আসছে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ প্রণোদনা প্যাকেজ

করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের কারণে দেশের অর্থনীতির ওপর বিরূপ প্রভাব উত্তরণের জন্য বাজেট বরাদ্দ থেকে বিশেষ প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। রবিবার সকাল ১০টায় গণভবনে সংবাদ সম্মেলনে এ ঘোষণা করবেন তিনি। করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের কারণে সম্ভাব্য অর্থনৈতিক প্রভাব উত্তরণের জন্য গতকাল সন্ধ্যায় গণভবনে এক বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এমন আভাস দিয়েছেন।

বৈঠকে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব আহমদ কায়কাউস, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির, অর্থ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব আবদুর রউফ ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব তোফাজ্জল হোসেন মিয়া উপস্থিত ছিলেন। রবিবার সকালে সংবাদ সম্মেলন করে এ প্রণোদনা ঘোষণার তথ্য নিশ্চিত করেছেন প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম।

বৈঠকসূত্রে জানা গেছে, করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতির জন্য কী কী করা যায়, ব্যবসা-বাণিজ্য, ক্ষুদ্র ব্যবসা, শিল্প খাতের জন্য সম্ভাব্য করণীয়, ব্যাংক সুদ সিঙ্গেল ডিজিটের বাস্তবায়ন বিষয়ে বৈঠকে দিকনির্দেশনা দেন প্রধানমন্ত্রী। বৈঠকে বলা হয়, দেশের গার্মেন্ট কারখানাগুলো বন্ধ করার পরিস্থিতি এখনো হয়নি। তবে যে কোনো পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত থাকার নির্দেশনা দেওয়া হয়।

পোশাক খাতের ৫ হাজার কোটি টাকার প্যাকেজের বিষয়েও আলোচনা হয়েছে। সেই সঙ্গে ক্ষতির সম্ভাব্য পরিমাণ কত হতে পারে সে অনুযায়ী বাজেট প্রণয়ন, স্বাস্থ্য খাতে যত প্রয়োজন অর্থ দেওয়ার পরামর্শও দেওয়া হয়। তবে কোথাও যেন কোনো অনিয়ম না হয় সে ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী কঠোর সতর্কবার্তা দেন বলে সূত্র জানান।

ফেসবুকে অপপ্রচার চালালে ব্যবস্থা : এদিকে প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম জানান, বাড়ি ভাড়া মওকুফ, ব্যাংক লোন ও বিদ্যুৎ বিল তিন মাসের জন্য স্থগিত, সব অফিসে এক মাসের ছুটি-সংক্রান্ত যে গুজব ফেসবুকে ভাইরাল করা হচ্ছে, তা পুরোপুরি মিথ্যা ও বানোয়াট। যারা অপপ্রচার চালাচ্ছেন তা অপরাধের পর্যায়ে পড়ে। অপপ্রচারকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। প্রতি উপজেলা থেকে

দুজনের নমুনা পরীক্ষার নির্দেশ : করোনাভাইরাস পরীক্ষার জন্য দেশের প্রতিটি উপজেলা থেকে কমপক্ষে দুজনের নমুনা পরীক্ষা করার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একই সঙ্গে কভিড-১৯ ছড়িয়ে পড়ার পরিপ্রেক্ষিতে দায়িত্ব পালনকালে সব সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে মাস্ক ব্যবহার করার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।

প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম ও স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (এমআইএস) ডা. হাবিবুর রহমান এ তথ্য জানিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব জানান, প্রধানমন্ত্রী কভিড-১৯ ছড়িয়ে পড়ার প্রেক্ষাপটে সব সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীকে দায়িত্ব পালনকালে মাস্ক ব্যবহার করার নির্দেশ দিয়েছেন। এটি সবাইকে মেনে চলতে হবে।

এদিকে স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) নিয়মিত অনলাইন ব্রিফিংয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক ডা. হাবিবুর রহমান বলেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা থেকে কমপক্ষে দুজনের নমুনা পরীক্ষা করার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ইতিমধ্যে নির্দেশনা অনুসারে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ বিভাগীয় পরিচালকদের নমুনা সংগ্রহের নির্দেশনা দিয়েছেন।

আজ সারা দেশ থেকে ১ হাজার নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করা হবে বলে আমরা আশা করছি।’ আইইডিসিআর জানায়, গত ২৪ ঘণ্টায় দেশে নতুন করে আরও দুজন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। এ নিয়ে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে ৫৬-এ দাঁড়াল।

করোনাভাইরাস নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর ৩১ দফা নির্দেশনা : এদিকে প্রধানমন্ত্রীর প্রেস উইং সূত্র জানিয়েছেন, করোনা পরিস্থিতি নিয়ে দেশবাসী ও সংশ্লিষ্টদের ৩১ দফা নির্দেশনা দিয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছে- করোনাভাইরাস সম্পর্কে চিকিৎসাব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এ ভাইরাস সম্পর্কিত সচেতনতা কার্যক্রম বাস্তবায়ন করতে হবে। লুকোচুরির দরকার নেই, করোনাভাইরাসের উপসর্গ দেখা দিলে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হোন। পিপিই সাধারণভাবে সবার পরার দরকার নেই। চিকিৎসা-সংশ্লিষ্ট সবার জন্য পিপিই নিশ্চিত করতে হবে। এ রোগ চিকিৎসায় ব্যবহৃত পিপিই, মাস্কসহ সব চিকিৎসা সরঞ্জাম জীবাণুমুক্ত রাখা এবং বর্জ্য অপসারণের ক্ষেত্রে বিশেষ সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে।

