
আলমডাঙ্গার শহরতলির আসাননগরে স্বাধীনতার ৫৪ বছরেও উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি। কাঁচা রাস্তায় নিত্যকাদায় ডুবে মানবেতর জীবন করছে।অসুস্থ রোগী, শিক্ষার্থী ও লাশ পর্যন্ত আটকে পড়ে ঘরে!
আলমডাঙ্গা শহরের কোলঘেঁষা আসাননগর গ্রামের মানুষ যেন বঞ্চনার আরেক নাম। স্বাধীনতার পাঁচ দশক পেরিয়ে গেলেও এখানকার প্রধান রাস্তাটি এখনো কাঁচা। ফলে গ্রামের পাঁচ হাজার মানুষ বছরের বেশিরভাগ সময় কাটান কাদাপানিতে হেঁটে, পা পিছলে পড়ে, অসুস্থতা আর ক্লান্তির বোঝা নিয়ে।
গ্রামটির পশ্চিম ও উত্তরে জিকে সেচ খাল, দক্ষিণ ও পূর্বে কুমার নদী থাকায় আসাননগর গোলাকৃতি একটি দ্বীপগ্রামের মতো—বাইরে যাতায়াতের একমাত্র ভরসা একটি রাস্তা, সেটিও এখন চলাচলের অনুপযোগী। বর্ষায় রাস্তার ওপর জমে থাকে হাঁটুসমান কাদা-পানি। এ যেন এক দুঃসহ যাত্রাপথ।
এই গ্রামের শিক্ষার্থীরা প্রতিদিন কষ্ট করে কাদাপানি মাড়িয়ে স্কুলে যায়। কোনো রিকশা বা ভ্যান ঢুকতে না পারায় পায়ে হেঁটে যেতে হয় দূরের স্কুল-কলেজে। শিশু শিক্ষার্থীদের স্কুল ইউনিফর্ম ভিজে কাদায় নোংরা হয়, অনেকে প্রায়ই পড়ে গিয়ে আহত হয়।
অপরদিকে, রোগীদের অবস্থা আরও শোচনীয়। আসাননগর গ্রামের গৃহবধূ রওশন আরা বলেন, “আমার শাশুড়ির হঠাৎ অসুস্থ হলে ভ্যানে করে হাসপাতালে নিতে পারিনি। কাঁধে করে কাদা ভেঙে বাইরে নিয়ে যেতে হয়েছে। ভ্যানও ঢুকতে চায় না, চালকরা বলে, ওখানে গেলে চাকার অর্ধেক ডুবে যায়।”
স্থানীয় বাসিন্দা হানিফ শেখ বলেন, “কোনো মানুষ মারা গেলে কবরস্থানে নিয়ে যাওয়াটাই এক যুদ্ধ। খাটিয়া বহন করে কাদা মাড়িয়ে যেতে হয়। বর্ষায় জানাজায় ১০-১৫ জনের বেশি লোক অংশ নিতে পারে না।”
মসজিদ, ঈদগাহ ও গোরস্থানে যাওয়ার একমাত্র রাস্তাটিও এই কাঁচা পথ। ফলে ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠানেও দেখা দেয় সীমাহীন দুর্ভোগ। বর্ষায় রাস্তাটি পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, তখন মনে হয়, এই গ্রাম যেন পুরো দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন এক দ্বীপ।
আসাননগরের লোকজন বলেন, নির্বাচনের সময় জনপ্রতিনিধিরা নিয়মিত আসেন, নানা প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু নির্বাচন শেষ হলে তারা আর ফিরেও তাকান না। স্থানীয় বাসিন্দা আজিম উদ্দিন ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, “প্রতিবার আমরা আশায় থাকি এবার কিছু হবে। চেয়ারম্যানরা শুধু ভোটের সময় বলে, এরপর আর কেউ খোঁজও নেয় না।”
সবচেয়ে বড় বিস্ময়ের বিষয় হলো, শহরের এত কাছে হওয়া সত্ত্বেও এই গ্রামে নেই কোনো স্বাস্থ্যকেন্দ্র, উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, নেই কোনো পাকা ড্রেনেজ ব্যবস্থা। অথচ আশপাশের গ্রামগুলোতে একের পর এক রাস্তা পাকা হয়েছে। আসাননগর গ্রাম যেন উন্নয়ন মানচিত্রে ভুলে যাওয়া এক অঞ্চল।
স্থানীয় মেম্বার বা চেয়ারম্যানের কাছেও গেলে তারা বলে, বরাদ্দ নেই, অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু এ অপেক্ষার যেন কোনো শেষ নেই।
গ্রামের মানুষ মনে করেন, একটি পাকা রাস্তাই তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের প্রথম ধাপ। তারাই চান—জরুরি ভিত্তিতে অন্তত মসজিদ, গোরস্থান ও ঈদগাহে যাওয়ার সড়কটি পাকা হোক।
আসাননগর গ্রামের বাসিন্দারা সরকারের উচ্চ মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, “আমরা রাস্তাই চাই, আর কিছু না। অন্তত একজন মানুষ মারা গেলে যেন ঠিকমতো জানাজা দেওয়া যায়, শিশুরা যেন ভিজে কাদা ডিঙিয়ে স্কুলে না যায়, আর অসুস্থ রোগী যেন কাঁধে নয়, ভ্যানে করে হাসপাতালে যেতে পারে।”
এই চরম দুর্ভোগ থেকে কখন মুক্তি মিলবে—সে প্রশ্নই এখন আসাননগরবাসীর হৃদয়জুড়ে।