লায়লাতুল ক্বদর

এম এ এস ইমন,

আপনার জীবনের শ্রেষ্ঠতম রাত্রি। আপনার গন্তব্য কে বেছে নেয়ার রাত্রি। আপনার জীবনের সকল ভুলভ্রান্তি মুছে ফেলার রাত্রি। আপনারই দ্বারপ্রান্তে একটি রাত যা হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। একটি রাত যা জীবনভর ইবাদত করার চেয়েও উত্তম।

আমাদের গড় আয়ু ৬০ থেকে ৭০ বছর। এর মধ্যে ১০ থেকে ১৫ বছর কেটে যায় শৈশবে। ১০ বছর কেটে যায় কর্মস্থলে। আরো ১০ বছর ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে। ৫ বছর যাতায়াত করতে করতে। আরো দশ পনেরো বছর সামাজিকতার বিনোদনে। বাকি ১০-১৫ বছর সময়ের কতটুকু আসলে আমরা পুরোপুরি ইবাদতের পেছনে ব্যয় করতে পারি। অথচ লায়লাতুল ক্বদর এমন একটি রাত যা হাজার মাস অর্থাৎ ৮৩ বছরের চাইতেও উত্তম।

এর মানে এই একটি রাত যদি আমরা সম্পূর্ণভাবে আন্তরিকতার সাথে ইবাদত করতে পারি এর মূল্য হবে জীবনভর প্রতিটি মুহূর্তে প্রতিটি ক্ষণে আল্লাহর কথা স্মরণ করে তার ইবাদত করে কাটিয়ে দেয়ার চেয়েও উত্তম এর চাইতেও মর্যাদাপূর্ণ।

লায়ইলাকুল ক্বদর এমন একটি উপহার যা পেলে মনে হয় আল্লাহতাআলা আসলে আমাদেরকে জান্নাতে পাঠিয়ে দেয়ার জন্য কারণ খুঁজছেন, অজুহাত খুঁজছেন। আমাদের প্রত্যেকে গুনাহগার কেউ নামাজ বাদ দেই, তো কেউ মিথ্যা কথা বলি। কেউ বাবা মায়ের সাথে খারাপ ব্যবহার করি। কেউ জিনায় লিপ্ত, কেউ মদ খেয়েছি কেউ মাদকে আসক্ত।

কতরকম ভুল-ভ্রান্তিতে আমরা ডুবে আছি। অথচ আল্লাহ তাআলা আমাদের কারোর লায়লাতুল ক্বদরের মত মহিমান্বিত রাত্রির দরজা বন্ধ করে দেননি বরং এই রাত্রটি যেন খাসভাবে আমাদের জন্যই তৈরি করা হয়েছে আমাদের প্রতি আল্লাহর রহমত ভালোবাসা সত্যিই আমাদের কল্পনাশক্তির বাইরে। প্রথমত জেনে নেই লায়লাতুল ক্বদর কবে? রসুল (সঃ) বলেছেন, লায়লাতুল ক্বদরকে রমজানের শেষ দশ রাত্রিতে খোঁজ।

এটা সত্যি যে এছাড়াও অন্যান্য হাদিসে দশ রাত্রির বেজোড় রাত্রিগুলো ২৭ এর রাত ২৫ এর রাত ২৯ এর রাতসহ বিভিন্ন রাতের কথা এসছে। কিন্তু এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই যে পুরোপুরি নিশ্চিত ভাবে লায়লাতুল ক্বদর পাওয়ার একমাত্র উপায় হচ্ছে শেষ দশ রাত্রির প্রতিটি রাতেই এর ইবাদত করা। মনে করুন একটি লটারী হচ্ছে।

আপনাকে বলা হলো এক থেকে দশ টিকেটের মধ্যে যে কোন একটি অবশ্যই জিতবে। আপনি কি তখন কোন টিকিট বাদ রাখবেন? টিকিটের দাম যতই হোক না কেন লটারী জেতার পুরষ্কার তার থেকে লক্ষ্যগুনে বেশি। তাই এই বিরাট পুরষ্কারের কথা চিন্তা করে আপনি দশটি টিকিটই কিন্তু কিনে ফেলবেন। অতএব আমাদের উচিত শেষ দশ রাত্রি প্রতিটি রাতে আমাদের শতভাগ প্রচেষ্ঠা করা।

