশত্যাগ করেননি। প্রাণের মায়া ত্যাগ করে বাড়িতে অবস্থান করে তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করতেন। হঠাৎ একদিন রাত নয়টার দিকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের স্থানীয় দোসর রাজাকার-আলবদর-আল শামসরা উজির মালিথ্যার বাড়িটি ঘিরে ফেলে। হামলা চালায় বাড়ির পাশ-ঘরের দরজায়। সজোরে লাথি মেরে ভেঙে ফেলে সদর-দরজা। ভয়-ভীতি উপেক্ষা করে দরজা খুলে দেন অসমসাহসী উজির আলি। ঢুকেই স্ত্রী ও গৃহকর্মীর সামনে তাকে রাইফেলের বাট ও ছড়ি দিয়ে নির্দয়ভাবে পোটাতে থাকে পাক-হানাদার বাহিনীর জওয়ানরা। বেদম প্রহার ও উপর্যুপরি লাথির আঘাতে মেঝেতে লুটিয়ে পড়েন তিনি। টানতে টানতে বাড়ির বাইরে নিয়ে আসা হয়। চোখ বেঁধে ট্রাকে তুলে ভাটপাড়া ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়।

১৫ আগস্টের গভীর রাতে তাকে ও তার বন্ধু এমলাক হোসেনসহ ৬ জন বুদ্ধিজীবী ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠককে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে পাশে কাজলার পানিতে লাশ ভাসিয়ে দেয়। তাদের লাশ আজও স্বজনরা খুঁজে পায়নি। বাংলা একাডেমি প্রকাশিত কাজী সাজ্জাদ আলী জহির রচিত ‘মুক্তি সংগ্রামে মেহেরপুর’ (জানুয়ারি ২০১৬) গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়, ‘১৪ আগস্ট পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবসে গাংনী থানা শান্তি কমিটির বিশেষ বৈঠকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও রাজাকাররা বুদ্ধিজীবী এবং স্থানীয় এলিটদের নিশ্চিহ্ন করার সিদ্ধান্ত নেয়। তালিকা আগেই করা ছিল, তা কার্যকর করা হয় ১৫ আগস্ট থেকে।’

উজির আলির জন্ম ১৯১৫ সালে নদীয়া জেলার করিমপুর থানার গোয়াস- রহমতপুর গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে। বাবা দিরাজতুল্লাহ ছিলেন সচ্ছ্বল কৃষক, মা সাবেরা বেগম গৃহিণী। দেশভাগের পর ১৯৫০ সালে তাঁর পরিবার মেহেরপুর জেলার গাংনী উপজেলার সাহারবাটী গ্রামে বসতি স্থাপন করেন। পেশা হিসেবে বেছে নেন ব্যবসা, চাষাবাদ ও জনসেবা। তার পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে ওঠে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সাংস্কৃতিক সংগঠন। পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করেন সাহারবাটী প্রাথমিক বিদ্যালয়, ভাটপাড়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে।

তিনি ছিলেন একাধারে মানবহিতৈষী সমাজসেবক, রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক কর্মী, এবং মুক্তিযুদ্ধের বলিষ্ঠ সংগঠক। কবিতা রচনা করতেন এবং শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিচর্চায় নিজের ছেলে ও স্থানীয় তরুণদের সহযোগিতা প্রদান করতেন। পকিস্তান আমলে সামরিক শাসনের মধ্যেও তার সহযোগিতায় উদযাপিত হয়েছে পয়লা বৈশাখ, রবীন্দ্র-নজরুল জয়ন্তী। সরাসরি রাজনৈতিক দলে যুক্ত না হয়েও ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ষাটের দশকের স্বাধিকার আন্দোলন, স্বাধীনতাযুদ্ধে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন। প্রতিরোধ যুদ্ধের প্রস্তুতির সূচনালগ্নে তার বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে বিভিন্ন গোপন বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। তার বাড়িটি ছিল রাজনীতি ও সংস্কৃতিচর্চার পীঠস্থান।

