সামাজিক অনুষ্ঠান হোক লৌকিকতা বিবর্জিত

আমাদের স্বজন মাহবুবুল হক মন্টু ও ফাতেমা বিনতে রাশেদ জ্যোতি দম্পতির একমাত্র সন্তান ফাইয়াজ আবদুল্লাহ সুবর্ণ‘র প্রথম জন্মবার্ষিকী ছিলো এক ডিসেম্বর ২০২২। হোটেল লা-ভোগে ছিলো জন্মবার্ষিকী অনুষ্ঠান। নিমন্ত্রিতও ছিলাম। লৌকিকতা বর্জণ বিষয়টি আগে ভাগেই জানিয়ে দেয়। এই দম্পতির অনুরোধ উপেক্ষা করবো এমন সাধ্যি আমার নেই। কিন্তু বিপাকে পড়লাম অনুষ্ঠানে গিয়ে। অনেকের লৌকিকতা বর্জন বারণ না মানাতে।

কিছুদিন আগে একটি সংবাদপত্রের পাতায় একটি সত্য ঘটনার বিবরণ পড়েছিলাম কোন একজন লেখিকার লেখায়। তিনি ছিলেন ওই ঘটনার একজন প্রত্যক্ষদর্শী। লেখিকা তাঁর এক আত্মীয়ের ছেলের বিয়েতে গিয়েছিলেন নিমন্ত্রিত হয়ে। মেজবান গৃহকর্তা তার নিমন্ত্রণপত্রের শেষে ‘বিশেষ দ্রষ্টব্য’ উল্লেখ করে লিখেছিলেন : ‘সকল প্রকার লৌকিকতা অবশ্যই বর্জনীয়।’

নিমন্ত্রিত বেশীরভাগ মেহমানই নিমন্ত্রণপত্রের নির্দেশ মেনে অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু কেউ কেউ লোক চক্ষু লজ্জার খাতিরে হোক, কিংবা পুরনো অভ্যাসবশত হোক, কিছু না কিছু উপঢৌকন নিয়ে এসেছিলেন। এই বিবাহ অনুষ্ঠানে উপঢৌকন গ্রহন করার কোন টেবিল ছিলো না। তবুও গৃহকর্তা প্রবেশ দ্বারের সামনে দাঁড়িয়ে যে সব মেহমান দাওয়াতপত্রের দ্রষ্ট্রব্যের কথা বা অনুরোধ অগ্রাহ্য করে উপঢৌকন বা উপহার এনেছিলেন- সেগুলো নিজ হাতে এক জায়গায় জড়ো করে রাখছিলেন। যথারীতি খাওয়া-দাওয়ার পরে মেহমানরা যখন গৃহকর্তার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে যাচ্ছিলেন তখন তাদের মধ্যে থেকে যাঁরা উপঢৌকন নিয়ে এসেছিলেন তাঁদের হাতে সেই উপহার সামগ্রী ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। বিস্ময়ে হতবাক সেই মেহমানদের চাহনীর জবাবে তিনি উপহার গ্রহণে স্মীয় অপরাগতার কথা জানিয়ে অত্যন্ত বিনীতভাবে বলেছিলেন ঃ ‘দেখুন যাঁরা আমার অনুরোধ রক্ষা করে কোন প্রকার লৌকিকতা প্রদর্শন করেননি, এই উপহার গ্রহণ করে তাদেরকে আমি অপনাদের সামনে হেয় প্রতিপন্ন বা ছোট করতে পার না’।