তার পাশাপাশি যে রাত্রিগুলোর কথা বিশেষভাবে এসেছে যেমন ২৭ এর রাত এবং বেজোড় রাতগুলো সে রাত্রিগুলোতে আমরা বাড়তি কিছু আমল করতে পারি। কিন্তু অবশ্যই অন্যান্য রাত্রিগুলিতে বিশেষ করে ২৭ এর পরের রাত্রিগুলিতে যখন খতম তারাবী শেষ হয়ে যায়। তখন যেন আমরা আমাদের এবাদত কোনভাবেই কমিয়ে না দেই। এবার আসি লায়লাতুল ক্বদরে আমাদের করণীয় কি। আয়শা (রা) বলেন রমাদানের শেষ দশ রাত্রিতে রসুল (স:) তার কোমড় বেধে ইবাদত বন্দেগিতে নেমে পরতেন।

অথ্যাৎ অন্যান্য সময় তিনি যতটা ইবাদত করতেন রমাদানের শেষ দশ রাত্রিতে তিনি সেই পরিমাণ আরো বাড়িয়ে দিতেন। আমাদের উচিত হবে যে যেই অবস্থাতেই আছি আমাদের ব্যক্তিগত ইবাদাতগুলো এই দশ রাত্রিতে বাড়িয়ে দেয়া। এখানে সবা জন্য একই ফর্মূলা কাজ করবে না। যার ফরজ নামার পড়ার অভ্যাস নেই তা অবশ্যই প্রথমে লক্ষ্য রাখতে হবে এই দশ রাত্রিতে যেন ফরজ নামাজ বাদ না হয়। অন্যদিকে যে ফরজ এবং সুন্নত নিয়মিত পড়ে তার উচিত হবে বেশি বেশি করে নফল ইবাদত করা। লায়লাতুল ক্বদরের রাত্রিকে পুরোপুরি কাজে লাগানোর জন্য একটি চমৎকার সুযোগ হচ্ছে এশা ও ফজরের নামাজ মসজিদে জামাতের সাথে আদায় করা।

কেননা রসূল সাল্লালাহু সাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি জামাতের সাতে এশা ও ফজরের নামাজ আদায় করবে সে যেন সারারাত নামাজ পড়ল। অর্থ্যাৎ আপনি জামাতের সাথে এশা ও ফজরের নামাজ আদায় করলে আপনি পুরো রাত্রি নামায পড়ার ছোয়াব পেয়ে যাবেন। এরপর আপনি যাই করেন না কেন সেটা হবে বোনাস। অতএব আমাদের প্রতি লক্ষ্য থাকা উচিত, আর কোনো নামায হোক বা না হোক রমাদানের শেষ রাত্রিতে যেন অবশ্যই এশা এবং ফজরের নামাজ মসজিদে জামাতের সাথে আদায় করা হয়।

অন্যদিকে তারাবির নামাজ ইমামের পেছনে পুরোটা শেষ করলে অর্থাৎ ইমাম ৮ রাকাত পড়লে ৮ রাকাত ২০ রাকাত পড়লে ২০ রাকাত ১০০ রাকাত পড়লে ১০০ রাকাত ইমাম যত রাকাত নামাজই পড়াননা কেন তার পেছনে পুরো নামাজ শেষ করে করলেও পুরো রাত্রি নামাজ পড়ার ছোয়াব পাওয়া যাবে। কিন্তু এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই যে ইবাদতের ক্ষেত্রে রাসুল (স:) এর মনযোগ ছিল সৌন্দর্য্য ও আন্তরিকতার দিকে। তিনি নামাজে লম্বা লম্বা সূরা তেলাওয়াত করতেন এবং রুকু ও সিজদাতে দীর্ঘ সময় নিয়ে দোয়া করতেন।

নামাজে দাড়িয়ে সুরা পড়ার সময় জাহান্নামের আয়াত আসলে তিনি তিলাওয়াত থামাতেন। আমি আল্লাহর কাছে জাহান্নামের আগুন থেকে রেহাই চাইতেন। জান্নাতের আয়াত আসলে আল্লাহর কাছে জান্নাত লাভের জন্য দোয়া করতেন। তাঁর ইবাদতের প্রতিটি উচ্চারণে ছিল আন্তরিকতা। আল্লাহর সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি চেষ্টা। আমরা অনেকে ভাবতে পারি। আমাদের তো বড় বড় সূরা মুখস্ত নেই। যা মুখস্থ আছে সেগুলোর মানেও বুঝিনা।

এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই যে আমাদের উচিত হবে এখন থেকে যেসব সূরা মুখস্ত আছে সেগুলো শাব্দিক অর্থ নিয়ে পড়াশোনা করা এবং নতুন নতুন সূরা মুখস্ত করা। কিন্তু এই সেই দশ রাত্রি যেহেতু চলে এসেছে আমরা এই সময়টায় রুকু এবং সিজদায় বেশি বেশি দোয়া করার মাধ্যমে আমাদের নামাজকে সুন্দর করে তুলতে পারি। বিশেষ করে সেজদা করার সময় বান্দা আল্লাহ তাআলার সবচেয়ে নিকটে থাকে।

এই সময়ে আমাদের উচিত মন খুলে দোয়া করা। সুবহানা রাব্বিয়াল আলা তিনবার বলার পর আপনার দুনিয়া এবং আখেরাতের যা কিছু প্রয়োজন আল্লাহর কাছে চাইতে থাকুন। আপনি মন খুলে দোয়া করতে পারছেন না, মনটা শক্ত হয়ে আছে অসুবিধা নেই আপনার এই দোয়া না করতে পারার কথাটাই আল্লাহ তাআলাকে বলুন।

তিনি আপনার অন্তর প্রশস্ত করে দিবেন আপনার জিহ্বা খুলে দিবেন। কখনো ৫ মিনিট ১০ মিনিট ১৫ মিনিট ধরে সিজদা করে দেখেছেন কি? না করে থাকলে এই শেষ দশ রাত্রির চমৎকার সুযোগ কি আর হতে পারে। নামাজের পাশাপাশি অন্যান্য এবাদত করার মাধ্যমেও আমরা শেষরাত্রি গুলোকে জাগিয়ে রাখতে পারি। আয়েশা (রা:) যখন রসুল (স:) জিজ্ঞেস করলেন: আমরা যদি লায়লাতুল ক্বদর পেয়ে যাই তখন আমরা কি দোয়া করব। রসুল (স:) বললেন: বলবে [‘‘আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুউউন, তুহিব্বুল আফোয়া, ফাফু আন্নি’’ হে আল্লাহ আপনি ক্ষমাশীল, ক্ষমাকে ভালোবাসেন, তাই আমাকে ক্ষমা করে দিন ]। কত সুন্দর সমাধান আল্লাহর রসুল (স:) দশটি জিনিস চাইতে বলেননি। একশ রাকাত নামজ পড়তে বলেননি।

আসলে আমাদের সব ইবাদাতের মূল লক্ষ্য কি। আল্লাহর ক্ষমা লাভ করা। আল্লাহর ক্ষমা পেয়ে গেলে আমাদের দুনিয়া এবং আখেরাতের আর কোন কিছুই লাগবে না। তাই রাসূল (স:) এই দোয়াটাই আমাদেরকে মহিমান্বিত রাত্রিতে বেশী বেশী করে করতে বলেছেন।

সেই সাথে বন্দের এই সময় নামাজ থাকবে না তারা অন্যান্য জিকির-আশকার পাশাপাশি আল্লাহর কাছে হাত তুলো এই দোয়াাটি বেশি বেশি করার মাধ্যমে লাইলাতুল ক্বদরের পুরো ফযিলতটাই আদায় করতে পারবেন। শ্রেষ্ঠ এই মাসে শেষ রাত্রিগুলো আপনার ব্যক্তিগত ক্যানভাস নামাজ, কোরআন তেলাওয়াত, দোয়া জিকির সদগাহ এইসব ইবাদাতগুলো হলো আপনার রং।

হাজার মাসের চেয়েও উত্তম এই রাতটিকে আপনার মনের মত রং দিয়ে রাঙিয়ে দিন। যদি সারারাত শুধু নামাজ পড়ে কাটিয়ে দিতে চান তাতেও কোনো বাধা নেই। যদি একটু আধটু করে ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন এবাদত করতে চান তাতেও কোনো বাধা নেই। এই রাত জুরে গোটা বিশ্বের কানায় কানায় ফেরেশতা দিয়ে ভরে যায়। তারা তাদের রবের এবাদত করতে থাকে।

গুনোগান গাইতে থাকে। দশটি রাত তাদের সাথে যোগদিন। অনন্তকাল এর প্রতিদান উপভোগ করুন। আল্লাহ আমাদের সবাইকে লায়লাতুল ক্বদর পাওয়ার এবং ইবাদত দিয়ে জাগিয়ে তোলার তৌফিক দিন। আমিন।

সংকলনেঃ প্রকাশক, দৈনিক ‘মেহেরপুর প্রতিদিন’