বড় ছেলে আক্কাস আলি ছিলেন গাংনী থানা আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা ও মুক্তিযুদ্ধের বলিষ্ঠ সংগঠক। রফিকুর রশীদের লেখা ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ মেহেরপুর জেলা’ (আগামী প্রকাশনী, ফেব্রুয়ারি ২০০৭) গ্রন্থে উজির আলি মালিথ্যাকে ‘মুক্তমনা ও সংস্কৃতিপ্রাণ’ মানুষ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। এই গ্রন্থে রফিকুর রশীদ লিখেছেন, ‘সাহারবাটির আরো দুজন স্বাধীনতা সংগ্রামীর নাম হচ্ছে: এমলাক হোসেন এবং উজির মালিথ্যা। দুজনেই মুক্তপ্রাণ ও সংস্কৃতিপ্রাণ। নিজেদের ছেলেদের মানুষ করেছেন উদার নৈতিক পরিবেশে। নিজ এলাকার মানুষকে স্বাধীনতা আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করেছেন। ১৫ আগস্ট গভীর রাতে তাদের হত্যা করা হয়।’ উজির আলি রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন না, মফস্বল বাসের কারণে এই প্রতিভাধর সাংস্কৃতিক সংগঠক ও প্রগতিশীল মানুষটি মেহেরপুর জেলার বাইরে খুব বেশি পরিচিত নন। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে তার বীরোচিত আত্মত্যাগে স্মৃতি ও পৌরষদীপ্ত ব্যক্তিত্ব এ এলাকার মানুষের হৃদয়ে অক্ষয় ও অম্লান হয়ে আছে।

তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়, খাবার দেওয়া ও অস্ত্রপাতি রাখার ব্যবস্থা করতেন। এলাকার যুবক তরুণদের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে উদ্বুদ্ধ করতেন। যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিতে মুক্তিযোদ্ধাদের ভারতে যেতে উৎসাহ প্রদান করতেন। কিন্তু তাঁর বীরোচিত অবদানের যথাযথ স্বীকৃতি মেলেনি আজও। তবে রফিকুর রশীদের লেখা আগামী প্রকাশনীর ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ: মেহেরপুর জেলা’ গ্রন্থে উজির আলিকে ‘গাংনী থানার স্বাধীনতা আন্দোলনের অগ্রগণ্য ব্যক্তি’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত কাজী সাজ্জাদ আলী জহিরের ‘মুক্তিসংগ্রামে মেহেরপুর’ এবং মূর্ধন্য প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত আবদুল্লাহ আল আমিনের ‘ভাটপাড়া নীলকুঠি ও উনিশ শতকের বাংলাদেশ’ গ্রন্থে (ফেব্রুয়ারি, ২০১৯) উজির আলিকে সমাজসেবী, বিদ্যোৎসাহী, সংস্কৃতিসেবী হিসেবে উল্লেখ করা হয়। উজির আলি এবং একাত্তরের ১৫-আগস্টের শহীদদের স্মৃতি রক্ষার্থে ভাটপাড়ায় মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে, চলছে বধ্যভূমি সংরক্ষণের কাজ। শহীদ উজির আলির বড়ছেলে প্রয়াত আক্কাস আলি ছিলেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, সমাজসেবী ও বিদ্যোৎসাহী। শহীদ উজির আলীর তিন ছেলে ও এক মেয়ে বেঁচে আছেন। তারা সবাই শিক্ষিত, শিল্পানুরাগী ও প্রগতিশীল রাজনীতির সমর্থক।

মেজ ছেলে সমাজ সেবক ও ক্রীড়া সংগঠক আকরাম আলি বলেন, বাবা ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের বলিষ্ঠ সংগঠক। তার প্রেরণায় আমরা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করি। উদার-অসাম্প্রদায়িক চিন্তার মানুষ হিসেবে তিনি কোনোদিন কোন সাম্প্রদায়িক রাজনীতি সমর্থন করেননি। আমার বড়ভাই ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের বলিষ্ঠ সংগঠক। মতাদর্শগত কারণে স্থানীয় শান্তি কমিটির নেতা ও রাজাকাররা বাবার উপর ক্ষিপ্ত ছিলেন। স্বাধীনতাবিরোধী ঘাতক-দালালদের প্রত্যক্ষ মদতে পাক হানাদার বাহিনী বাবাকে হত্যা করে। তিনি দেশের জন্য শহীদ হয়েছেন, এ জন্য আমরা গর্ব অনুভব করি।

শহীদ উজির আলি মালিথ্যার বড়ছেলের ছেলে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের জেনারেল ম্যানেজার খালেদুজ্জামান বলেন, আমাদের দাদা দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছেন। কিন্তু তার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি মেলেনি। শহীদ হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দাবি করছি।

লেখক: মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক ও সহযোগী অধ্যাপক, মেহেরপুর সরকারি কলেজ।