উল্লেখিত ঘটনাটি হয়তো সাধারণ, কিন্তু আমাদের বর্তমান সমাজ-প্রেক্ষাপটে বোধকরি এর গুরুত্ব কম নয়। এই ক্ষুদ্র ঘটনাটি থেকে আমাদের অনেক কিছু শিক্ষণীয় রয়েছে বলে আমি মনে করি। আসলে এই লৌকিকতা আমাদের পেয়ে বসেছে। দিন দিন বেড়েই চলেছে অনুষ্ঠান। বিয়ে সাদি ছাড়াও এক সময়ের অপ্রচলিত অনুষ্ঠান নাক ফোঁড়ানো, কান ফোড়ানো, সুন্নতে খাৎনা, জন্মদিবস এখন যেন নিত্যদিনের ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে। অনেকেই যেন এই লৌকিকতার ফ্যাশনে ভুগছে।

প্রথম প্রথম এই লৌকিকতা বিয়ে এবং মুসলমানি দিয়ে শুরু হয়। ক্রমে জন্মদিন, বিবাহ বার্ষিকী, অন্নপ্রাশন বা শিশুর মুখে ভাত, মা মেয়ের নাক ফোঁড়ানি, কান ফোঁড়ানিতেও এই লৌকিকতা চালু হয়। যে যত বড় সরকারী চাকুরে বা ব্যবসায়ী তার বেলা এই লৌকিকতা প্রদর্শন তত বেশি অপরিহার্য হয়ে দাঁড়ায়। তবে ব্যবসায়ীর জন্যে যেমন তেমন, বড় সরকারি আমলার যদি উপরি আয় না থাকে তাহলে তার অবস্থা দাগে পা হওয়ার কথা। ধরা যাক, তিনি বেতন পান পনেরো থেকে কুড়ি হাজার টাকা। এখন প্রতিমাসেই যদি তাকে তিন- চারটে বিয়ে, বৌভাত মুসলমানি, জন্মদিন ও বিবাহ বার্ষিকীর অনুষ্ঠানে যেতে হয় তাহলে তার অবস্থাটা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে সে কথা ভাবতে গেলে আমার কষ্ট হয়। আবার আমাদের মতো নিম্ন্ন মধ্যবিত্ত অথচ সমাজ যাদের ভুল করে মধ্যবিত্ত বলে চিহ্নিত করে, তাদের আয়ের বেলায়ও এ সমস্যা বড় কম গুরুতর নয়। আমার নিজের কথাই বলি। পেশাগত অবস্থানের দিক থেকে আমাকেও অনেকেই মধ্যবিত্ত বলে গণ্য করবেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আমার কোন বিত্ত নেই। অথচ আমিও আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবদের পক্ষ থেকে নানা সামাজিক অনুষ্ঠানে দাওয়াত পাই। সত্যিই বলছি সবগুলো দাওয়াতে আমার পক্ষে যোগদান সম্ভব হয় না। তবে একটা দাওয়াত সাধারণত আমি বাদ দিতাম না। আর সেটা হচ্ছে কারো মৃত্যুর পর চল্লিশা উপলক্ষে ভোজ। এতদিন জানতাম এই অনুষ্ঠানে কিছু দিতে থুতে হয় না। কিন্তু এখন শুনি নিকটাত্বীয় হলে অনুষ্ঠানের ব্যয়ভারে অংশ নিতে হয়। ধর্মীয় দিক থেকে এই অনুষ্ঠান করা নাকি ঠিক না। যারা চল্লিশায় ভুরিভোজ করবেন তারও নাকি পাপির দলে পড়বেন। বিনা টাকায় এই দাওয়াত গেলাও বন্ধ করেছি পাপি না হতে।

কোন বিষয়ে সংবাদ সম্মেলন, কর্মশালা ইত্যাদি বিষয়ে কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান অনেক সময় নির্ধারিত সংখ্যা উল্লেখ করে আমন্ত্রন জানান। সেসব অনুষ্ঠানে গিয়ে বিপাকে পড়ি আমাদের পেশার সহযোদ্ধাদের সংখ্যাতত্ব না মানার কারণে। কাপড়ে মুখ ঢাকতে ইচ্ছে করে যখন দেখি নিমন্ত্রিত না হবার পরেও উপস্থিত সহযোদ্ধা অনুষ্ঠান শেষে এক প্যাকেট খাবারের জন্য ঝগড়া করে।

