আধুনিক কৃষিতে গতি পেয়েছে অর্থনীতি

আধুনিক কৃষিতে গতি পেয়েছে অর্থনীতি

ঝড়, জলোচ্ছাস বন্যা, শীত, খরা, তাপদাহসহ জলবায়ূ পরিবর্তণের ধাক্কা সামলিয়ে কৃষি বার বার ঘুরে দাঁড়িয়েছে। এসেছে বিস্ময়কর সাফল্য ও অভাবনীয় পরিবর্তণ। একসময় বলা হতো দুধে-ভাতে বাঙালি কিম্বা মাছে ভাতে বাঙালি। এখন দুধে-ভাতে কিম্বা মাছে-ভাতে বাঙালি সীমিত নয়। পুষ্টিতে বাঙালি হিসেবে এদেশে বিশ^ দরবারে প্রশংসিত হচ্ছে ও পরিচিত লাভ করেছে। মেহেরপুরের কৃষিও পরিবর্তণ হয়েছে। অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হচ্ছে মেহেরপুরের কৃষক।

মেহেরপুর কৃষিনির্ভর জেলা। যুগের পর যুগ ধরে চলে আসা চিরন্তন গ্রামীণ কৃষি এবং কৃষিনির্ভর জীবন ও সংস্কৃতি বিলুপ্তি হয়ে যাচ্ছে । গত দেড়যুগে অলাভবান সব আবাদই হারিয়ে গেছে। যেসব আবাদ হচ্ছে সেগুলো বানিজ্যিক ভিত্তিতে। যুগ যুগ ধরে চলে আসা রবিশষ্য এখন পারিবারিক প্রয়োজনে সখের বশে কেউ কেউ আবাদ করে। জেলায় রবীশষ্য চাষের জমিতে খেসারী, যব, তিসি, ছোলা, ভুরু, শেয়ালল্যাজা, কদু ইত্যাদি চাষ একেবারেই বিলুপ্ত। বানিজ্যিক ভিত্তিতে এখন সমতল জমিতে আবাদ হচ্ছে ড্রাগন, কমলা লেবু, নেওয়া আতা, গ্যান্ডারী, আম, পেঁপে, কলা ইত্যাদি। খাল বিলে চাষ হচ্ছে মাছের।ফলে ডোবা নালাতে আর দেশি জাতের মাছ উৎপাদন হচ্ছে না। যেসব জমিতে আউশ ও রবীশষ্য চাষ হতো সেসব জমিতে এখন জেনেটিক বীজে ইরি আউশ আমন ধান চাষ হচ্ছে। প্রকৃতিও বদলে গেছে।

একযুগ আগেও এই সময় খাল বিল পানিতে ডুবে থাকতো। এখন প্রকৃতি বিপর্যয় কারণে খাল বিলের তলদেশে রবীশষ্য চাষ হয়। মেহেরপুরের গাংনীর ষোলটাকা ও মেহেরপুর সদরের ঝাউবাড়িয়া গ্রামে কৃষি চাষ ছেড়ে মাছচাষ বেড়েছে। ওই গ্রামদুটিতে প্রায় ১৫শ পুকুরে মাছের চাষ হয়। প্রতিবছরই সেখানে মাছ চাষের জন্য পুকুর খনন করা হচ্ছে। অনেকে বাড়ি সংলগ্ন পুকুর খনন করেছে। কৃষির এমন পরিবর্তনে গত দেড়যুগে মানুষের অর্থনৈতিক উন্নতি হয়েছে চরমে। মানুষের ক্রমবর্ধমান চাহিদাকে কেন্দ্র করে প্রান্তিক জনপদের গ্রামে গ্রামে সম্প্রসারিত হয়েছে বাণিজ্যিক কৃষি। গ্রামবাংলার ঘর-গৃহস্থালি থেকে হারিয়ে যাচ্ছে পারিবারিকভাবে হাঁস-মুরগি পালনের সংস্কৃতি। আর পুকুরে পানির ওপরে মুরগি এবং পানিতে চলছে মাছ চাষ।

