সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা: শিক্ষার্থীদের নয়া বাণিজ্যের কবলে পড়ার আশঙ্কা

সমন্বিত পদ্ধতির পরীক্ষায় নতুন বাণিজ্যের কবলে পড়তে যাচ্ছেন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিচ্ছুরা। আবেদন ফি শিক্ষার্থীপ্রতি এক হাজার টাকা ধার্য করার চিন্তাভাবনা চলছে।

পরীক্ষা সংক্রান্ত কাজের সঙ্গে জড়িতদের মাঝে এই টাকা ভাগ-বাটোয়ারা হবে। চলতি শিক্ষাবর্ষে কৃষি ও কৃষি সম্পৃক্ত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সমন্বিত পরীক্ষায়ও আবেদনকারীদের কাছ থেকে এক হাজার টাকা করে নেয়া হয়।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শিক্ষার্থীদের আর্থিক সাশ্রয় এবং ভোগান্তি হ্রাসে সরকার প্রায় একযুগ ধরে সমন্বিত বা গুচ্ছপদ্ধতির এই ভর্তি পরীক্ষা চালুর চেষ্টা করছে। গত ২৩ জানুয়ারি এক সভায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিরা অভিন্ন পরীক্ষার মাধ্যমে ভর্তির ব্যাপারে নীতিগতভাবে একমত পোষণ করেছেন।

এরপরই ইউজিসির একটি কমিটি এ ব্যাপারে রোডম্যাপ তৈরির কাজ করছে। ইতিমধ্যে প্রস্তুতকৃত এ সংক্রান্ত খসড়া প্রতিবেদনে এক হাজার টাকা আবেদন ফি ধার্য করার প্রস্তাব করা হয়েছে। ভর্তি প্রক্রিয়ায় একজন শিক্ষার্থীর পেছনে এত টাকা ব্যয় হওয়া সম্ভব নয় বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

বরং বেশিসংখ্যক শিক্ষার্থীর পেছনে ব্যয়ের হার কম হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। বেশিরভাগ সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে ৫০০ থেকে ৭৫০ টাকা আবেদন ফি নিয়ে থাকে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ইউজিসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. কাজী শহীদুল্লাহ যুগান্তরকে বলেন, এ মুহূর্তের অগ্রাধিকার হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক ভর্তি পরীক্ষার পরিবর্তে গুচ্ছ বা সমন্বিত পদ্ধতি প্রবর্তন।

এটা সময়ের দাবি। গুচ্ছ বা সমন্বিত পদ্ধতির ব্যাপারে আরও আলোচনায় চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসবে। এ ক্ষেত্রে বাস্তবতার নিরিখেই আবেদন ফি ধার্য করা হবে। আমাদের লক্ষ্য যেহেতু শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সাশ্রয় ও ভোগান্তি থেকে মুক্তি দেয়া হবে। তাই সেটাই আমরা সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেব। এ ক্ষেত্রে মানদণ্ড হবে ন্যায্যতা।

সমন্বিত বা গুচ্ছ ভর্তির বিষয়টি পরীক্ষামূলক প্রয়োগ হয়েছে চলতি শিক্ষাবর্ষে। গত অক্টোবর-নভেম্বরে কৃষি ও কৃষি সম্পৃক্ত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সমন্বিত পরীক্ষা নেয়া হয়। এর অভিজ্ঞতাই দেশব্যাপী পরীক্ষা চালুর ব্যাপারে আগ্রহী করে ইউজিসিকে।

তাছাড়া আগামী বছর সমন্বিত পরীক্ষা চালুর ব্যাপারে ইতিমধ্যে ঘোষণা দিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর চ্যান্সেলর ও রাষ্ট্রপতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে এ ব্যাপারে একাধিকবার তাগিদ দিয়েছেন।

ফলে এ ধরনের পরীক্ষা নেয়ার ব্যাপারে গৃহীত প্রাথমিক সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করতে আগামী সপ্তাহে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিদের নিয়ে ফের বৈঠকে বসছে ইউজিসি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. আখতারুজ্জামান সোমবার বলেন, সমন্বিত বা গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা আয়োজন অসম্ভব কিছু নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিদ্ধান্ত কী হবে- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সিদ্ধান্ত গ্রহণে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন ফোরাম আছে। নিজস্ব নিয়মানুযায়ী সেসব ফোরামে সিদ্ধান্ত হয়। এর চেয়ে বেশি কিছু বলতে তিনি অপারগতা প্রকাশ করেন।

তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এতদিন বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বাধার কারণেই সরকার এবং রাষ্ট্রের অভিভাবকের প্রত্যাশা সত্ত্বেও সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা আয়োজন সম্ভব হয়নি। তবে বেশিরভাগ ভিসি যেহেতু একমত পোষণ করেছেন তাই কেউই স্রোতের বাইরে যাবেন না বলে মনে করেন তারা।

তারা এটাও বলেছেন, যেহেতু কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মাধ্যমে পরীক্ষার পাইলটিং হয়ে গেছে তাই শিক্ষকদের ইতিবাচক মত থাকলে সারা দেশে এটা প্রবর্তন কঠিন কাজ হবে না।

ইউজিসির খসড়া রোডম্যাপে দেখা যায়, ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষ থেকে অনলাইনে ভর্তির জন্য আবেদন নেয়া হবে। একজন শিক্ষার্থী যোগ্যতাসাপেক্ষে ১০টি বিশ্ববিদ্যালয় বাছাই করতে পারবে। পাশাপাশি দেবে বিভাগ বা বিষয় পছন্দ। মোট ১০০ নম্বরের পরীক্ষা হবে। এতে বহু নির্বাচনী এবং সংক্ষিপ্ত উভয় ধরনের প্রশ্ন থাকবে।

