অনলাইন জুয়ার খপ্পরে মেহেরপুরের অর্ধশত তরুণ

ওয়ানএক্সবেট, বেট৩৬৫সহ বিভিন্ন অ্যাপস ব্যবহার করে অনলাইন জুয়ার খপ্পরে পড়েছে মেহেরপুরের অর্ধশত তরুণ। এদের সকলের বয়স ২০ থেকে ৩৫ এর মধ্যে। এমনই তথ্য মিলেছে সম্প্রতি সিআইডি সদর দপ্তর ও মেহেরপুর সাইবার ক্রাইম বিভাগ কয়েকজনকে আটক করার পর। এ ঘটনার পর এলাকায় অনলাইন জুয়া নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে।

মেহেরপুরের মুজিবনগর উপজেলার কোমরপুর, যতারপুর, গোপালপুর, সদর উপজেলার ইসলামপুর, বারাদি, দরবেশপুর, শহরের বেশ কিছু পয়েন্টে অনলাইন জুয়াতে তরুণরা ঝূঁকে পড়েছে বলে বিভিন্ন সময় অভিযোগ পাওয়া যায়। এই অঞ্চলের তরুণদের মাঝে অস্বাভাবিক জীবনযাপন করার প্রবণতাও লক্ষ্যে করা গেছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ইয়ামাহা আর১৫, ইয়ামাহা ভার্সন ৩, সুজুকি জিক্সার এবিএস ভার্সনসহ দামি ব্রাণ্ডের মোটরসাইকেল, অ্যাপল ব্রাণ্ডের মোবাইল ফোন তরুণদের ব্যবহার করতে দেখা যাচ্ছে। কোমরপুর ও ইসলামপুর এলাকায় এমন দামি ব্রাণ্ডের মোটরসাইকেল অর্ধশতাধিক তরুণ ব্যবহার করে বলেও তথ্য পাওয়া গেছে। যার ফলে এলাকায় সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডসহ অনৈতিক কর্মকাণ্ড বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

জানা গেছে, গত ২ নভেম্বর সন্ধ্যা রাতে মেহেরপুর সদর উপজেলার ইসলামপুর ব্রীজ থেকে জনি ও মেহেদী নামের দুই তরুণকে আটক করে মেহেরপুর সাইবার ক্রাইম বিভাগ। পরে ১৩ নভেম্বর সিআইডি সদর দপ্তর মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা ও কক্সবাজারে অভিযান চালিয়ে ৯জনকে আটক করে। পৃথক এ অভিযানে আটক ১১ জনের মধ্যে মেহেরপুরের ৭জন। সাতজনই একইভাবে অনলাইন জুয়া ওয়ানএক্সবেট, বেট৩৬৫ মোবাইল অ্যাপসহ কয়েকটি অনলাইন জুয়া প্লাটফর্মের মাধ্যমে বিদেশে টাকা পাচার করছে। বিশেষ করে মোবাইল ব্যাঙ্কিং এই অর্থ লেনদেনের মূল হাতিয়ার। বিকাশ, নগদসহ বিভিন্ন মোবাইল ব্যাঙ্কিং এজেন্টদের সিম ব্যবহার করে এই অর্থ লেনদেন করা হচ্ছে। অস্বাভাবিক লেনদেনের মাধ্যমে অল্পদিনেই এসব এজেন্টরাও ফুলে ফটে উঠছে।এদের আটকের আগে জেলা থেকে প্রতিদিন ৩থেকে৫ কোটি টাকা পর্যন্ত লেনদেন হতো। যার অধিকাংশই বিদেশে পাচার হয়।

এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পুলিশের হাতে আটক মেহেদী হাসান (২২)। মেহেরপুর সদর উপজেলার ইসলামপুর গ্রামের পল্লী চিকিৎসক আব্দুল কাদেরের ছেলে। কুষ্টিয়ার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্স শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী।
অপর আটক তরুণ মো: জনি মিয়া (২০)। একই গ্রামের মানিক মিয়ার ছেলে। আট থেকে দশ বছর আগে বাস করতো মুজিবনগর উপজেলার কোমরপুর গ্রামে। পরে ইসলামপুরে নানার বাড়িতে চলে আসে। সেখানেই বসবাস করে তারা। জনি মেহেরপুর সরকারি কলেজে অনার্স প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী।