গ্রামবাংলায় যেখানে সিংহভাগ পরিবারে ছিলো হালচাষের গরু। হাল বিক্রি করেই চলতো অনেক পরিবারের জীবন মান। দুইযুগ আগেও গ্রামীণ ও শহুরে জোতদার পরিবারে ছিলো রাখাল, কৃষান। এখন কোন পরিবারে মেলেনা হালের গরু। রাখাল কৃষাণ এখন ইতিহাসের পাতায়। মূলত অর্থনেতিক কারণে দ্রুত বদলে গেছে গ্রামীণ কৃষি। শিক্ষিত বেকার ও প্রবাস ফেরৎ যুবক সম্প্রদায় ধানী জমিতে সমন্বিত মাছচাষ, মুরগি, গবাদিপশুর খামার, এবং ফল চাষের প্রকল্প চালু করছে। প্রতিটি গ্রামের মাঠেই হাজার হাজার হেক্টর জমিতে গড়ে উঠেছে আম, লিচু, কলা, মাল্টা, কুল, পেয়ারা ইত্যাদির বাগান। লাভজনক হবার কারণে সমতল ধানি জমিতে পুকুরও করছেন অনেকেই। মৌসুমী ফল চাষ এখন বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। তবে কি পরিমাণ চাষের জমিতে শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে তার সঠিক তথ্য কৃষি বিভাগের হাতে নেই।

ক্রমাগত জমির হাত বদল হয়ে পেশাজীবী, ব্যবসায়ীদের হাতে চলে যাওয়া, প্রধান ফসল ধানের পরিবর্তে ফলের বাগান বৃদ্ধি পাওয়া, ফসলি জমিতে শিল্প কারখানাসহ ইটভাটা গড়ে ওঠার কারণে জেলার কৃষি ক্ষেত্রে সুদূর প্রসারী প্রভাব পড়ার আশংকা উড়িয়ে দিচ্ছে কৃষি কর্মকর্তারা।

গাংনীর ষোলটাকা গ্রামের দেলবার হোসেন জানান- তিনি গ্রামে ৮টি পুকুরে মাছের চাষ করেন। প্রতিটি পুকুর প্রায় এক একর করে। প্রতিদিন মাছের খাবার লাগে ৫০ হাজার টাকার। প্রতিটি পুকুরে বছরে গড়ে ৭০ লাখ টাকার মাছ উৎপাদন হয়। মাছের খাবারের জন্য তিনি একটি মিল স্থাপন করেছেন।

মেহেরপুর জেলা শহরে প্রাচিন একটি পাড়া। বেড়পাড়া নামে পরিচিত বিশাল এই পাড়ায় শতাধিক পরিবারের বাস। ৭০ দশক পর্যন্ত তিনটি পরিবার ছাড়া কোন পরিবারের স্কুলমুখি ছেলে মেয়ে ছিলোনা। এখন সিংহভাগ পরিবারের ছেলে মেয়ে স্কুলমুখি। সবগুলো পরিবারেই ছিল দেশি হাঁস-মুরগি, হালের বলদ। ব্লাকবেঙ্গল ছাগল পালন ছিলো প্রতিটি পরিবারে। কৃষিচাষের সাথে জড়িত ছিলো এসব পরিবারগুলো। গত আড়ায় যুগের ব্যবধানে বর্তমানে আমন ধান চাষ করে এমন পরিবার খুঁজে পাওয়া মুশকিল। একমাত্র হালের বলদ টিকে আছে দেলবার হোসেনের (দেল) বাড়িতে। আরসব বাড়ি থেকে বিদায় হয়েছে হালের গরু। এখন বানিজ্যিক ভিত্তিতে পরিবারগুলো দুটি একটি করে গবাদিপশু পালন আর মাঠের জমিতে বাণিজ্যিকভাবে কলা, আমড়া, আম, পেয়ারা, বনজ গাছ এবং সমন্বিত মাছ-মুরগি চাষ নিয়ে আছে। গৃহপালিত হাঁস-মুরগিও উচ্ছেদ হয়ে গেছে প্রায় সব পরিবার থেকে। দেল হোসেন জানান- আগে তিনি নিজের জমির চাষ আর হাল বিক্রি করে জীবীকা নির্বাহ করতেন। আধুনিক প্রযুক্তির কারণে হাল চাষ চাহিদা হারিয়েছে। গরু-মহিষ দিয়ে ধান চাষ এবং মাড়াইয়ের কাজ হতো। সেটাও বন্ধ। এখন জমি চাষ এবং ধান মাড়াইয়ে ব্যবহৃত হচ্ছে যন্ত্র প্রযুক্তি। বিয়ে সাদিতে গরুর গাড়ি ছিলো যাতায়াতের পরিবহন। এখন প্রাইভেট কার। তাই হালের গরু উঠে গেলেও দেল নিজের জমি চাষের জন্য এখনও গরু পালন করেন।

