এম এ এস ইমন

হযরত ইব্রাহীম (আ:) , পর্ব-১

আবুল আম্বিয়া নবীদের পিতা খালিলুল্লাহ আল্লাহর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ইতিহাসের এমন এক ব্যক্তি যিনি ইসলাম, খ্রীষ্ট , ইহুদি তিনটি ধর্মেই সম্মানিত। যে ব্যক্তি মুসলিম জাতির পিতা যার বংশধরদের মধ্যে থেকে বেছে নিয়েছেন বহু নবী-রাসূল এবং যার বংশধরদের মধ্যে থেকেই জন্ম নিয়েছেন সর্বকালের শ্রেষ্ঠ মানব শ্রেষ্ঠ নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। সে ব্যক্তির নাম ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম। প্রত্যেকের জীবনেই আমরা নানা ধরনের বাধা-বিপত্তির সম্মুখীন হই, পরীক্ষার মুখোমুখি হই। অনেক পরীক্ষায় আমরা সফল হই। আবার অনেক পরীক্ষায় ব্যর্থ হই এবং সেই ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নেয়ার চেষ্টা করি। আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়ার চেষ্টা করি। ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম ছিলেন এমন একজন ব্যক্তি, যার সামনে আল্লাহ একের পর এক কঠিন থেকে কঠিনতর পরীক্ষা রেখেছেন এবং প্রতিটি পরীক্ষাতেই তিনি পরিপূর্ণভাবে সফল হয়েছেন।

আমাদের জীবনে যদি কোনো দুশ্চিন্তা থেকে থাকে, দুঃখ কষ্ট থেকে থাকে, আমরা যদি ইব্রাহিম আলাইহিস সালামের জীবনের দিকে তাকাই আমরা দেখব তিনি যেভাবে পরীক্ষিত হয়েছিলেন। তার তুলনায় আমরা আলহামদুলিল্লাহ অনেক অনেক আরাম-আয়েশে জীবন-যাপন করছি এবং তার জীবন থেকে আমরা এটাও বুঝবো যে কারো জীবনে বেশি বেশি বাধা-বিপত্তি আসা মানে এই নয় যে আল্লাহ তার ওপর রেগে আছেন। বরং এমনও হতে পারে যে আল্লাহ তাকে এত বেশি ভালোবাসেন তার ঈমানের প্রতি আল্লাহর এতটা আস্থা রয়েছে যে আল্লাহ তার সামনে বিভিন্ন পরীক্ষা রেখেছেন। যেন সেই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয় সে আল্লাহর আরো কাছে চলে আসে। ঠিক যেমন ইবরাহীম আলাইহিস সালাম তার দৃঢ় ঈমানের পরিচয় দিয়ে খলিল্লুাহ বা আল্লাহর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধু আবার মর্যাদা পেয়েছিলেন। যে ব্যক্তি পৃথিবীর বুকে এক আল্লাহর এবাদত করার দিন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। যার সন্তানেরা সেই বাণী প্রচার করে গেছেন হাজার হাজার বছর ধরে। এ এক আশ্চর্য বিষয় যে সে ব্যক্তিটি জন্মগ্রহণ করেছিলেন এমন এক সমাজে যাকে বলা যেতে পারে শিরকের এক আখড়া। তাঁর জন্মস্থান নিয়ে কিছুটা মতপার্থক্য রয়েছে।

