একমাত্র মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবিষ্যৎ

বাংলাদেশে মানসম্মত স্নাতকোত্তর চিকিৎসা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় জনগণের প্রত্যাশার একমাত্র ভরসাস্থল। ১৯৬৫ সাল থেকে ঐতিহ্যবাহী আইপিজিএমআর নামে শুধু চিকিৎসদের স্নাতকোত্তর ডিগ্রি প্রদান করে আসছে, এই প্রতিষ্ঠানটি। আন্ডারগ্র্যাজুয়েট মেডিকেল শিক্ষা বাংলাদেশে এখনও বিচ্ছিন্নভাবে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত আছে, যেখান থেকে তাদের ডিগ্রি প্রদান করা হয়। ফলে মান ও সমতা বিধানে বিরাজ করছে বৈষম্য।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯৮ সালের ৩০ এপ্রিল চিকিৎসক সমাজের দীর্ঘদিনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকার শাহবাগস্থ আইপিজিএমআরকে উন্নীত করে দেশের প্রথম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন।

এই প্রাপ্তি আমাদের দেশের জন্য একটি আলোকবর্তিকা। মেডিকেল উচ্চশিক্ষা ও উন্নত গবেষণার মাধ্যমে দেশের মানুষকে উন্নত বিশ্বের ন্যায় স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের লক্ষ্যে মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ।

চিকিৎসা শিক্ষায় স্নাতকোত্তর কোর্স প্রদান ও স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের লক্ষ্যে ১৯৬৫ সালের ডিসেম্বরে ঢাকায় শাহবাগ হোটেলের জায়গায় ইনস্টিটিউট অব পোস্টগ্র্যাজুয়েট মেডিসিন অ্যান্ড রিসার্চ (আইপিজিএমআর) প্রতিষ্ঠিত হয়। স্নাতকোত্তর পর্যায়ের শিক্ষা ও গবেষণার দায়িত্বপ্রাপ্ত হলে ও এই প্রতিষ্ঠান মেডিকেল ডিগ্রি প্রদানের ক্ষমতা ছিল না। ডিগ্রি প্রদানের ক্ষমতা ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের।

চিকিৎসা শিক্ষায় উচ্চাতর শিক্ষা ও গবেষণা প্রবর্তন করে দেশের চিকিৎসা শিক্ষা ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক তৈরিতে আইপিজিএমআর প্রতিষ্ঠিত হয়। এ দেশের মানুষের রক্তের প্রয়োজনে নিরাপদ রক্ত সরবরাহ ও নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালনের জন্য বঙ্গবন্ধু তৎকালীন আইপিজিএমআর এ প্রথম ব্লাড ব্যাংক স্থাপন করেন।

বঙ্গবন্ধু নিজ হাতে এই ব্লাড ব্যাংকের উদ্বোধন করেন আজও বঙ্গবন্ধুর হাতের ছোঁয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের রক্ত পরিসঞ্চালন বিভাগে বিদ্যমান। বঙ্গবন্ধুই প্রথম এ দেশের চিকিৎসকদের মর্যাদা বৃদ্ধি করে তাদের চাকরিতে দ্বিতীয় শ্রেণি থেকে প্রথম শ্রেণিতে উন্নীত করেছিলেন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে এ দেশের ছাত্র-যুবক, শিক্ষক-চিকিৎসক কৃষক-শ্রমিক-জনতাসহ সকল পেশার মানুষ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে বাংলাদেশ স্বাধীন করেছিল। স্বাধীনতা অর্জনের মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট দেশি-বিদেশি চক্রান্তে স্বাধীন বাংলাদেশের মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার মাধ্যমে লক্ষ্যচ্যুত হয় বাংলাদেশ।

আবার এ দেশের মানুষের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয় অগণতান্ত্রিক সামরিক স্বৈরশাসন। স্বৈরতান্ত্রিক অপশাসনের ফলে প্রতিটি ক্ষেত্রেই বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়তে থাকে, স্বাস্থ্য খাত তার মধ্যে অন্যতম।

উল্লেখ্য ‘৬৯-এর ছাত্র গণআন্দোলনের ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের দেওয়া ১১ দফার মধ্যেও চিকিৎসকদের মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবির কথা উল্লেখ ছিল। বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ মেডিকেল শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন ও আইপিজিএমআর শিক্ষক সমিতি একটি স্বতন্ত্র ও গবেষণা সমৃদ্ধ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেছে।

প্রত্যেকটি সংগঠনের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত থেকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করতে পারায় নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করি। বাঙালির নয়নের মনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর কোনো সরকারই স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নের জন্য তেমন পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি।

