স্বজনরা আজও খুঁজে ফেরেন শহীদ হাফিজউদ্দীন ও তাঁর পুত্রের লাশ

কী হৃদয়বিদারক ও মর্মান্তিক সেই দৃশ্য! পাক হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার-আলবদররা সারা দেশের মতো মেহেরপুর জেলার গাংনী থানার বুদ্ধিজীবীদের ঠাণ্ডা মাথায় নৃশংসভাবে হত্যার করে।১৫ আগস্টগভীর রাতেপাকহানাদার বাহিনী একটি ট্রাক নিয়ে মেহেরপুরের গাংনী শহর লাগোয়া চৌগাছা গ্রামে হাফিজউদদীন বিশ্বাসের বাড়িতে হানা দেয়। বাড়িটি চিনিয়ে দেয় স্থানীয় রাজাকাররা। এক ছেলে একরামুল হক-ছোট যুদ্ধে গেছেন। বড়ছেলে বজলুল হক, মেজছেলে সিরাজুল হক মিন্টু, সেজছেলে এমদাদুল হক-বড় বাড়ি ছেড়ে আত্মগোপন করেছেন।বাড়িটি তখন খাঁ খাঁ করছে। অস্ত্র নিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়ে বর্বর-হানাদারের দল। বাইরে দলবল নিয়ে পাহারা দিতে থাকে রাজাকার ও শান্তি কমিটির নেতারা। বাড়ির বারান্দায় ঘুমিয়েছিলেনহাফিজ উদদীন মাস্টার। বর্বরের দল তাঁকে ও তার আত্মীয় গাংনী হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক আবুল হাশেম সরকারকে পিঠমোড়া বেঁধে ট্রাকে তুলে নিয়ে যায় ভাটপাড়া ক্যাম্পে। সেখানে তাদের হত্যা করা হয় এবংহত্যার পর তাদের ছিন্নভিন্ন লাশগুলো কাজলা নদীর তীরে খোলা আকাশের নিচে ফেলে রাখা হয় দু দিন। তারপর ভাসিয়ে দেয়া হয় কাজলার পানিতে। সেদিন যাদের হত্যা করা হয়, তাদের অনেকের লাশ শনাক্ত করা যায়নি, অনেকের লাশ আজও খুঁজে পায়নি তার স্বজনরা। গাংনী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা-শিক্ষক, গাংনী থানার শিক্ষাবিস্তারের পুরোধা-ব্যক্তিত্ব হাফিজ উদ্দিনের মরদেহের হদিস মেলেনিআজও ।
মেহপেুর জেলার গাংনীর হাফিজ উদ্দীন বিশ্বাস ছিলেন জনপ্রিয় শিক্ষক, সমাজসেবক, বিদ্যোৎসাহী ও জনদরদি ব্যক্তিত্ব। তার পৃষ্ঠপোষকতা ও আর্থিক সহায়তায় গড়ে ওঠে গাংনী উচ্চ বিদ্যালয় ও গাংনী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়।ছয় দফা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের সাধারণ নির্বাচন ও মহান মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে তিনি ছিলেন উচ্চকণ্ঠ। এসব আন্দোলন-সংগ্রামে সহায়তা করেছেন, নিজে যুক্ত থেকেছেন।তিনি সরসরি রাজনীতি করতেন না, কিন্তু মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন অসাম্প্রদায়িক মানবিক দর্শনে। তার ছেলে একরামুল হক-ছোট সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন এবং ১০ সেপ্টেম্বর মেহেরপুরের কাঁঠালপোতা গ্রামে এক অপারেশনে রাজাকারদের গুলিতে শহীদ হন। তার লাশও খুঁজে পাওয়া যায়নি। বৈরী রাজনৈতিক পরিবেশেও অদম্য সাহসীহাফিজ উদ্দীন মাস্টারদেশত্যাগ করেননি।তরুণ-যুবক ও ছাত্রদের নিয়ে গড়ে তোলেন একটি বিশেষ সংগঠন।স্থানীয় তরুণদের গোপনে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ দিতেন। তাঁর নেতৃত্বে গাংনীতে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে এক অভূতপূর্ব জাগরণ ঘটে। এসব কাজে তাঁকে সার্বিক সহায়তা করতেন তার আত্মীয় আবুল হাশেম সরকার। তিনি ছিলেন স্কুলের প্রধান শিক্ষক। গাংনী থানার শান্তি কমিটির নেতা ও রাজাকার-আলবদরা বিষয়টি জানতে পেরে হাফিজ উদদীনসহ পাকিস্তানের দুশমন-বুদ্ধিজীবী ও স্থানীয় এলিটদের নিশ্চিহ্ন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। গভীর রাতে রাজাকারদের সহায়তায় পাকসেনারা হাফিজউদ্দীন ও আবুল হাশেম সরকারকে ধরে নিয়ে যায় এবং ভাটপাড়া ক্যাম্পে নৃশংসভাবে হত্যা করে।