পাড়ার মরহুম কালু মণ্ডল, মরহুম ফজলুর রহমানের গোয়াল ভরা গরু ছিলো। পারিবারিক দুধের চাহিদা মেটাতে ছিলো গাভি গরু । ছিলো রাখাল ও কৃষান। তাদের বাড়ির পাশে নিজেদের এবং পাড়ার মানুষের জমির ফসল মাড়ার জন্য খোলা ছিলো। জমি থেকে ধান কেটে এনে আঁটি বেঁধে ওই খোলাতে সাজিয়ে রাখা হতো। পরে হতো ধান ও রবীশষ্য মাড়াইয়ের কাজ। পাড়ার বাড়ি থেকে গরুর দল জুড়ে মলন মাগা হতো। ভর দুপুরে এই ফসল মাড়ায়কালে খোলার আশপাশে কেউবা গুড়ের তিলের খাজা, খুরমা, জিলেপি ইত্যাদি তৈরী করে এনে বসে থাকতেন। ধান, গম, মসুর, ছোলা ইতাদির বিনিময় হতো ওইসব মিষ্টান্নর সাথে। শীতের সময় ফজরের আজান থেকে উঠানের পাশে টিনের তৈরি বিশাল কড়াইয়ে হতো ধান সিদ্ধ করার কাজ। সিদ্ধ সেই ধান শুকিয়ে বাড়ির ঢেঁকিতে ছেটে চাল সংরক্ষণ করা হতো। এখন উঠান, ফসল মাড়ায়ের খোলা, গোয়াল ঘর নেই। ধানের জমি যেটুকু অবশিষ্ট আছে তাতে আর কোনো আমন ধান চাষ নেই। চলে গেছে ইরিচাষ আর ফলবান বাগানের অধীনে। একসময় যারা জোতদার ছিলেন। বাড়িতে রাখাল কৃষান রেখে চাষাবাদ করতেন। তাদের শতকরা ৯০ ভাগ এখন জমি বর্গা দিয়েছেন। ভূমিহীন পরিবারগুলো এখন অন্যের জমি বর্গা নিয়ে বর্গাচাষী হয়েছেন।

কৃষক বছরের পর বছর ধানের দাম পাচ্ছে না। দাম না পেয়ে জমিতে ফলজাতীয় বাগান করছেন। এখানে কোনও ঝুঁকি নেই। যেমন আমের মুকুল আসার আগেই বাগান বিক্রি করে নগদ টাকা পাওয়া যায়। সার বিষ পানিসহ সকল পরিচর্যা যিনি বাগান চুক্তিতে কেনেন তার দায়িত্বে থাকে। ফলে বাগান নিয়ে বাড়তি কোনও ভেজাল করতে হয় না।

জেলায় সরকারি হিসেব মতে ১৪,৬২০০ পরিবার জেলার মোট কৃষক। ১,৫৫,৪৬৬ হেক্টর ফসলী জমি। জেলার খাদ্যচাহিদা আছে ১,৩৯,৮৫৩ মেট্রিক টন। উৎপাদিত হয় ২,৬৬,৬৯২ মেট্রিক টন। ১২৬৮৩৯ মেট্রিকটন উদ্বৃত্ত খাদ্য জাতীয় খাদ্যভান্ডারে অবদান রাখছে। এ তথ্যের বাইরে জেলায় কি পরিমাণ জমিতে গত একযুগে ফলের বাগান, ইটভাটা, পুকুর খনন, ইমারত নির্মাণ হয়েছে সে তথ্য নেই জেলা কৃষিবিভাগের কাছে।

মেহেরপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক শঙ্কর কুমার মজুমদার বলেন- কৃষক এখন অনেক সচেতন। কোন চাষে লাভবান হবে ভাবনা থেকেই চাষ পরিবর্তন করছে। তবে মেহেরপুর জেলার মাটি দেশের অন্যজেলার থেকে আলাদা। এই জেলার মাটিতে সব ধরনের ফসল উৎপাদন হয়। ফলের চাষ বৃদ্ধি পাওয়াতে জেলার চাহিদা মিটিয়েও জেলার বাইরে বাজারজাত করে কৃষকরা লাভবান হচ্ছে।

মেহেরপুরের উর্বর জমি, আমাদের অবারিত প্রাকৃতিক সম্পদ, আমাদের পরিশ্রমী মানুষ, আমাদের গবেষণা সম্প্রসারণ কাজে সম্প্রসারণ কাজে সমন্বয় করলে মেহেরপুরের কৃষি জাতীয় খাদ্যভান্ডারে আরও অবদান রাখতে পারবে।