বাংলাদেশের প্রথম স্বতন্ত্র পাবলিক মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার অবদান এ দেশের জনগণ ও চিকিৎসক সমাজ কৃতজ্ঞতার সঙ্গে চিরদিন স্মরণ করবে।

প্রথম পাবলিক মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে চিকিৎসক সমাজ আন্তর্জাতিক মান অর্জন করে জনসাধারণের চিকিৎসায় নিয়োজিত হবেন, এ আকাঙ্ক্ষা নিয়ে যে মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় যাত্রা শুরু করেছিল, প্রতিষ্ঠার মাত্র তিন বছরের মাথায় ২০০১ সালে সরকার পরিবর্তনের পর কেবল হীনরাজনৈতিক সংকীর্ণতায় বিশ্ববিদ্যালয়টি বন্ধ করে আবারও আইপিজিএমআর করার উদ্যোগ নেয় বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার।

জনসাধারণের বিপুল জনসমর্থন নিয়ে আবারও ২০০৮ সালে শেখ হাসিনা সরকার পরিচালনার দায়িত্ব নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়কে সেন্টার অব এক্সিলেন্সে পরিণত করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন।

বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস সম্প্রসারণের জন্য প্রধানমন্ত্রী বারডেমসংলগ্ন বেতার ভবনের জমি ও হাসপাতালের উত্তর পাশের ১২ বিঘা জমির স্থায়ী বন্দোবস্ত করে দেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক উন্নয়নে ৫২৫ কোটি টাকা বরাদ্দ প্রদান করেন।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রত্যক্ষ সহায়তা ও দিকনিদের্শনায় খুব দ্রুত নতুন কেবিন ব্লক সম্প্রসারণ, অনকোলজি ভবন, নতুন বহির্বিভাগ, আধুনিক আইসিইউ, ওটি কমপ্লেক্স, ডরমিটরি মেডিকেল কনভেনশন সেন্টার নির্মাণ সম্ভব হয়েছে।

মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাদের ভাতা প্রদান ও চাকরিসহ কোটা প্রবর্তন এবং নানামুখী কর্মসূচি গ্রহণ করেছেন।
রেসিডেন্সি প্রোগ্রামে চান্স পাওয়া বেসরকারি ছাত্রছাত্রীদের মাসিক সম্মানী ১০-২০ হাজার টাকায় উন্নীত করা হয়েছে।

দেশের সব মেডিকেল কলেজসহ সব পোস্টগ্র্যাজুয়েট চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানসমূহকে অত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করে সব উচ্চতর চিকিৎসা শিক্ষা (এমফিল, এমএস, এমডি, ডিপ্লোমা) ডিগ্রি ও কোর্সসমূহকে একই মানে উন্নীত করা ও ডিগ্রি প্রদানের ব্যবস্থা করেন। এমবিবিএস ডিগ্রি ও এই বিশ্ববিদ্যলয়ে প্রদান করতে পারলে, যা মান নিয়ন্ত্রণে সঠিক ভূমিকা পালন করবে।

সরকারের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় কোরিয়া সরকারের আর্থিক ও কারিগরি সহায়তার এক হাজার শয্যাবিশিষ্ট কোরিয়া মৈত্রী বিশেষায়িত হাসপাতাল স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে, যা এ সরকারের আরও একটি সাফল্য।

ভিশন: দক্ষিণ এশিয়ায় এ বিশ্ববিদ্যালয়কে সেন্টার অব এক্সেলেন্স হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।

লক্ষ্য: উন্নত ও উচ্চমান সম্পন্ন মেডিকেল শিক্ষা চিকিৎসাসেবা ও গবেষণালব্ধ জ্ঞানার্জন করা। স্বাস্থ্য জনবল তৈরি করা ও প্রশিক্ষণ প্রদান করা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল কাজ।

অন্যান্য চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান থেকে রেফার করা রোগীদের উন্নত চিকিৎসাসেবা প্রদান করে জাতীয় পর্যায়ে জনগণের চিকিৎসা প্রত্যাশা পূরণ করা। রোগী যাতে বিদেশ না যায় তেমন চিকিৎসা ব্যবস্থা চালু করা।
ভবিষ্যতের করণীয়—

* নষ্ট হতে যাওয়া কনভেনশন হলকে চালু করা ও উন্নত শিক্ষা, সেমিনার সিম্পোজিয়ামের মাধ্যমে পোস্টগ্র্যাজুয়েট ছাত্রদের প্রশিক্ষণ জোরদার করা

