সাব-রেজিস্ট্রার মামুন বাবরের দুর্নীতির ফিরিস্তি!

আলমডাঙ্গার সর্বোচ্চ দুই কর্মকর্তার পক্ষ থেকে সাব-রেজিস্ট্রার মামুন বাবরকে নিয়মিত অফিস করতে আল্টিমেটাম দেওয়ার পর অফিসের অনেকেই মুখ খুলছেন। বেরিয়ে আসছে দুর্নীতিতে আকণ্ঠ ডুবে থাকা মামুন বাবরের সব কুকীর্তির কথা। কিভাবে তিনি আলমডাঙ্গাবাসিকে কল্পনার ক্ষমতার ফানুস দেখিয়ে দাবিয়ে রাখে সেই গল্পও উঠে আসছে নানা লোকের মুখের বর্ননায়।

প্রশ্ন উঠেছে, কি তার ক্ষমতা? কেন তিনি সকালের অফিস বিকেলে আসেন? আর প্রকাশ্যে কিভাবে দুর্নীতির টাকার ব্যাগ গুছিয়ে তিনি অফিস ছাড়েন? আলমডাঙ্গার মানুষ দেখেও কেন না দেখার ভান করে থাকেন? এরকম অনেক প্রশ্ন মানুষের মাথায় মাথায় ঘুরছে। কিন্ত এক অদৃশ্য শক্তির কারণে এর ঠিক উত্তর কেউ খুঁজে পাচ্ছে না।

সাব-রেজিস্ট্রার মামুন বাবরের শক্তির উৎস কোথায় তা কেউ ঠিক মত না জানলেও তার অবৈধ আয়ের কয়েকটি খাত উল্লেখ করেছেন ভুক্তভোগীরা। সূত্র থেকে জানা গেছে, বৃহৎ আলমডাঙ্গা উপজেলার সাব-রেজিস্ট্রি কার্যালয়ে সপ্তাহের তিনদিনে কমপক্ষে তিন‘শ দলিল রেজিস্ট্রি হয়ে থাকে। এরমধ্যে খারিজবিহীন প্রতি দলিল রেজিস্ট্রি করতে তিনি নেন ৬ হাজার টাকা। আবার খারিজবিহীন এই দলিলে অন্য দলিলের রেফারেন্স এলে তার প্রতি দলিল বাবদ দেওয়া লাগে আরো ৬ হাজার টাকা করে। খারিজবিহীন একটি দলিলে যদি আরো অন্য চারটি দলিলের রেফারেন্স আসে তাহলে তাকে দেওয়া লাগে ৩০ হাজার টাকা।

এছাড়া, সার্টিফাইড রেকর্ড বাদে প্রতি দলিলে তাকে দেওয়া লাগে ১ হাজার করে টাকা। সূত্র মতে, দিনের বেশীরভাগ দলিলই সার্টিফাইড রেকর্ড বাদে রেজিস্ট্রি হয়ে থাকে। অনেক দলিল রেজিস্ট্রি হয় খাজনা রশিদ বাদে। এই দলিলেও দেওয়া লাগে ১ হাজার করে টাকা।

এছাড়া, প্রায় প্রতিদিনই বাড়ির দামি জমিকে ধানি জমি দেখিয়ে কম মূল্যের দলিলে রেজিস্ট্রি করা হয়ে থাকে। আর এ ধরনের দলিলে তাকে দেওয়া লাগে মোটা অংকের উৎকোচ। সবেচেয়ে ভয়ংকর পন্থায় টাকা আদায় করেন লেট ফি নামক একটি খাতে। তিনি সকালের অফিসে আসেন বিকেলে। অথচ লেট ফি দিতে হয় দলিল লেখকদের। প্রতি দলিলে তিনি লেট ফি আদায় করেন ১শ টাকা করে।

সূত্র মতে এ ধরনের বিভিন্ন খাতের টাকা সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার সাথে সাথে টাকার ভারে ভারী হয়ে যায় ব্যাগ। তবে সাব-রেজিস্ট্রার মামুন বাবর কারো হাত থেকে সরাসরি টাকা নেন না। টাকা হাতিয়ে নিয়ে ব্যাগ ভরে দেয় অফিসের একজন তার নাম বুলবুল। সাব-রেজিস্ট্রারের বিদায় বেলা এক স্যালুটে বুলবুলের পকেটও ভরে যায় টাকায়।

এসব কথা ছড়িয়ে বেড়ায় আলমডাঙ্গার আকাশে-বাতাসে। ঠিক এমন অবস্থায় টনক নড়েছে উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা নির্বাহী অফিসারের। সময় মত অফিসে না আসা, দুর্নীতিতে ডুবে থাকা ও চরম স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগে সাব-রেজিস্টার মামুন বাবরকে আল্টিমেটাম দিয়েছেন আলমডাঙ্গা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আইয়ুব হোসেন ও উপজেলা নির্বাহী অফিসার লিটন আলী। সময় মত অফিসে না এলে প্রয়োজনে সাব-রেজিস্ট্রি কার্যালয়ে ঢোকার সব পথ বন্ধ করে দেওয়ারও হুমকি দেওয়া হয়। সোমবার বিকেল পর্যন্ত মামুন বাবর অফিসে না আসায় উপজেলার সর্বোচ্চ এই দুই কর্মকর্তা সাব-রেজিস্ট্রি কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নেন।

