
বিশ্বব্যাপী ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা সার্বিকভাবে বেড়েছে। বিশ্বে অপুষ্টিতে আক্রান্ত মানুষের অর্ধেকের বেশিই এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের, যা সংখ্যায় প্রায় ৫০ কোটির কাছাকাছি। অপুষ্টি হলো এমন একটি স্বাস্থ্যগত সমস্যা যেখানে শরীরে প্রয়োজনীয় পুষ্টির ঘাটতি, আধিক্য বা ভারসাম্যহীনতা দেখা দেয়, যা শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। এর প্রধান লক্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে ওজন হ্রাস, ক্লান্তি, দুর্বলতা, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়া এবং মনোযোগের অভাব। অপুষ্টিতে ভোগা শিশুদের খর্বতা, কৃশকায়তা এবং বারবার অসুস্থ হওয়ার ঝুঁকি সব সময়ই বেশি থাকে।
পুষ্টি প্রতিটি মানুষের প্রয়োজনীয় শারীরিক বৃদ্ধি, মানসিক বিকাশ ও অটুট স্বাস্থ্যের গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক। পুষ্টির অভাবে মাতৃগর্ভে শিশুর কাঙ্খিত বৃদ্ধি ঘটে না, শিশুর জন্ম-ওজন কম হয়। খর্বতা, কৃশতা, কম ওজন ও অনুপুষ্টি-কণা ঘাটতি এসব অপুষ্টিরই পরিণতি। শিশুমৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ অপুষ্টি। অপুষ্টির একটি রূপ পুষ্টিহীনতা, অন্য রূপ স্থূলতা ও পুষ্টিজনিত অসংক্রামক রোগসমূহ। পুষ্টিহীনতা শারীরিক বৃদ্ধি ও মানসিক বিকাশকে ব্যাহত করে। পুষ্টিহীন শিশু বহুবিধ সীমাবদ্ধতা নিয়ে বেড়ে ওঠে, ফলে পরিণত বয়সে তার পক্ষে সমাজ ও জাতির উন্নতিতে যথাযথ অবদান রাখা সম্ভব হয় না।
বাংলাদেশে মোট শিশু কম-বেশি ছয় কোটি। এর মধ্যে প্রতি আটজনে একজন অপুষ্টিতে ভুগছে, যা সংখ্যায় কম-বেশি ৭৫ লাখ এবং মোট জনসংখ্যার প্রায় ১২ দশমিক ৯ শতাংশ । ২০১৯ সালে এ হার ছিল ৯ দশমিক ৮ শতাংশ। শিশুদের মধ্যেই শিশুদের জন্য মানসম্মত ও সমন্বিত স্বাস্থ্যসেবা এবং সম্পূর্ণ নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করা এখনো সম্ভব হয়নি। আমাদের দেশে কম-বেশি এক-তৃতীয়াংশ শিশুমৃত্যুর কারণ মারাত্মক অপুষ্টি। ছেলে শিশুর তুলনায় মেয়ে শিশু মৃত্যু বেশি হয় অপুষ্টির কারণে। শহরাঞ্চলে প্রায় ৯০ ভাগ মা শিশুদের বোতলে দুধ খাওয়ায়। মায়েদের প্রায় ৮০ ভাগ আয়রন ও ফলিক অ্যাসিডের অভাবে রক্তশূন্যতায় ভোগে। ভিটামিনের অভাবজনিত শিশুদের রাতকানা রোগ এবং চোখের কর্ণিয়া নরম ও অস্বচ্ছ হয়ে অন্ধত্ব বাংলাদেশে খুব বেশি দেখা যায়। ভিটামিনের-এ-এর অভাবে প্রতিবছর প্রায় ৩০ হাজার শিশু অন্ধ হচ্ছে। বাংলাদেশে শিশুদেরও আয়োডিনের অভাবজনিত বৈকল্য আছে। এ ছাড়া রয়েছে ভিটামিনের-ডি-এর অভাবে রিকেটস। শিশুর খাবারে ভাগ বসানো পেটের কৃমিও অপুষ্টির আরেকটি কারণ। মূলত দারিদ্র্য ও অজ্ঞতাজনিত কুখাদ্যাভ্যাসের দরুন ভিটামিন-সমৃদ্ধ খাবার না খাওয়ায় বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের শিশুদের একটি বড়ো অংশই অপুষ্টিতে আক্রান্ত হয়ে থাকে। জাতিসংঘ ইতোমধ্যে সতর্ক করে দিয়েছে, এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলো যদি সব ধরনের অপুষ্টির অবসানে এবং ২০৩০ সাল নাগাদ ক্ষুধামুক্ত অঞ্চল প্রতিষ্ঠায় নিজেদের আবারও প্রতিশ্রুতিবদ্ধ না করে তাহলে এই অঞ্চলের মানুষ ও অর্থনীতি ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হবে।