প্রস্তাব অনুযায়ী, সারা দেশে একযোগে সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যায়ে দু’দিন সকালে ও বিকালে পরীক্ষা আয়োজন করা হবে। প্রথম দিন সকালে থাকবে বিজ্ঞান অনুষদের পরীক্ষা। এতে পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে রসায়ন, বায়োলজি, জীববিজ্ঞান ও গণিত বিষয় থাকবে। বিকালে চারুকলার চিত্রাঙ্কন পরীক্ষা নেয়া হবে।

বিজ্ঞান ও ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদে ভর্তিচ্ছুদের অতিরিক্ত একটি পরীক্ষা আয়োজন করা হবে। পরদিন মানবিক ও ব্যবসায় অনুষদ বিভাগের পরীক্ষা থাকবে। এ পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে থাকবে বাংলা, ইংরেজি, সাধারণ জ্ঞান।

বিকালে শুধু ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগের জন্য স্বাভাবিক জ্ঞান বিষয়ের টেস্ট নেয়া হবে। এক একটি পরীক্ষার জন্য ১০ সেট প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করা হবে। সেখান থেকে লটারির মাধ্যমে একটি সেট নির্বাচন করে পরীক্ষা নেয়া হবে।

ইউজিসির কর্মকর্তারা জানান, পরীক্ষা সমন্বিত হবে না গুচ্ছ- সেটি এখনও চূড়ান্ত হয়নি। বিদ্যমান ৪৬টি বিশ্ববিদ্যালয় ৬ ধরনের বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন। এগুলো হচ্ছে : সাধারণ, কৃষি, প্রকৌশল, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, মেডিকেল এবং বিশেষায়িত।

এর মধ্যে ১০টি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ৬টি, ১৫টি সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয় আর কৃষি ও কৃষি সম্পৃক্ত বিশ্ববিদ্যালয় ৭টি, যেগুলোয় চলতি শিক্ষাবর্ষের ভর্তিতে পরীক্ষামূলকভাবে সমন্বিত পরীক্ষা নেয়া হয়।

এ ছাড়া মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ৪টি। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে শুধু পোস্ট গ্র্যাজুয়েট শিক্ষা ও গবেষণা হয়ে থাকে। বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে আরও আছে বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস (বিইউপি), বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেরিটাইম বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডিজিটাল ইউনিভার্সিটি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এভিয়েশন অ্যান্ড অ্যারোস্পেস ইউনিভার্সিটি, জাতীয় এবং উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়।

খসড়া প্রস্তাব অনুযায়ী, সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার জন্য একটি ওয়েবসাইট তৈরি করা হবে। ভর্তিচ্ছুরা ওয়েবসাইটে প্রবেশ করে অনলাইনে আবেদন করবেন। তবে গুচ্ছ ভর্তির সিদ্ধান্ত হলে উল্লিখিত বৈশিষ্ট্যে ভাগ করে আবেদন নেয়া হবে।

আলাদা পরীক্ষায় মেধাতালিকা অনুযায়ী নির্বাচিতদের তালিকা ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হবে। ভর্তি সংক্রান্ত কাজের জন্য ঢাকায় বড় কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি অফিস খোলা হবে।

প্রস্তাবে পরীক্ষা আয়োজনের পরিকল্পনায় বলা হয়েছে, ভর্তি পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে মনিটরিং কমিটি গঠন করা হবে। কেন্দ্রীয় কমিটির প্রধান ইউজিসির সদস্য অথবা বড় কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি থাকবেন। অন্য ভিসিরা সদস্য হিসেবে থাকবেন।

সদস্য সচিব ভিসিদের মধ্য থেকে নির্বাচন করা হবে। কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় কমিটিতে প্রশাসনিক এবং কারিগরি কমিটি গঠন করা হবে। ভর্তি প্রক্রিয়া শুরুর আগে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আসন সংখ্যা কেন্দ্রীয় কমিটির কাছে পাঠানো হবে। তার ভিত্তিতে মেধাতালিকা তৈরি করা হবে।

উভয় কমিটির কয়েকজন সদস্য মিলে একটি কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করা হবে। এ কমিটি বিভিন্ন বিষয়ের প্রশ্নপত্র তৈরি, ভিন্ন ভিন্ন গুচ্ছের জন্য শিক্ষার্থীদের কাছে আবেদনপত্র আহ্বান ও যাচাই-বাছাইকরণ, শিক্ষার্থীদের নামের পাশে কোড দেয়া, মেধাতালিকা তৈরি করবে।

এ ছাড়া স্থানীয় কমিটিতে খাতা দেখা এবং ফলাফল প্রক্রিয়ায় সাব-কমিটি গঠন করা হবে। কড়া নিরাপত্তার মাধ্যমে পরীক্ষা আয়োজন করা হবে। পরীক্ষা গ্রহণের আগে এসব কমিটি গঠন করা হবে। অন্যদিকে স্থানীয় কমিটি পরীক্ষা নেয়া, খাতা মূল্যায়নে কোডিং, ফল প্রণয়ন প্রক্রিয়াকরণ ও তা যথাস্থানে পাঠানোর কাজ করবে।

 

 

 

 

 

সুত্র-যুগান্তর