তবে অনেক স্কলারদের মতে তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন প্রাচীন ব্যাবিলন বা ব্যাবিলন শহরের তুড় পাহাড়ের অঞ্চলে। যা বর্তমান সময়ের ইরাকের ইল্লাহ শহরে অবস্থিত। আল হাকিমের হাসিদে বর্ণিত রয়েছে, রাসূল সাঃ কে যখন জিজ্ঞেস করা হয়েছিল নূহ (আ) ইব্রাহিম (আ:) এর মধ্যে গত বছরের ব্যবধান ছিল তিনি বলেছিলেন ১০ প্রজন্ম। যা অনেকে অনুমান করেন প্রায় ২ হাজার বছরের সমান। অন্যদিকে আততাইর বর্ণনা অনুযায়ী ইবরাহীম আলাইহিস সালাম এর ইছা (আ:) এর মধ্যে আনুমানিক ২ হাজার বছরের ব্যবধান রয়েছে। সেটা যদি সঠিক হয়ে থাকে এবং এই বিষয়গুলোর ব্যাপারে পরিপূর্ণ জ্ঞান একমাত্র আল্লাহর কাছে রয়েছে। তাহলে ইবরাহীম আলাইহিস সালাম প্রায় চার হাজার বছর আগে প্রাচীন মেসোপটেমিয়া বাবিল শহরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। ইবনে কাছির তার আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া গ্রন্থে উল্লেখ করেন যুবহুর ওলামাদের মতে ইবরাহীম আলাইহিস সালাম এর পিতার নাম ছিল আহলে এবং আহলে কিতাবরা উচ্চারণ করাত তালেহক। তার আরও একটি প্রচলিত নাম আছে যা হলো আযাহার এবং এই নামটি পবিত্র কুরআনে এসেছে।

কোন কোন স্কলারদের মতে তালেহ ছিল মেসোপটায়িম রাজ্যের প্রখ্যাত পুরোহিত এবং সে মূর্তি নির্মাণের জন্য বিখ্যাত ছিল। এর মধ্যে একটি দেবতা ছিল যার নাম দেয়া হয়েছিল আযাহার এবং তালেহ সেই দেবতার প্রতি বিশেষভাবে আকৃষ্ট ছিল বিধায় তালেহ মানুষ আযাহার ডাকত। প্রাচীন সেই বাবলিন শহরে ততদিনে শিরহক ছড়িয়ে পড়েছিল পুরোদমে। এরকম এর শিরহকের প্রাণকেন্দ্রে শহরের সবচেয়ে সুপরিচিত ভাস্করের ঘরে জন্মগ্রহণ করে এক ফুটফুটে শিশু। শৈশব থেকেই তার কৌতূহলের কোন অভাব ছিল না। চারপাশে যা কিছু ঘটছে তা নিয়ে চুপচাপ বসে ভেবে দেখার অভ্যাস ছিল। সে যত বড় হতে লাগল তত ভাবতে লাগল এইযে, আমার বাবা নিজ হাতে পাথর জোগাড় করে এনে ভাস্কর্য তৈরি করেন। সেই ভাস্কর্য আবার দেবতা হয় কি করে। আমার বাবা যাকে নিজ হাতে সৃষ্টি করলো সে আবার আমার বাবাকে সৃষ্টি করলো কি করে। এই প্রশ্নগুলোর জবাব কখনোই তার কাছে মেলেনি। তাকে শুধু বলা হতো এটাই আমাদের হাজার বছরের সংস্কৃতি। আমাদের পূর্বপুরুষেরা এভাবে ইবাদত করতেন। তাই আমরাও এভাবেই এবাদত করি। সামাজিকভাবে আযাহারের সন্তান সম্মানিত অবস্থানে পৌঁছানো খুব সহজ ছিলো। সে বিখ্যাত পুরোহিত আযাহারের সন্তান।