শহীদ শিক্ষক হাফিজ উদ্দীনের জন্ম ১৯২০ সালে মেহেরপুর জেলার গাংনী উপজেলার চৌগাছা গ্রামে। তার বাবা আজিজ উদ্দিন বিশ্বাস ছিলেন মেদিনীপুর জমিদারি কোম্পানির গোমস্তা ও জনদরদি ব্যক্তি। মা সবুরা খাতুন ছিলেন পরোপকারী স্বভাবসম্পন্ন। তিনি নদীয়া জেলার শিকারপুর হাইস্কুলে পড়াশুনা করেন এবং ১৯৩৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে এন্ট্রান্স পাস করেন। পারিবারিক সমস্যার কারণে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনার পরিসমাপ্তি ঘটে এবং পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। পিতার মৃত্যুর পর বগুড়া জেলার দুপচাঁচিয়া থানার দারোগার পদ ছেড়ে নিজ এলাকায় শিক্ষাবিস্তারে আত্মনিয়োগ করেন। স্থানীয় বিদ্যোৎসাহীদের সহায়তায় ১৯৪৫ সালে প্রতিষ্ঠা করেন গাংনী হাইস্কুল। যুক্ত হন শিক্ষকতায়। পড়াতেন ইংরেজি ও ইতিহাস। ছিলেন অগাধ পাণ্ডিত্যের অধিকারী ও বিচক্ষণ ব্যক্তি।দায়িত্ব পালন করেছেন অনারারি ম্যাজিস্ট্রেট তথা জুরির হাকিম হিসেবে। অসীম সাহসিকতার অধিকারীহাফিজ উদদীন মাস্টার স্কুলের শিক্ষক-ছাত্রছাত্রীদের বাইরেও ছিলেন প্রভাবশালী ও জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব। সর্বস্তরের মানুষ তাকে সম্মান-শ্রদ্ধা করত, আর পাকিস্তানপন্থি পিস কমিটির নেতা ও রাজাকাররা তাকে প্রতিপক্ষ মনে করত। মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল ভেঙে দেয়ার জন্য রাজাকারদের সহায়তায় পাকসেনারা তাকে হত্যা করে।
শহীদ হাফিজউদদীন ছিলেন বহুগুণে গুণান্বিত এক বিরলপ্রজ ব্যক্তিত্ব। শিক্ষাবিস্তার, জনকল্যাণ ও মুক্তিযুদ্ধেহাফিজউদদীনের অবদান অসামান্য। কিন্তু তাঁর কাজের যথাযথ স্বীকৃতি মেলেনি। তবেরফিকুর রশীদের লেখা আগামী প্রকাশনীর ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ: মেহেরপুর জেলা’ গ্রন্থে হাফিজউদদীনকে ‘ গাংনী থানার শিক্ষাবিস্তারের অগ্রদূত’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত কাজী সাজ্জাদ আলী জহিরের ‘মুক্তিসংগ্রামে মেহেরপুর’ এবং মূর্ধন্য প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত আবদুল্লাহ আল আমিনের ‘ ভাটপাড়া নীলকুঠি ও উনিশ শতকের বাংলাদেশ’ গ্রন্থে (ফেব্রুয়ারি, ২০১৯) শিক্ষক হাফিজউদদীনকে শহীদ বুদ্ধিজীবী হিসেবে উল্লেখ করা হয়। ১৯৯৫ সালে গাংনী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সুবর্ণজয়ন্তীতে এই ‘অমিততেজা সিংহপুরুষ’কে মরণোত্তর সম্মাননা দেওয়া হয়।শহীদ হাফিজউদদীন এবং একাত্তরের ১৫-আগস্টের শহীদদের স্মৃতি রক্ষার্থে ভাটপাড়ায় মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে, চলছে বধ্যভূমি সংরক্ষণের কাজ।
শহীদ হাফিজউদদীনের স্ত্রী সাকিনা বেগম,বড়ছেলে রাজনীতিক-সমাজসেবক-বিদ্যোৎসাহী বজলুল হক, সিরাজুল হক ও বড়মেয়ে মারা গেছেন। তার চতুর্থ পুত্র একরামুল হক ছোটন মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হন। তাদের তিন ছেলে ও তিন মেয়ে বেঁচে আছেন। এরা সবাই শিক্ষিত ও সরকারি চাকুরে। ছোটছেলে গাংনী ডিগ্রি কলেজের শিক্ষক শহীদুল হক বলেন, ‘ মুক্তিযুদ্ধের সময় আমি ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়তাম। মুক্তিযুদ্ধে আমার বাবা, মামা ও এক ভাই শহীদ হন। দেশের জন্য আমাদের পরিবার অনেক কষ্ট ও দুর্ভোগ সহ্য করেছে। কিন্তু তাঁদের আত্মত্যাগের কোনো রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি মেলেনি। তাদের নামে এলাকার কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সড়ক বা স্থাপনার নামকরণ করা হয়নি। এ জন্য আমি মর্মাহত এবং গ্লানিবোধ করি।’ পঞ্চম পুত্র শিক্ষক এনামুল হক বলেন, বাবা ছিলেন প্রগতিশীল চিন্তার মানুষ। ছিলেনমওলানা ভাসানী ও বঙ্গবন্ধুর একনিষ্ঠ অনুসারী।উদার-অসাম্প্রদায়িক চিন্তার মানুষ হিসেবে তিনি কোনোদিন সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দল সমর্থন করেননি। আমাদের পরিবারের সবাই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। রাজনৈতিক কারণে স্থানীয় শান্তি কমিটির নেতা ও রাজাকাররা বাবার উপর ক্ষিপ্ত ছিলেন। রাজাকারদের প্রত্যক্ষ মদতে পাক হানাদার বাহিনী বাবাকে হত্যা করে। তিনি দেশের জন্য শহীদ হয়েছেন। বাবার সাহসিক আত্মত্যাগের জন্য আমরা গর্ব অনুভব করি।

লেখক: মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক ও সহযোগী অধ্যাপক, মেহেরপুর সরকারি কলেজ।