সাব রেজিস্ট্রার মামুন বাবর সোমবার দিনভর অফিসে আসেননি এই সংবাদ পেয়ে দুপুরের পর থেকে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আইয়ুব হোসেন ও উপজেলা নির্বাহী অফিসার লিটন আলী সাব রেজিস্ট্রি কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নেন। অফিস থেকে কেউ একজন মামুন বাবরকে বিষয়টি গোপনে জানিয়ে দেন। ভয়ে তিনি আলমডাঙ্গায় কারো বাড়িতে আত্মগোপনে থাকেন। বিকেল সাড়ে ৫ টার দিকে উপজেলা চেয়ারম্যান ও নির্বাহী অফিসার এলাকা ছাড়লে ৫ টা ৫০ মিনিটে মামুন বাবর অফিসে ঢোকেন।

এ সময় উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা নির্বাহী অফিসার পুনরায় সাব-রেজিস্ট্রি কার্যালয়ে প্রবেশ করেন। তাঁরা দু‘জনে মামুন বাবরকে সরকারি নিয়মে অফিস করতে আল্টিমেটাম দেন।

জানা গেছে, ঝিনাইদহ জেলার শৈলকূপার বাসিন্দা মামুন বাবর আলমডাঙ্গায় সাব-রেজিস্ট্রার হিসেবে কর্মরত রয়েছেন বেশ কয়েক বছর ধরে। তিনি সপ্তাহে তিনদিন প্রতি সোমবার, মঙ্গলবার ও বুধবার ঝিনাইদহ থেকে আলমডাঙ্গায় এসে দায়িত্ব পালন করেন।

সূত্র জানায়, সাব-রেজিস্টার মামুন বাবরের অফিসে আসার কোন ঠিক-ঠিকানা নেই। তিনি কোন কোন দিন আসেন দুপুরে আবার কোন কোন দিন আসেন বিকেলে। এ নিয়ে প্রশ্ন তুললে তিনি ক্ষমতার অপব্যবহার করেন। তার স্বেচ্ছাচারিতার কাছে অফিসের বেশীরভাগ কর্মকর্তা-কর্মচারী অসহায় হয়ে থাকেন। হাতে গোনা কয়েকজনকে সাথে নিয়ে তিনি দলিল লেখকদের ওপর রীতিমত স্টিমরোলার চালান।

সূত্র জানায়, বছর দুয়েক আগে চরম স্বেচ্চাচারিতা ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে দাড়িয়ে দলিল লেখকরা মামুন বাবরের অপসারনের দাবিতে একটি আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। এতে অচালাবস্থা দেখা দেয় সাব রেজিস্ট্রি অফিসে। কিন্ত মামুন বাবরের ক্ষমতার হাত দীর্ঘ হওয়ায় তাকে কেউ টলাতে পারেনি। তিনি জেকে বসেন অফিসে।

এরপর থেকে তার স্বেচ্ছাচারিতা শতগুণ বেড়ে যায়। তিনি অফিসের কয়েকজন অনুগতকে সাথে নিয়ে বিরাগভাজনদের ওপর স্টিমরোলার চালাতে থাকেন। কোনদিন অফিসে আসেন আবার কোনদিন অফিসে আসেন না। গ্রাম থেকে আসা শত শত নারী-পুরুষ দিনভর অপেক্ষা করে করে শেষ পর্যন্ত বাড়ি ফিরে যান। তিনি কারও কাছে জবাবদিহি করতে রাজি নন। মামুন বাবরের স্বেচ্ছাচারিতা নিয়ে শহরময় আলোচনা হতে থাকে। মামুন বাবরের অদৃশ্য শক্তির কাছে সবাই নত স্বীকার করতে থাকে। দিনের পর দিন চলতে থাকে এভাবেই।

এ ব্যাপারে উপজেলা চেয়ারম্যান আইয়ুব হোসেন বলেন, সাব-রেজিস্ট্রার মামুন বাবরের যত ক্ষমতা থাকে খাকুক। তাকে সরকারি নিয়ম মেনে অফিসে আসতে হবে। না এলে তার বিরুদ্ধে সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হবে। প্রয়োজনে তার জন্য উপজেলার গেইট বন্ধ করে দেওয়া হবে।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার লিটন আলী বলেন, সময় মত অফিসে না এলে আইনানুযায়ী সাব-রেজিস্ট্রার মামুন বাবরের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এ ব্যাপারে সাব-রেজিস্ট্রার মামুন বাবরের মোবাইলে একাধিকবার ফোন করলেও তিনি মোবাইল রিসিভ করেননি।