ফেসবুকের নীল পর্দা স্ক্রল করতে করতে হঠাৎ চোখ আটকে গেল। নিউজফিডে ভেসে উঠলো দুটি পরিচিত মুখ—আমাদের প্রিয়, শ্রদ্ধেয়, এখন আর না-ফেরা মানুষ—প্রয়াত আব্দুর রশিদ স্যার এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল কাশেম স্যার। যেন সময় এক মুহূর্তের জন্য থেমে গেল। ছবিগুলোর দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে স্মৃতির কুয়াশা ভেদ করে ফিরে এল বহু বছরের জমে থাকা মধুর সময়গুলো।
এই দুই গুণী মানুষের সাথে আমার সম্পর্ক শুধু পরিচয়ের গণ্ডিতে আটকে ছিল না—ছিল একসাথে হাসি, গল্প, আড্ডা আর অসংখ্য অমূল্য মুহূর্ত ভাগ করে নেওয়ার সৌভাগ্য। আজ সেই অমলিন স্মৃতির কিছু খণ্ডচিত্র তুলে ধরতে বসেছি।
**স্মৃতির পথে পথে**
গাংনী উপজেলায় দি হাঙ্গার প্রজেক্ট বাংলাদেশের আয়োজনে “কমিউনিটি ফিলানথ্রপি” কর্মসূচি ছিল আমাদের মিলনমেলা। দুই মাস অন্তর আমরা যেতাম যশোর আরআরএফ ট্রেনিং সেন্টারে—কখনো ট্রেনে, কখনো বাসে, কখনো মাইক্রোতে। পথে ক্লান্তি বলে কিছু ছিল না।
মাইক্রোবাস ভর্তি প্রাণবন্ত মুখগুলো লুৎফুন্নেছা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সৈয়দ জাকির হোসেন স্যার, করমদি ডিগ্রি কলেজের শিক্ষক আবু সাদাদ মোহাম্মদ সায়েম পল্টু, মানিকদিয়া গ্রামের বীরমুক্তিযোদ্ধা ও কবি মোজাম্মেল হক, রাজনীতিক লাইলা আরজুমান বানু আপা, মনিরুজ্জামান আতু ভাই, আর দুই প্রিয় সঙ্গী—আবদুর রশিদ স্যার ও আবুল কাশেম স্যার।
যাত্রাপথ মানেই ছিল হাসি, ঠাট্টা আর গল্পে ভরা এক উৎসব। পল্টু স্যারের রসিকতা, জাকির স্যারের মজার উপমা, কাশেম স্যারের তীক্ষ্ণ জবাব—সব মিলিয়ে সময় যেন উড়ে যেত। আর এইসব প্রাণোচ্ছ্বল মুহূর্তের মাঝেই আব্দুর রশিদ স্যার থাকতেন নীরব শ্রোতা। মাঝেমধ্যে হাসির গল্পের পুনরাবৃত্তি চাইতেন, আর বাকিদের উল্লাস দেখে মৃদু হেসে চুপচাপ থাকতেন। তার নীরবতাতেও ছিল এক ধরনের উষ্ণতা।
**আব্দুর রশিদ স্যার ছিলেন—হিসেবী, প্রতিবাদী, সৎ, অনুসন্ধিৎসু, সময়ানুবর্তী ও অত্যন্ত সৎ মানুষ। দেনাপাওনার হিসাব সঙ্গে সঙ্গে মিটিয়ে ফেলতেন। তার পোশাক-পরিচ্ছদে ছিল নিজস্ব আভিজাত্য—পাঞ্জাবি-পাজামা, কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ। শুনেছি, বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে বাম রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন—তার স্টাইলেও ছিল সেই ছাপ।
ফেসবুকে তার পোস্টগুলো কখনো কবিতার মতো কোমল, কখনো রাজনৈতিক প্রবন্ধের মতো তীক্ষè। অন্যায়ের বিরুদ্ধে নির্ভীক কণ্ঠস্বর ছিলেন তিনি। এজন্য সমালোচনা, এমনকি হুমকিও সহ্য করতে হয়েছে, কিন্তু সত্য বলার সাহস কখনো হারাননি।
তিনি প্রযুক্তির সাথেও ছিল ভীষণ সখ্য। অ্যান্ড্রয়েড ফোনে সাহিত্যকর্ম লিখতেন, নতুন কোনো অপশন বা যুক্তাক্ষর লিখতে না পারলে ফোন দিতেন—“ভাই, এটা কিভাবে করবো?”
ঢাকার দেয়াল বনাম গ্রামের মুক্ত বাতাস :
ঢাকায় থাকার সময় ফোন করে বলতেন—
“ছোট ভাই, এই চার দেয়ালের মধ্যে ভালো লাগে না।”
আমি মজা করে বলতাম—
“স্যার, আপনি শহরের কোলাহল ছেড়ে চলে আসেন গ্রামীণ মুক্ত বাতাসে। যেখানে ধানের শীষ দোলে, পাখি গান গায়, খালের পানি ছুটে চলেৃ”
তিনি মুচকি হেসে বলতেন—
“আমার তাপুর মেয়েটার জন্য থাকতে হচ্ছে। ওকে দেখবে কে?”আমার লেখার পাঠক :
আমি যখন কোনো গান বা কবিতা ফেসবুকে দিতাম, তিনি সবার আগে পড়তেন এবং প্রশংসা করতেন—হয়তো উৎসাহ দেওয়ার জন্যই। একদিন বলেছিলাম—
“স্যার, আপনার লেখা বই আকারে বের করুন।”
তিনি রাজি হয়েছিলেন। পরে অগ্নি যুগের অগ্নি সেনা প্রকাশ করলেন । দুর্ভাগ্যবশত, সেই প্রকাশনা উৎসবে আমার থাকা হয়নি—সেই আফসোস আজও রয়ে গেছে।
শেষ কথা
আজ শুধু আব্দুর রশিদ স্যার নয়, আবুল কাশেম স্যার, সিরাজুল ইসলাম স্যার, মোজাম্মেল হক আঙ্কেল, জাকির স্যার, পল্টু স্যার—সবাই আমার জীবনে কখনো বাবার মতো, কখনো বন্ধুর মতো, কখনো অভিভাবকের মতো ভালোবাসা দিয়ে গেছেন।
যারা বেঁচে আছেন—তাদের জন্য সুস্থতা ও দীর্ঘায়ূ কামনা করছি। আর যারা চলে গেছেন তাদের জন্য দোয়া করছি, আমিন।
(অসমাপ্ত স্মৃতিচারণ)