১৯৯৭ সালে জাতীয় খাদ্য ও পুষ্টিনীতি তৈরি হওয়ার পর গত দুই দশকে বাংলাদেশের পুষ্টি পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। নানা রকম চেষ্টার পরও অনেক ক্ষেত্রে পুষ্টির স্তর কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে উন্নীত হয়নি। মানবিক, সামাজিক ও জাতীয় উন্নয়নের জন্য অপুষ্টি দূর করা জরুরি। দেশব্যাপী শহর ও গ্রামে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষের ওজনাধিক্য, স্থূলতা, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক, ক্যানসার ও অস্টিওপোরোসিস (নরম হাড়) বর্তমানে পুষ্টিজনিত সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। শারীরিক সক্রিয়তার ঘাটতি, কায়িক শ্রমে অনীহা, ত্রুটিপূর্ণ খাদ্যাভ্যাস এবং অলস জীবনযাপন এর জন্য বহুলাংশে দায়ী।
শৈশবকালীন অপুষ্টির হার বাংলাদেশে হ্রাস পাচ্ছে, তবে হ্রাস পাওয়ার গতি কম। অপুষ্টির সবচেয়ে প্রচলিত রূপ হলো খর্বতা (stunting), যা দীর্ঘকাল অপুষ্টিতে ভোগার পরিণাম। একটি খর্বকায় শিশুর ঘন ঘন সংক্রমণের প্রবণতা দেখা যায় এবং তার মস্তিষ্কের বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। বাংলাদেশে অনূর্ধ্ব ৫ বছর বয়সি প্রতি ৫ জন শিশুর মধ্যে ২ জন খর্বকায়। এই হার ধনী জনগোষ্ঠী অপেক্ষা দরিদ্রদের মধ্যে দ্বিগুণ। ২০০৪ থেকে ২০১৪ সাল, এই ১০ বছরে খর্বতা হ্রাসের হার বছরে মাত্র ১.৫ শতাংশ। খর্বতা হ্রাসের হার বছরে ২ বা ৩ শতাংশ হলে তা সন্তোষজনক হতো। কৃশতা (wastin) তীব্র অপুষ্টিরই পরিণাম। গত এক দশকে দেশে কৃশতার হার ধীরগতিতে কমেছে। বাংলাদেশে অনূর্ধ্ব ৫ বছর বয়সি শিশুদের শতকরা ১৪ ভাগ কৃশকায়। কৃশতার ভীতিকর রূপ হলো মারাত্মক তীব্র অপুষ্টি (severe acute malnutrition), যার ব্যাপকতার হার বর্তমানে ৩.১ শতাংশ। অনূর্ধ্ব ৫ বছর বয়সি প্রায় সাড়ে চার লক্ষ শিশু মারাত্মক তীব্র অপুষ্টির শিকার। পাশাপাশি এই অবস্থা নিয়ে যারা বেঁচে আছে তাদের মানসিক বৃদ্ধিও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বয়স ও লিঙ্গ অনুযায়ী স্বাভাবিকের চেয়ে কম ওজনের শারীরিক পরিস্থিতিকে কম-ওজন বলা হয়।
বাংলাদেশে শৈশবকালীন অপুষ্টির মূল কারণ যথাযথভাবে শিশুখাদ্য ও পুষ্টিবিধির চর্চা না করা। শিশুখাদ্য ও পুষ্টিবিধিতে বলা হয় যে, সদ্য নবজাতককে জন্মের ১ ঘণ্টার মধ্যে বুকের দুধ পান করানো শুরু করতে হবে, শিশু পূর্ণ ৬ মাস (১৮০ দিন) পর্যন্ত শুধু বুকের দুধ পান করাতে হবে এবং পূর্ণ ৬ মাস বয়সের পর থেকে ২ বছর বয়স পর্যন্ত বুকের দুধের পাশাপাশি ঘরে তৈরি পুষ্টিকর বাড়তি খাবার খাওয়াতে হবে। বাংলাদেশে ৬ মাসের কম বয়সি শিশুদের শুধু বুকের দুধ পান করানোর হার ৫৫ শতাংশ। ৬ মাস থেকে পূর্ণ ২৩ মাস বয়সি ২৩ শতাংশ শিশুকে ন্যূনতম গ্রহণযোগ্য খাদ্য (minimum acceptable diet) খাওয়ানো হয়। বাংলাদেশের বয়ঃসন্ধিকালীন মেয়েদের এক-চতুর্থাংশ অপুষ্টির শিকার। প্রজননক্ষম বয়সের প্রতি ৮ জন নারীর এক জন খর্বকায়। খর্বকায় নারীর সন্তান জন্মদানের সময় জটিলতার ঝুঁকি থাকে। একই কারণে তাদের গর্ভের শিশুর বৃদ্ধি ব্যাহত হওয়ার ঝুঁকি অনেক গুণ বেশি থাকে, ফলে নবজাতকের কম জন্ম ওজনের আশঙ্কাও বৃদ্ধি পায়। বাল্যবিবাহ এবং অল্প বয়সে গর্ভধারণ এতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে। বাংলাদেশে