অনন্তলোকে যাত্রাশিল্পী আক্কাস আলী

গ্রিনরুম থেকে বেরিয়ে ধীর পায়ে এগিয়ে দক্ষিণমুখো হয়ে একটি শাদা রঙের দেওয়ালের সামনে এসে দাঁড়ালেন যাত্রানট আককাছ আলী। দেওয়ালে ঝুলছে রবীন্দ্রনাথ, গিরীশ ঘোষ, কাজী নজরুল ইসলাম এবং যাত্রাসম্রাট অমলেন্দু বিশ্বাসের আবক্ষ প্রতিকৃতি। আককাছ আলী চক্ষু বুজে বেশ কিছুক্ষণ ধ্যানমগ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন সেই ছবিগুলোর সামনে।

তার পায়ে ফিতে বাঁধা জুতা, ভেলভেটের ট্রাউজার্স, পুরো হাতা শাদা জামা, তার দু’ কবজির কাছে কুচি দেওয়া, মাথায় পরচুলা, কুঞ্চিত কেশ ঘাড় পর্যন্ত নেমে এসেছে। কাঁচা-পাকা গোঁফ রং মাখিয়ে কুচকুচে কালো করা হয়েছে, মুখে জরির আভা, একেবারে পাক্কা সেনাপতি। কোমরবন্ধে তলোয়ার। প্রায় পঞ্চান্ন বছর বয়সে দর্শকভর্তি প্যান্ডেলে আককাছ আলীকে আবার এক অগ্নি পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। প্রথম যৌবন থেকে বিভিন্ন মঞ্চে এমন কত পরীক্ষা যে তাকে দিতে হয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই! কখনও স্কুল-কলেজের নাট্যমঞ্চে, কখনও যাত্রার আলোকোজ্জ্বল রঙ্গমঞ্চে। দেবী সুলতানায় কখনও আলীবর্দি, কখনও-বা হাজি মোল্লা সরাফ হয়ে মঞ্চে উঠেছেন। নাচমহলে দবির খাঁ, অশ্রু দিয়ে লেখায় মাসুদ খাঁ সেজেছেন।

সিরাজ উদ দৌলায় সেজেছেন কখনও মোহনলাল, কখনও ওয়াটস। আবার কখনও-বা সেনাপতি মীরজাফর হয়ে। বিখ্যাত চলচ্চিত্র অভিনেতা আনোয়ার হোসেনের সঙ্গে এক মঞ্চে একই সঙ্গে সিরাজ উদ দৌলা পালায় পার্ট করেছেন। কোনো পরীক্ষায় তিনি সম্পূর্ণ ব্যর্থ হননি। মঞ্চে উঠলে কেমন যেন অন্যরকম হয়ে উঠতেন তিনি। তার রক্ত টগবগ করে ফুটতে থাকে। হয়ে উঠতেন রাজাধিরাজ । রঙ্গমঞ্চের সেই রাজাধিরাজ সব কাজ সারা করে গতকাল ১৬ ফেব্রুয়ারি ভোরের আলো ফোটার আগেই তারাভরা আকাশকে বিদায় জানিয়ে অনন্তলোকে পাড়ি জমিয়েছেন।

আককাছ আলি ছিলেন পেশাদার যাত্রা-অভিনেতা মানে প্রফেশনাল যাত্রাশিল্পী। পরিবর্তিত পরিস্থিতি ও যাত্রাশিল্পের সার্বিক সংকটের কারণে তিনি পেশাদারি মঞ্চ ছাড়েন নব্বই দশকের প্রারম্ভে। কিন্তু যাত্রা ছাড়েননি আমৃত্যু। দুঃখ-দারিদ্র্য, শোকতাপ, ঝড়বৃষ্টি কোনো কিছুই তাকে রঙ্গালয়-বিমুখ করতে পারেনি। কারণ তার যত আনন্দ, যত খ্যাতি-পরিচিতি সব-ই তো রঙ্গালয় ও রঙ্গমঞ্চকে ঘিরে! সে জন্য রঙ্গালয়-ই ছিল তার প্রাণভোমরা– প্রিয়তম জায়গা। বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী এই শিল্পী ছিলেন একাধারে সুঅভিনেতা, নির্দেশক, মঞ্চপরিকল্পক ও নাট্যসংগঠক। যাত্রা জগতে তার কদর ছিল; ছিল দারুণ সমাদর। তাই কখনও মেহেরপুর জেলা শিল্পকলা একাডেমি, কখনও সাহারবাটী নবকল্লোল অপেরা, আবার কখনও গাংনী বৈশাখী নাট্যগোষ্ঠীর হয়ে অভিনয় করতে হত।

এমনকি চুয়াডাঙ্গা ও ঝিনাইদহ জেলার কোনো অখ্যাত, নামগোত্রহীন যাত্রাদল থেকে ডাক আসলেও সাড়া না দিয়ে পারতেন না। মেহেরপুর জেলার সৌখিন যাত্রাদলগুলিতে তার ছিল দারুণ কদর। আককাছ আলির জন্ম ১৯৫৪ সালে রাজবাড়ি জেলার বালিয়াকান্দি উপজেলার বহরপুর গ্রামে। পিতা আতর আলি ছিলেন একজন কৃষক। তিনিও জারি গাইতেন, ভালবাসতেন যাত্রাপালা দেখতে। পড়ালেখার জন্য পুত্র আককাছ আলিকে তিনি বহরপুর প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি করে দেন।