গত ২ নভেম্বর সন্ধ্যা রাতে গ্রামের ব্রীজে বসে দুই বন্ধু গল্প করছিলো। গল্পের মাঝে হানা দিয়ে তাদের আট করে মেহেরপুর সাইবার অপরাধ বিভাগের একটি টিম। তাদের জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশ জানতে পারে প্রায় ৪০ জনের একটি টিম অনলাইন জুয়া ওয়ানএক্সবেটে কাজ করে। এদের মধ্যে তারা দুজন। জনি ইতোমধ্যে গত মাসে জুয়া খেলে ১৭ লাখ টাকা লাভ করেছে বলেও পুলিশের এই বিভাগটিকে জানায়। জনি ব্যক্তিগতভাবে ব্যবহার ইয়ামাহা আর১৫ মডেলের দামি মোটরসাইকেল ও আইফোন ১২প্লাস মডেলের মোবাইল ফোন। পরে তাদের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা দায়ের করা হয়। যার মামলা নম্বর-৩।

এই দুইজনের মধ্যে জনিকে নিয়ে এলাকায় নানা আলোচনা হয়। জনির প্রতিবেশী হাফিজুল ইসলাম জানান, জনির জীবনযাপন দেখে তার অর্থের উৎস কি জানতে চাইলে সে বলতো একটি কোম্পানিতে চাকরি করি। এর কিছু বলেনা। তবে জনির নানি রাবেয়া খাতুনসহ তার পরিবারের সদস্যরা জনিকে ভালো ছেলে বলেই আখ্যায়িত করেন।
তবে মেহেদীর পিতা আব্দুল কাদের তার ছেলেকে নির্দোষ দাবি করে বলেন, তার ছেলে জনির সাথে ঘুরতো। পুলিশ তার ছেলেকে জনির সাথে পেয়ে ধরে নিয়ে গেছে।

তবে কোমরপুরের মাহফুজুর রহমান নবাব নামের আরেক তরুণ রাজধানীতে লেখাপড়া করতে গিয়ে জড়িয়ে পড়েন অনলাইন জুয়ায়। তার স্ত্রীকে মনিরা আক্তারকেও নামান এই পথে। গত ১৩ নভেম্বর কক্সবাজার থেকে এ দম্পতিকে আটক করে সিআইডির একটি টিম। পৃথকভাবে ১১ জন আটক হলেও মেহেরপুরের ৭ জনের তথ্য রয়েছে মেহেরপুর সাইবার অপরাধ বিভাগের কাছে।

সিআইডির অভিযানে আটক আসলাম উদ্দীনের বাড়ি মেহেরপুর সদর উপজেলার দরবেশপুর গ্রামে। আসলাম উদ্দীনের বারাদি বাজারে মোবাইল ব্যাঙ্কিংয়ের এজেন্ট ব্যবসা রয়েছে। তার এ এজেন্টের মাধ্যমে লেনদেন করা হতো জুয়ার টাকা। এমন তথ্য রয়েছে সিআইডির কাছে।

মেহেরপুর সাইবার ক্রাইম বিভাগের ইনচার্জ এসআই তরিকুল ইসলাম বলেন, ইসলামপুর থেকে আটক দুইজনই অনলাইন জুয়া ওয়ানএক্স বেটের সাথে জড়িত। এদের মধ্যে জনি মিয়া এজেন্ট। সে জিজ্ঞাসাবাদে গত মাসে ১৭ লাখ টাকা লাভ করেছে বলে স্বীকার করেছে। তাদের সাথে জড়িত অর্ধশতের জনের তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। অনলাইন জুয়া নিয়ে কোন আইন না থাকায় তাদের অর্থ অনলাইনের মাধ্যমে লেনদেন করায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা দেওয়া হচ্ছে।

মেহেরপুরের পুলিশ সুপার মো: রাফিউল আলম বলেন, আটক দুই জনের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলা দায়ের করা হয়েছে। তারা ১৬৪ ধরায় স্বাকীরোক্তীমূলক জবানবন্দীতে অনলাইনে জুয়া খেলার কথা স্বীকার করেছে এবং কারা জড়িত আছে তাদেরও তথ্য দিয়েছে। আমরা ইতমধ্যে সাইবার অপরাধ বিভাগ নামে একটি বিভাগ করেছি। যারা এই ধরণের কর্মকাণ্ড নিয়ে কাজ করছে। তথ্য প্রমান সাপেক্ষে বাকিদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

তিনি আরো বলেন, মেহেরপুরে যেন এ ধরণের অপরাধে আর কেউ জড়িত না হয় সেজন্য কঠোর নজরদারিতে রাখা হয়েছে।