
মেহেরপুরের বাতাসে যেন নীরবে মিশে গেছে এক নীলচে ধোঁয়া, যার নাম যক্ষার জীবাণু। এক সময়ের ‘সস্তায় চিকিৎসা সম্ভব’ এমন একটি রোগ এখন হয়ে উঠেছে ভয়াল। সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক এই নীরব শত্রুর শিকার হচ্ছে শিশুরা। আক্রান্তদের শতকরা ৭০ ভাগই শিশু।
মেহেরপুর টিবি ক্লিনিকের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০২৪ সালে জিন এক্সপার্ট পরীক্ষায় ১৪৭ জন যক্ষায় আক্রান্ত রোগীর সন্ধান মিলেছে। তার মধ্যে ৭৬ জনই শিশু। অর্থাৎ প্রতি ১০ জন রোগীর মধ্যে ৭ জন শিশু! গত ১০ বছরের মধ্যে ২০২৩ সালে মাত্র ২৪ জনের শরীরে যক্ষার জীবানু সনাক্ত হয়। এবং ২০২২ সালে ১৯জন শিশুর শরীরে পাওয়া যায় এই মরণ ব্যাধির জীবানু।
একটি শিশুর যখন যক্ষা ধরা পড়ে, তার মুখে নয়, চোখে কথা বলে ক্লান্তি, ক্ষীণতা ও নিঃশব্দ এক আর্তনাদ। কিন্তু চারপাশে তখনও চলতে থাকে অবাধ মেলামেশা, গোপনে গিলে ফেলা হয় তথ্য। অভিভাবকরা লজ্জায়, ভয় আর সামাজিক অপবাদে রোগ লুকিয়ে ফেলেন। এভাবে একে একে আরও শিশুরা হয়ে পড়ে সংক্রমণের শিকার।
মেহেরপুর জেলার স্বাস্থ্য বিভাগ বলছে রোগ গোপন রাখার কারণে কতজন আক্রান্ত, তার সঠিক কোনো হিসেব নেই। প্রতিবছরের রিপোর্টে রোগীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে, কিন্তু এর সঠিক বিস্তার নিয়ে নেই কোনো সুপরিকল্পিত পদক্ষেপ।
মেহেরপুর টিবি হাসপাতালের একজন কর্মকর্তা জানান, একেকজন রোগীকে অন্তত দুই মাস ধরে হাসপাতালে রেখে চিকিৎসা দিলে তারা সুস্থ হতে পারে। কিন্তু জেলা পর্যায়ে চিকিৎসা কেন্দ্রে বেড নেই। অনেককে বাড়িতে যেয়ে ওষুধ খাইয়ে আসতে হয়। অনেকে জেলার বাইরে চলে যান। তাদের নেই ওষুধের সঠিক প্রয়োগের নিশ্চয়তা। ফলে অনেকেই মাঝপথে থেমে যান চিকিৎসা বন্ধ করে দেন, জীবাণু ছড়িয়ে দেন আরও দশজনের শরীরে। মৃত্যুর সঠিক সংখ্যা নির্ধারণের কোনো ব্যবস্থা না থাকলেও যেসব রোগী চিকিৎসা নিচ্ছেন, তাদের মধ্যেও প্রায় ২০ শতাংশ শেষরক্ষা পান না।
শুধু যক্ষা নয়, এখন যক্ষার এক ভয়াবহ রূপ দেখা দিয়েছে। ৫ জন রোগীর শরীরে পাওয়া গেছে মাল্টি ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট (এমডিআর) যক্ষা। এই রোগে আক্রান্তরা সাধারণ ওষুধে সাড়া দেয় না। তাদের শরীরের জীবাণু এমন এক প্রতিরোধ গড়ে তোলে, যা যক্ষা নির্মূলের পথ রুদ্ধ করে দেয়।
টিবি ক্লিনিকের চিকিৎসক মোহসীনা ফেরদৌস মিষ্টি বলেন, “মানুষ এখন আগের চেয়ে অনেক সচেতন। সন্দেহ হলেই হাসপাতালে এসে পরীক্ষা করাচ্ছেন।” তবে এতটুকু সচেতনতা যথেষ্ট নয় যদি না শিশুদের নিয়ে বাড়তি উদ্যোগ নেয়া হয়।
মেহেরপুরের কোনো এক শিশুর বুকের কাশিতে যখন গলা কাঁপে, তখন সমাজ কেবল তাকিয়ে থাকে। এখন দরকার তাকিয়ে থাকা নয় জেগে ওঠা। প্রয়োজন সচেতনতা, চিকিৎসার নিশ্চিত ব্যবস্থা এবং সবচেয়ে বড় কথা রোগ লুকিয়ে না রেখে লড়াই শুরু করা। কারণ, একটি শিশুর মুখে যখন হাসি ফোটে না, পুরো সমাজের মুখেই ছায়া নেমে আসে।
লেখক, সাংবাদিক