কভিড-১৯ রোগের চিকিৎসায় নিয়োজিত সব চিকিৎসক, নার্স, ল্যাব টেকনিশিয়ান, পরিচ্ছন্নতাকর্মী, অ্যাম্বুলেন্স চালকসহ সংশ্লিষ্ট সবার স্বাস্থ্য সুরক্ষায় বিশেষ অগ্রাধিকার প্রদান করতে হবে। যারা হোম কোয়ারেন্টাইনে বা আইসোলেশনে আছেন, তাদের প্রতি মানবিক আচরণ করতে হবে। নিয়মিত হাত ধোয়া, মাস্ক ব্যবহার ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখাসহ এ ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলবেন।

নদীবেষ্টিত জেলাসমূহে নৌ-অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করতে হবে। অন্যান্য রোগে আক্রান্তদের যথাযথ স্বাস্থ্য পরীক্ষা এবং চিকিৎসাসেবা অব্যাহত রাখতে হবে। পরিচ্ছন্নতা নিশ্চত করতে হবে। সারা দেশের সব সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও উপজেলা পরিষদকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন কার্যক্রম আরও জোরদার করতে হবে। আইনশৃঙ্খলা বিষয়ে দৃষ্টি দিতে হবে। জাতীয় এ দুর্যোগে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ, প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, সশস্ত্র বাহিনী বিভাগসহ সব সরকারি কর্মকর্তা যথাযথ ও সুষ্ঠু সমন্বয়ের মাধ্যমে কাজ করে যাচ্ছেন, এ ধারা অব্যাহত রাখতে হবে।

ত্রাণকাজে কোনো ধরনের দুর্নীতি সহ্য করা হবে না। দিনমজুর, শ্রমিক, কৃষক যেন অভুক্ত না থাকে সে ব্যবস্থা নিতে হবে। তাদের সাহায্য করতে হবে। খেটে খাওয়া দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য অতিরিক্ত তালিকা তৈরি করতে হবে। সোশ্যাল সেফটিনেট কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে। অর্থনৈতিক কর্মকান্ড যেন স্থবির না হয় সে বিষয়ে যথাযথ নজর দিতে হবে। খাদ্য উৎপাদনব্যবস্থা চালু রাখতে হবে। অধিক প্রকার ফসল উৎপাদন করতে হবে। খাদ্যনিরাপত্তার জন্য যা যা করা দরকার করতে হবে। কোনো জমি যেন পতিত না থাকে। সরবরাহ ব্যবস্থা বজায় রাখতে হবে, যাতে বাজার চালু থাকে।

সাধারণ কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। জনস্বার্থে বাংলা নববর্ষের সব অনুষ্ঠান বন্ধ রাখতে হবে, যাতে জনসমাগম না হয়। ঘরে বসে ডিজিটাল পদ্ধতিতে নববর্ষ উদ্্যাপন করতে হবে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক নেতা, সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে একযোগে কাজ করতে হবে। প্রশাসনের সবাইকে নিয়ে কাজ করতে হবে। সরকারের পাশাপাশি সমাজের বিত্তশালী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানসমূহ জেলা প্রশাসক এবং উপজেলা নির্বাহী অফিসারের সঙ্গে সমন্বয় করে ত্রাণ ও স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম পরিচালনা করবেন। জনপ্রতিনিধি ও উপজেলা প্রশাসন ওয়ার্ডভিত্তিক তালিকা প্রণয়ন করে দুস্থদের মধ্যে খাবার বিতরণ করবেন।

সমাজের সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী, যেমন কৃষিশ্রমিক, দিনমজুর, রিকশা বা ভ্যানচালক, পরিবহন শ্রমিক, ভিক্ষুক, প্রতিবন্ধী, পথশিশু, স্বামীপরিত্যক্তা বা বিধবা নারী এবং হিজড়া সম্প্রদায়ের প্রতি বিশেষ নজর রাখাসহ ত্রাণ সহায়তা প্রদান নিশ্চিত করতে হবে। প্রবীণ নাগরিক ও শিশুদের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। দুর্যোগবিষয়ক স্থায়ী আদেশাবলি (এসওডি) যথাযথভাবে প্রতিপালনের জন্য সব সরকারি কর্মচারী ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।

নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের উৎপাদন, সরবরাহ ও নিয়মিত বাজারজাতকরণ প্রক্রিয়া মনিটরিংয়ের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। আতঙ্কিত হয়ে অতিরিক্ত পণ্য কিনবেন না। খাদ্যশস্যসহ প্রয়োজনীয় সব পণ্যের পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে। কৃষক নিয়মিত চাষাবাদ চালিয়ে যাবেন। এ ক্ষেত্রে সরকারি প্রণোদনা অব্যাহত থাকবে। সব শিল্পমালিক, ব্যবসায়ী ও ব্যক্তিপর্যায়ে নিজ নিজ শিল্প ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান এবং বাড়িঘর পরিষ্কার রাখবেন। শিল্পমালিকরা শ্রমিকদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে নিজেদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করে উৎপাদন অব্যাহত রাখবেন।

গণমাধ্যমকর্মীরা জনসচেতনতা সৃষ্টিতে যথাযথ ভূমিকা পালন করে চলেছেন। এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের গুজব ও অসত্য তথ্য যাতে বিভ্রান্তি ছড়াতে না পারে, সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। গুজব রটানো বন্ধ করতে হবে। ডিজিটাল প্ল্যাটফরমে নানা গুজব রটানো হচ্ছে। গুজবে কান দেবেন না এবং বিচলিত হবেন না।