
মেহেরপুর সদর উপজেলার রাজনগর গ্রামের মল্লিকপাড়া মাঠে গত শনিবার রাতটি নেমে এসেছিল এক অমানবিক কষ্টের বার্তা নিয়ে।
নীরব রাত, কিন্তু গ্রামের প্রতিটি ঘরে কান্নার রোল, প্রতিটি মানুষের চোখে জল। সামনে পাশাপাশি রাখা চারটি নিথর খাট, সাদা কাফনে মোড়া চারটি নিষ্পাপ শিশুর দেহ। এরা ছিল আপন দুই বোন, একজন চাচাতো বোন এবং একজন প্রতিবেশী খেলার সাথী।
গতকাল রবিবার রাত ১০টার সময় একসাথে জানাজার নামাজ শেষে রাজনগর কবরস্থানে পাশাপাশি চারটি কবরে শায়িত করা হয় তাদের।
গতকাল রবিবার দুপুরে রাজনগর গ্রামের বাড়ি থেকে তারা পাশের মশুরিভাজা বিলে গিয়েছিল শাপলা তোলার উদ্দেশ্যে। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামলেও যখন তারা ঘরে ফেরেনি, উদ্বিগ্ন পরিবার ছুটে যায় মশুরিভাজা বিলের দিকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই বিলের জলে একে একে ভেসে ওঠে চারটি শিশুর নিথর দেহ, যা পুরো এলাকায় শোকের ছায়া নামিয়ে আনে।
নিহতরা হলো আব্দুস সামাদের মেয়ে ফাতেমা (১৪) ও আফিয়া (১০)। এদের মধ্যে ফাতেমা মোমিনপুর মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী এবং আফিয়া বারাদি তৃণমূল মডেল একাডেমির চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী। ইরাকপ্রবাসী সাহারুল ইসলামের মেয়ে ও বারাদি তৃণমূল মডেল একাডেমির চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী আলেয়া (১০), ইসহাক আলীর মেয়ে ও আমঝুপি মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী মিম (১৪)। নিহত সবার বাড়ি রাজনগর গ্রামের মল্লিকপাড়ায়।
রাতের সেই হৃদয়বিদারক জানাজায় অংশ নেন সাবেক সংসদ সদস্য ও বিএনপি মনোনীত প্রার্থী মাসুদ অরুণ, জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট কামরুল হাসান এবং জেলা জামায়াতের আমির মাওলানা তাজউদ্দীন খান। মাওলানা তাজউদ্দীন খান নিজেই নিহতদের জানাজার ইমামতি করেন।
গ্রামের প্রবীণ আয়ুব আলী পাশাপাশি চারটি কবর খোঁড়ার কাজ করেছেন। তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, “এই বয়সে এসে একসাথে চারটা কবর খুঁড়তে হবে, তা কখনো ভাবিনি। এমন মর্মান্তিক মৃত্যু আমাদের গ্রাম দেখেনি।”
নিহত ফাতেমা ও আফিয়ার বাবা আব্দুস সামাদ কাঁদতে কাঁদতে বলেন, “আমার দুই মেয়ে একসাথে চলে গেল, আল্লাহ যেন তাদের জান্নাত দান করেন।” পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মিমের বাবা ইসহাক আলীও ছিলেন নির্বাক, শুধু নীরবে অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছিলেন।
মোমিনপুর মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আব্দুল জব্বার জানান, ফাতেমা তার বিদ্যালয়ের ছাত্রী ছিল। সে মেধাবী ও বিনয়ী ছিল। এমন সম্ভাবনাময় শিক্ষার্থী হারানো বিদ্যালয়ের জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি।
এ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী দুই যুবক জানান, তারা ভ্যানযোগে যাওয়ার সময় দূর থেকে দেখেন মেয়েগুলো পানিতে নেমেছে, ভেবেছিলেন খেলছে। কিছু সময় পরেই শোনেন, তারা আর নেই। তারা আক্ষেপ করে বলেন, “জানলে হয়তো দৌড়ে গিয়ে বাঁচানোর চেষ্টা করতাম।”