‘মনে হতো, আমি না থাকলেই সবাই শান্তিতে থাকবে’ কিছুটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে কথাটা বললেন মুজিবনগরের গৃহিণী রুমানা আক্তার (ছদ্মনাম)। বয়স পঞ্চাশ, দুই সন্তানের মা। এক সময়ের প্রাণবন্ত, হাসিখুশি মানুষটা আজও ভয়ে কাঁপেন সেই দিনের স্মৃতিতে, যেদিন তিনি ছাদ থেকে লাফ দিতে চেয়েছিলেন।
রুমানার জীবনে অন্ধকার নেমে আসে প্রায় এক যুগ আগে। শরীরে ক্লান্তি, মন বিষণ্ন, বিছানা ছেড়ে উঠতে পারতেন না। চোখের সামনে ঝাপসা হয়ে যেত সবকিছু। শ্বশুরবাড়ির লোকজন প্রথমে ভেবেছিলেন, সন্তানদের সামলানো ও কাজের অতিরিক্ত চাপের কারণে এমন হচ্ছে। একদিন হঠাৎ আবার আত্মহত্যার চেষ্টা করেন তিনি। তখনই ঢাকায় এক চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ধরা পড়ে, তিনি হাইপোথাইরয়েডিজমে আক্রান্ত। শরীরের থাইরয়েড হরমোনের ঘাটতি এমনভাবে মন-মস্তিষ্ককে প্রভাবিত করে যে মানুষ ভিতরে ভিতরে ভেঙে পড়ে।
এরপর শুরু হয় চিকিৎসা, থেরাপি আর কাউন্সেলিং। তবুও রুমানা আরও তিনবার আত্মহত্যার চেষ্টা করেন-কখনো ঘুমের ওষুধ খেয়ে, কখনো কীটনাশক পান করে। তবে ভাগ্যক্রমে, প্রতিবারই বেঁচে গেছেন তিনি।
রুমানা যোগ করেন, ‘মাঝেমধ্যে মনে হতো, আমি এই সংসারে একটা বোঝা। কেউ বুঝে না আমি ভিতরে কতটা কষ্ট পাই।’
অন্যদিকে, ১৮ বছরের এক তরুণ মিল্টনের জীবনেও ঘটেছিল একইরকম কিছু। প্রায় এক যুগ আগে মেহেরপুর সরকারি কলেজের ছাত্র ছিলেন তিনি। বন্ধুদের সবার ছিল মোটরসাইকেল। কিন্তু কৃষক বাবার পক্ষে তা কেনা সম্ভব ছিল না। অভিমানে একদিন কীটনাশক খেয়ে ফেললেন। তিন দিন মৃত্যুর সঙ্গে যুদ্ধ করে ফিরে আসেন সুস্থ জীবনে। এরপর তার বাবা জমি বন্ধক রেখে কিনে দেন ছেলের স্বপ্নের বাইক।
মিল্টন বলেন, ‘সেদিন বেঁচে গিয়েছিলাম ঠিকই, কিন্তু একটা অপরাধবোধ আমাকে ভেতরে খেয়ে ফেলত। এখন আমার ছেলে যখন মোবাইলের জন্য জেদ করে, আমি ভয় পাই। মনে পড়ে, আমি একদিন বাইকের জন্য মরতে চেয়েছিলাম।’
মেহেরপুরে এমন গল্প এক-দুইটা নয়। কিছুদিন আগেই বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া এক তরুণী আত্মহত্যা করেছেন। এ বিষয়টি নিয়ে কালবেলার সাথে কথা বলেন, মেহেরপুর সরকারি মহিলা কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ অধ্যাপক আবদুল্লাহ আল আমিন।
অধ্যাপক আবদুল্লাহ আল আমিন বলেন, ‘শিক্ষা ক্ষেত্রের পরিবেশ আনন্দময় করতে হবে। আমাদের তরুণ প্রজন্ম জীবনের প্রতি আকর্ষণ হারিয়ে ফেলছে। চাকরির অনিশ্চয়তা, পরিবারের চাহিদা, সমাজের চাপ সব কিছু একসাথে ভর করছে ওদের কাঁধে।’
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আজাদ খান কালবেলাকে বলেন, ‘আত্মহত্যা একক কোনো সমস্যার ফল নয়। এটা মনস্তাত্ত্বিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক নানা সংকটের মিশ্রণ। কেউ মরতে চায় না। মানুষ বাঁচতে চায়, কিন্তু হয়তো আর পারে না। আত্মহত্যার আগে মানুষ অনেক সময় সংকেত দেয়। আচরণ বদলায়, চুপ হয়ে যায়, প্রিয় জিনিস কাউকে দিয়ে দেয়। আমরা যদি সময়মতো সংকেতগুলো বুঝতে পারি, তবে হয়তো অনেক মৃত্যু হয়তো ঠেকানো সম্ভব হবে।’
মেহেরপুর সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা মো. খাইরুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, ‘আমরা কিছু স্কুলে কাউন্সেলিং চালু করেছি। কিন্তু শুধু প্রশাসন দিয়ে এটা ঠেকানো সম্ভব নয়। পরিবার, মসজিদের ইমাম, শিক্ষক, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।’
এই জেলায় প্রতিটি আত্মহত্যা যেন একেকটি নীরব আর্তনাদ। যে আর্তনাদ আমরা অনেকেই শুনি না, বুঝি না বা বুঝতে চাই না। অথচ একটু সাহচর্য, একটু বোঝাপড়া, একটা ভালোবাসার স্পর্শ হয়তো কাউকে বাঁচিয়ে দিতে পারে। প্রয়োজন সহানুভূতি, সচেতনতা আর সাহস নিয়ে পাশে দাঁড়ানো।