১৯৭৩ সালে বহরপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করেন। ভর্তি হন বালিয়াকান্দি কলেজে। কিন্তু ব্যক্তিগত অনাগ্রহ ও গান-বাজনার প্রতি অত্যধিক ঝোঁকের কারণে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশুনার পাট চুকে যায় উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা পাসের আগেই। প্রয়োজনের তাগিদে বাবার সঙ্গে ব্যবসা ও চাষবাসে লেগে যান। পাশাপাশি চলতে থাকে নাটক-থিয়েটার ও গানবাজনা।

১৯৭৬ সালে তিনি দেশপ্রিয় নাট্যসংস্থায় পেশাদার অভিনেতা হিসেবে যোগদান করেন। তারপর যাত্রা ও অভিনয়মঞ্চ হয়ে ওঠে তার ধ্যানজ্ঞান। বিভিন্ন প্রফেশনাল অপেরা থেকে তার ডাক আসতে থাকে। বাড়তে থাকে কদর। এরপর আর তাকে পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। বাবুল অপেরা, মধুমতী অপেরা, গীতাঞ্জলি অপেরা, নবরঞ্জন অপেরা, চৈতালী অপেরার মত স্বনামধন্য অপেরায় তিনি পেশাদার অভিনেতা হিসেবে মোটা মাইনেতে কাজ করতে থাকেন। কাজ করেন অতুলপ্রসাদ, রত্্েনশ্বর চক্রবর্তী, নলেশ গুহর মত খ্যাতিমান যাত্রানটদের সঙ্গে। আশীর্বাদ লাভ করেন যাত্রাসম্রাট অমলেন্দু বিশ্বাসের। গত শতাব্দীর নব্বই দশকের মাঝামাঝিতে প্রফেশনাল যাত্রাদলগুলিতে আর্থিক ও ব্যবসায়িক মন্দা দেখা দিলে, সম্পৃক্ত হন সৌখিন দলে। অল্প সময়ের মধ্যে এলাকার বিশেষত গাংনী-মেহেরপুরের সৌখিন যাত্রাদলগুলির মধ্যমণি হয়ে ওঠেন।

১৯৮৬ সালে নিজগ্রাম বহরপুর ছেড়ে স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন করেন গাংনী উপজেলার চাঁদপুর গ্রামে। শুরু হয় তার দ্বিতীয় জীবন। জীবিকার তাগিদে, কখনও-বা শখের বশে অভিনেতা ও পরিচালক হিসেবে যোগ দেন মেহেরপুর ও চুয়াডাঙ্গা জেলার বিভিন্ন নাট্যদলে। মেহেরপুর ও চুয়াডাঙ্গা জেলার বিভিন্ন যাত্রাদল ও নাট্য সংস্থায় অভিনেতা ও পরিচালক হিসেবে কাজ করে যশ-খ্যাতি ও ভালবাসাঅর্জন করেন বিপুল পরিমাণে।

এই অসামান্য অভিনেতা ছিলেন সব ধরনের চরিত্র রূপায়ণে সমান পারদর্শী। সামাজিক পালায় অভিনয়ে যেমন স্বচ্ছন্দ ছিলেন, তেমনই ঐতিহাসিক পালাতে অভিনয় করেও আনন্দ অনুভব করতেন।‘অশ্রু দিয়ে লেখা’, কোহিনূর’, ‘আনারকলি’, ‘নাচমহল’, ‘মোঘল ই আযম’, ‘সিরাজ উদ দৌলা’, ‘শহীদ কারবালা’, ‘এজিদ বধ’, ‘দেবী সুলতানা’, ‘গলি থেকে রাজপথ’, ‘একটি পয়সা’, ‘নীচুতলার মানুষ’, ‘অনুসন্ধান’, ‘জানোয়ার’, ‘শেষ প্রদীপ’, ‘ক্ষুদিরামের ফাঁসি’, ‘কলঙ্কিনী বধূ’সহ প্রায় দেড় শতাধিক যাত্রাপালায় তিনি অভিনয় করেছেন।

যাত্রাশিল্পে অনন্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ মেহেরপুর জেলা শিল্পকলা একাডেমি ২০১৯ সালে তাকে গুণীশিল্পী হিসেবে সম্মাননা প্রদান করে। ‘যাত্রা-থিয়েটারের লোক’ হিসেবে আমৃত্যু তিনি যাত্রার সঙ্গে ছিলেন।‘যতদিন বেঁচে থাকবেন, ততদিন যাত্রা ও রঙ্গমঞ্চের সঙ্গেই থাকবেন’—- এ ছিল তার ভীষ্মের প্রতিজ্ঞা। গত ১৬ ফেব্রুয়ারি নশ্বর জীবনের পরিসমাপ্তির সাথে সাথে ছেদ হল যাত্রা তথা রঙ্গমঞ্চের সাথে।

ভোরের আলো ফোঁটার আগে প্রিয়জন-শুভানুধ্যায়ীদের কাঁদিয়ে চলে গেলেন না ফেরার দেশে। যাত্রাশিল্পী আক্কাসআলি ছিলেন মন্যুষত্ব, অসাম্প্রদায়িক-মানবিকতার অকুণ্ঠ অনুরাগী। ভালবাসতেন থিয়েটারকে, ভালবাসতেন মানুষ ও পৃথিবীকে। তাই যা কিছু মানবিক, তা-ই ছিল তার কাছে সুন্দর। মানুষের সুখ-দুঃখ, পতন-উত্থান, রক্ত-অশ্রু– সবই সুন্দর। সুন্দরের সাধক এই মহৎ শিল্পীর প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা। তাঁর বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করি।

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, মেহেরপুর সরকারি কলেজ