কম জন্ম ওজনের শিশুর হার অনেক বেশি। একজন খর্বকায় মায়ের কম জন্মওজনের শিশু জন্ম দেওয়ার আশঙ্কা সব সময় থাকে, আবার শিশুটি বয়স্ক হওয়ার পরও খর্বতা কাটিয়ে উঠতে পারে না। এভাবে খর্বতা প্রজন্ম থেকে পরবর্তী প্রজন্মে গিয়ে পৌঁছায় এবং এটি অপুষ্টির একটি দুষ্টচক্র। গ্রাম ও শহরের অপুষ্টি পরিস্থিতিতে পার্থক্য রয়েছে, বিশেষত শহরাঞ্চলের বস্তিতে বসবাসকারী নারী ও শিশুরা তুলনামূলকভাবে খারাপ অবস্থায় আছে। জনগণের বিশেষত নারীদের মধ্যে ওজনাধিক্য (overweight) এবং স্থূলতার (obesity)হার ক্রমবর্ধমান। ওজনাধিক্য ও স্থূলতার ফলে দেশে অপুষ্টিজনিত দীর্ঘমেয়াদি ব্যাধি যেমন: টাইপ-২ ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ ও হৃদরোগের প্রকোপ বাড়ছে। ওজনাধিক্য এখন দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী মানুষের মধ্যেও দেখা যাচ্ছে। শহরের বস্তি এলাকায় বসবাসকারী মানুষের মধ্যে এই সমস্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
অপুষ্টি একটি গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যা, বিশ্বব্যাপী লক্ষ লক্ষ মানুষ অপুষ্টিতে ভুগছে। অপপুষ্টির কারণে কোষকলা, পেশি, দেহাঙ্গ গঠন ও কর্মক্ষমতা পালটে যায়। অপুষ্টি হলো খাদ্যের গুণগত ও পরিমাণগত ভারসাম্যহীনতার ফলে সৃষ্ট নেতিবাচক পরিস্থিতি। এই সমস্যাটি কার্যকরভাবে মোকাবিলা করার জন্য অপুষ্টির লক্ষণগুলি শনাক্ত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অপপুষ্টির কারণে সাধারণত মানুষের ওজন হ্রাস পায়, পেশি শুকিয়ে কঙ্কালসার হয়ে পড়ে। যখন শরীরে প্রয়োজনীয় পুষ্টির অভাব হয়, তখন পেশি এবং চর্বি ভেঙে যেতে শুরু করে, যার ফলে ওজন উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পায়। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। শরীর সবসময় ক্লান্তি ও দুর্বলতা অনুভূত হয়। ফলে শরীর দৈনন্দিন কাজ করতে সমস্যা করে। অপুষ্টির আরেকটি সাধারণ লক্ষণ হলো যে কোনো ক্ষত নিরাময়ে দীর্ঘ সময় লাগে। অপর্যাপ্ত পুষ্টি শরীরের ক্ষতিগ্রস্ত টিস্যু মেরামত করার ক্ষমতাকে ব্যাহত করে, ফলে ক্ষত নিরাময়ে বেশি সময় লাগে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সংক্রামিতও হয়। এছাড়াও ত্বক শুষ্ক ও ঢিলে হয়ে যাওয়া, দাঁতের ক্ষয়, পেশিতে টান পড়া ও পেট ফোলার মতো উপসর্গ দেখা দেয়। শুষ্ক এবং ভঙ্গুর চুল, ফ্যাকাশে বা হলুদ ত্বকের রঙ এবং ভঙ্গুর নখ - এই সমস্ত লক্ষণগুলির মূল কারণ হলো শরীর পর্যাপ্ত পুষ্টি পায় না। তবে সবার ক্ষেত্রে সবগুলো উপসর্গ একই সঙ্গে এবং একই মাত্রায় দেখা যায় না।
অপুষ্টিকে কার্যকরভাবে মোকাবিলা করার এবং সামগ্রিক স্বাস্থ্য ও সুস্থতার উন্নতির জন্য প্রথমত সবাইকে সচেতন হতে হবে। কী কারণে মানুষ অপুষ্টিতে ভোগে এবং অপুষ্টির কারণে মানুষের কী কী সমস্যা হয় এসব বিষয়ে জানতে হবে। এর পরবর্তী পদক্ষেপ হলো সমাজ থেকে অপুষ্টিকে নির্মূল করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। চিকিৎসা সহায়তা নেওয়াসহ সুষম খাদ্য গ্রহণ করার মাধ্যমেও অপুষ্টিকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব । তবে এক্ষেত্রে সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই।
লেখক: জনসংযোগ কর্মকর্তা, খাদ্য মন্ত্রণালয়