সামাজিক অনুষ্ঠানের লৌকিকতার ছোঁয়া এখন শহর ছেড়ে গ্রাম জীবনকেউ স্পর্শ করেছে। বিয়ে-শাদিতে উপহার দেয়ার রেওয়াজ গ্রামেও ছিলো কিন্তু সেখানে এখন জন্মদিন ও ম্যারেজ ডে বা বিবাহ বার্ষিকী অনুষ্ঠানের ঢেউও জেগেছে। এখন কি শহর কি গ্রামে, এসব সামাজিক অনুষ্ঠানে কাউকে দাওয়াত দেয়ার অর্থই ধরে নেয়া হয় খাওয়া উঠিয়ে আমন্ত্রিত অতিথিদের থেকে বাড়তি কিছু আশা। এ ধরনের দাওয়াতের কার্ড পেয়ে তাই আজ আর কেউ খুশি হন না, বরং মনে মনে প্রমাদ গোনেন। এই অবস্তায় সবচেয়ে মুশকিলে পড়েন গরীব আত্মীয়রা। তাঁরা আজকাল সাধ্যমত চেষ্টা করেন সেব অনুষ্ঠান বর্জন করতে।

সম্প্রতি মেহেরপুর শহরের হোটেল বাজার একটি পরিবার তাদের প্রথম সন্তানের জন্মবার্ষিকীতে ঢাকঢোল পিটিয় অনুষ্ঠান করে। লৌকিকতাতে বেশ লাভবানও হয়। ছয়মাসের ব্যবধানে ২য় একমাত্র মেয়ের জন্মবার্ষিকী পালন অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিতদের সিকিভাগ অতিথিও উপস্থিত হয়নি। ওই পরিবারটি এনিয়ে বেশ কষ্ট পেয়েছে লাভবান হতে না পারার দুখে।

তথাকথিত এই সামাজিক লৌকিকতা শেষ পর্যন্ত দেখছি অপরাধ বিস্তারেও ইন্ধন যোগাচ্ছে। এক ছিনতাইয়ের সময় দুুই যুবক আটকের খবর ঢাকার সবকটি সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে। ধরা পড়ার পর যুবকদ্বয় পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছে, বন্ধুর জন্মদিনে ভালো একটা উপহার কিনে দেয়ার জন্যেই তারা ছিনতাইয়ের পথ বেছে নিয়েছিল।

যে জন্মদিনের অনুষ্ঠান এখন ভালো মানুষকেউ ছিনতাইকারী বানাচ্ছে তেমন জন্মদিনের অনুষ্ঠান বাদ দেয়া উচিত কিনা সেটা একটু ভেবে দেখা দরকার। ঠিক এমনি করেই ম্যারেজ ডে, মুখে ভাত, নাক ফোঁড়ানী, কান ফোঁড়ানী প্রভৃতি অনুষ্ঠান বাদ দেয়ার কথা ভেবে দেখা দরকার। ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকেও এসব অনুষ্ঠানের কোন মূল্য বা স্বীকৃতি নেই। ছিনতাইকারী যুবকেরা একজনের পকেট থেকে ছিনতাই করেছিল, কিন্তু সমাজের ভদ্রলোকরা সামাজিক ও লৌকিকতার নামে ভদ্রতার ছদ্মাবরণে আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবদের পকেট কাটছে। বড় ব্যবসায়ী, যাদের অঢেল অর্থ আছে তাদের বেলা এ ধরনের লৌকিকতা কোন ব্যাপারই না। যারা সরকারী-বেসরকারী চাকুরে এবং উপরি-টুপরি পান তাদের বেলাও এটা তেমন সমস্যা না। আমাদের মতো যাদের উপরি নাই, সত্যিই বলছি- ঘরের খেয়ে আমরা যারা বনের মহিষ তেড়ে বেড়ায় তাদের জন্য বড় কষ্টের।