এই পরিচয়েই আরাম-আয়েশে তার জীবন কাটিয়ে দিতে পারত। কিন্তু সে সেই পথ বেছে নেয়নি বরং জীবনের উদ্দেশ্য নিয়ে ভাবতে লাগল এবং সামাজিক প্রথা গুলো নিয়ে প্রশ্ন করতে লাগল। এবং এই প্রশ্নগুলো নিয়ে ভাবতে ভাবতে নির্জনে ধ্যানে মগ্ন থাকতে থাকতে এক পর্যায়ে তার কাছে আল্লাহর পক্ষ থেকে ওয়াহি নাযিল হয়। ইবরাহীম আলাইহিস সাল্লাম নবুওয়াত লাভ করেন। নবুয়ত লাভ করার পর ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম তার সমাজের মানুষদের কাছে যৌক্তিকভাবে এক আল্লাহর এবাদত করার আহ্বান জানাতে লাগলেন। এবং ইব্রাহিম আলাইহিস সাল্লাম বিশেষভাবে তার পিতা আযাহারকে ইসলামের দাওয়াত দিতে থাকলেন। আমরা দেখি যে ইব্রাহিম আলাইহিস সাল্লাম তার বাবাকে অত্যন্ত সম্মানের সাথে, শ্রদ্ধার সাথে ইসলামের পথে আহবান করে গেছেন। এবং ইবরাহীম আলাইহিস সালাম তখন পুরোপুরি নিশ্চিত যে, তিনি ছিলেন তবুও তিনি সঠিক ছিলেন। তার বাবাই ভুল পথে ছিল। তবুও তিনি রাগ বা বিরক্তি প্রকাশ করেননি বরং ধৈর্য্যরে সাথে তাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন। কিন্তু ছেলের এমন আন্তরিক আবেদন আযাহারের হৃদয় হৃদয় ¯পর্শ করল না। হতে পারে সে সময়কার সবচেয়ে প্রখ্যাত পুরোহিত এবং মূর্তি নির্মাণকারী হিসেবে তার কাছে সামাজিক স্ট্যাটাস বড় ছিল। তার ছেলের আবেদনে অতিষ্ঠ হয়ে আযাহার বলল: ইব্রাহিম তুমি কি আমার দেবতাদের কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছ? তুমি যদি এসব কর্মকান্ড বন্ধ না করো তোমাকে আমি পাথর মেরে তোমার মাথা ফাটিয়ে দেবো। আমার সামনে থেকে চিরতরের জন্য দূর হয়ে যাও। আমরা গল্প শোনার সময় এটা সচরাচর চিন্তা করিনা গল্পের মানুষদের সাথে যা ঘটছে তা আমার সাথে করলে কেমন হতো।

একবার চিন্তা করে দেখুন, আপনি সোশ্যাল মিডিয়াতে কোরআনের একটি আয়াত শেয়ার করলেন আর সেখানে হাজারো এংরি রিয়াক্ট। শত শত আক্রমনান্তক মন্তব্য আপনার পাশে দাঁড়ানোর মত একটা মানুষ নেই। এমন অবস্থায় যেই না আপনি ভাবছেন অন্তত আপনার পরিবারের মানুষ আপনার নিজের বাবা-মা আপনাকে বুঝবে। আপনি যে পথে আছেন সেটাকে সাপোর্ট করবেন। অমনি যদি তারাও আপনাকে গালমন্দ করে আর বলে পাথর মেরে আপনার মাথাটা ফাটিয়ে দেবে এবং আপনাকে বলে চিরতরের জন্য দূর হয়ে যেতে। আপনার তখন কেমন লাগতো, কতটা ক্ষোভ, কতটা হতাশা, কতটা অভিমান জমা হতো আপনার মনে। অথচ এরকমই এক অবস্থায় ইব্রাহিম আলাইহিসালাম তার বাবাকে অত্যন্ত সম্মান সহকারে বললেন: একদিন বড় এক উৎসব পালন করা হবে, সেখানে হাজির হবে শহরের সব মানুষ। আযাহারও সেখানে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত। কিন্তু উৎসবের ঠিক আগে ইব্রাহিম আলাইহিসালাম তাকে জানালেন তার অসুখ। তাই তিনি তাদের সাথে যেতে পারবেন না। বাস্তবে ইবরাহীম আলাইহিস সালামের একটি বিশেষ পরিকল্পনা ছিল। শিক্ষকতার একটি নীতি হলো কোনো মুখে বোঝালে শিক্ষার্থীর না বুঝে তাহলে তাকে এক্সপেরিমেন্ট বা প্রাক্টিক্যাল দেমনস্ট্রেশন এর মাধ্যমে বোঝানো উচিত। (চলবে..)

সংকলনে: প্রকাশক, মেহেরপুর প্রতিদিন