* জরুরি বিভাগ চালু করা ও ছাত্রদের প্রশিক্ষণ হালনাগাদ করা

* বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের অপশনের ভিত্তিতে ইনস্টিটিউশনাল প্র্যাকটিসের ব্যবস্থা করা

* অপশন প্রদানকারী শিক্ষকদের ননপ্র্যাকটিসিং প্রণোদনা ভাতা প্রদান করা

* নষ্ট হতে যাওয়া চালু না হওয়া ডরমিটরিকে ছাত্রদের থাকার উপযোগী করা

* বেতার ভবনকে উন্নত পরিকল্পনার মাধ্যমে কাজে লাগানো ও বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি জাদুঘর নির্মাণ করা

* আউটডোরের লিফটগুলো দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ আছে। বয়স্ক বা হাঁটতে অক্ষম রোগীদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে সেবা নেওয়া অনেক কষ্টকর হয়ে পড়েছে। তাই অতিদ্রুত লিফটগুলো সচল করা প্রয়োজন

* বৃষ্টিতে অনেক যন্ত্র নষ্ট হয়ে গেছে। আউটডোরে পর্যাপ্ত হুইলচেয়ারের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। যেন বয়স্ক বা হাঁটতে অক্ষম রোগীরা সহজে সেবা নিতে পারে।

* কেবিন ব্লকে করোনা ইউনিট চালু করা হয়েছে। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় সব ধরনের অপারেশন বন্ধ আছে দীর্ঘদিন যাবৎ। এ কারণে অপারেশনজনিত রোগীরা অনেক ভোগান্তির সম্মুখীন হচ্ছে। করোনা ইউনিট কেবিন ব্লকে না করে বেতার বা কনভেনশন সেন্টারে করা হলে ভালো হতো।

* নতুন কোনো রোগী বিশ্ববিদ্যালয়ে সেবা নিতে এলে অনেক সমস্যায় পড়েন। কোথায় কোন টেস্ট হয় তা যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন পয়েন্টে ইনডিকেটর করে দেওয়া যায় তা হলে সমস্যা কম হয়

* আউটডোর-১ এবং আউটডোর-২ এর মাঝের রাস্তা রিকশা এবং সিএনজিমুক্ত করতে হবে। তা হলে রোগীদের ক্যানসার ভবনে যাওয়ার পথে ভোগান্তি কম হবে

* ডে কেয়ার সেন্টার পুনরায় চালু করা

* টিএসসি চালু করে আবার ছাত্র-শিক্ষকদের সমস্যা দূর করা

* নিয়মিত ডিন নির্বাচন হওয়া উচিত

* নিয়মিত শিক্ষক সমিতি নির্বাচন দরকার ও শূন্যপদ পূরণসহ সময়মতো পদোন্নতি প্রদান করা

* শিক্ষক ও চিকিৎসক নিয়োগ আরও স্বচ্ছতা থাকা প্রয়োজন

* বি- ব্লক থেকে ডি-ব্লক এবং মসজিদের গেট থেকে ক্যানসার ভবন পর্যন্ত সিলিংয়ের (ছাদ) ব্যবস্থা করা। সিলিংয়ের অভাবে বর্ষার সময়ে রোগীদের অনেক ভোগান্তিতে পড়তে হয়

* বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টাফদের হেলথ কার্ড এখনও চালু করা হয়নি। যেটি চালু করা অত্যন্ত প্রয়োজন

উন্নত চিকিৎসাসেবা প্রদান, উন্নত চিকিৎসা শিক্ষা ও গবেষণায় আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক সংযুক্তির মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় আন্তর্জাতিক মানের বিশ্ববিদ্যালয় হিসাবে বিশ্বের বুকে মাথা তুলে দাঁড়াবে এই প্রত্যাশা সবার।

মহান আল্লাহতায়ালার কৃপায় আমরা করোনার ছোবল থেকে রক্ষা পাব নিশ্চয়ই এবং এই দুর্যোগ কাটিয়ে আমরা করোনা বিধ্বস্ত বাংলাদেশকে ও কেল বিশ্ববিদ্যালয়কে উচ্চতর পর্যায়ে নিয়ে যেতে একত্রে কাজ করব।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সকল নির্দেশনা সঠিকভাবে মেনে চিকিৎসা শিক্ষা, চিকিৎসাসেবা ও উন্নত গবেষণার মাধ্যমে আমরা উন্নত চিকিৎসা, শিক্ষা ও গবেষণা এবং স্বাস্থ্য খাতকে আন্তর্জাতিক মানে নিয়ে যেতে সক্ষম হব বলে আশা করি।