
এক বছরে মেহেরপুরের গাংনী ও মুজিবনগর সীমান্ত দিয়ে ৩৭২ বাংলাদেশিকে হস্তান্তর ও পুশ ইন করেছে বিএসএফ। এক বছরে মেহেরপুরের গাংনী ও মুজিবনগর উপজেলার বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে মোট ৩৭২ জন বাংলাদেশিকে হস্তান্তর ও পুশ ইন করেছে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ)।
কাজের সন্ধানে এসব বাংলাদেশি অবৈধভাবে বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে ভারতে প্রবেশ করেন। তাদের মধ্যে কেউ ১৫ বছর আগে, কেউ ১০ বছর আগে, আবার কেউ চার-পাঁচ বছর আগে ভারতে যান। সেখানে তারা বিভিন্ন ইটভাটা ও কলকারখানায় শ্রমিক হিসেবে কাজ করছিলেন।
গত ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পর ভারতীয় কর্তৃপক্ষ অবৈধভাবে অবস্থানরত বাংলাদেশিদের আটক করে হাজতে পাঠায়। হাজত থেকে মুক্তির পর রাতের আঁধারে অবৈধ প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে তাদের বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে, যা পুশ ইন নামে পরিচিত।
সূত্র জানায়, এর মধ্যে ২০৫ জন বাংলাদেশিকে পতাকা বৈঠকের মাধ্যমে বিজিবির কাছে বিএসএফ হস্তান্তর করে। অপরদিকে, ১৬৭ জনকে মেহেরপুরের বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে বিএসএফ অবৈধভাবে পুশ ইন করেছে।
মেহেরপুরের গাংনী সীমান্ত দিয়ে রাতের আঁধারে নারী, শিশু ও পুরুষসহ ৩০ জন বাংলাদেশিকে পুশ ইন করেছে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ)।
৩ ডিসেম্বর, মেহেরপুরের গাংনী সীমান্ত দিয়ে রাতের আঁধারে ভারতে বিভিন্ন সময়ে পুলিশের হাতে আটক হওয়া নারী, শিশু ও পুরুষসহ ৩০ জন বাংলাদেশিকে পুশ ইন করেছে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ)।
পুশ ইন হওয়া সবাই ভারতের কলকাতাসহ বিভিন্ন রাজ্যে কাজ করতে গিয়ে ধরা পড়ে এবং বিভিন্ন মেয়াদে ভারতে কারাভোগ করেন। আটকদের মধ্যে ১৮ জন পুরুষ, ২ জন শিশু ও ১২ জন নারী রয়েছেন। তারা সবাই খুলনা, লালমনিরহাট ও আশপাশের জেলার বাসিন্দা।
আটকদের একজন জানান, কাজের সন্ধানে তারা অবৈধভাবে ভারতে গিয়েছিলেন এবং কলকাতাসহ বিভিন্ন স্থানে বসবাস করছিলেন।
নভেম্বর ১৯, গাংনী উপজেলার কাথুলী সীমান্তে পতাকা বৈঠকের মাধ্যমে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) ২৪ জন বাংলাদেশিকে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)-এর কাছে হস্তান্তর করেছে।
পতাকা বৈঠকে বিজিবির পক্ষ থেকে কাথুলী কোম্পানির দপ্তর কমান্ডার নায়েক সুবেদার মো. কামরুজ্জামান এবং বিএসএফের পক্ষ থেকে ভারতের নদীয়া জেলার তেহট্টার ৫৬ ব্যাটালিয়নের তেইরপুর কোম্পানি কমান্ডার এসি আনচ কুমার উপস্থিত ছিলেন।
অক্টোবর ২৬, মুজিবনগর উপজেলার সীমান্ত দিয়ে কোম্পানি কমান্ডার পর্যায়ের পতাকা বৈঠকের পর ভারতে অবৈধভাবে অনুপ্রবেশকারী নারী, পুরুষ ও শিশুসহ ২৯ জন বাংলাদেশিকে বিজিবির কাছে হস্তান্তর করেছে বিএসএফ। হস্তান্তরিতদের মধ্যে ১১ জন পুরুষ, ১৭ জন নারী ও ১ জন শিশু রয়েছেন।
অক্টোবর ২৫, মেহেরপুরের গাংনীর দুই সীমান্ত দিয়ে ভারতে আটক ৬ জন তৃতীয় লিঙ্গের সদস্যসহ ৬০ জন নারী-পুরুষকে বাংলাদেশে হস্তান্তর করেছে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ)। শনিবার সকালে মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার কাজিপুর ও কাথুলী সীমান্ত দিয়ে পতাকা বৈঠকের মাধ্যমে তাদের হস্তান্তর করা হয়। সকাল ১০টার দিকে কাজিপুর সীমান্তের আন্তর্জাতিক পিলার ১৪৭ মেইন পিলারের নিকট শহীদ স্মরণী অংশে প্রথম দফায় ৩০ জনকে হস্তান্তর করা হয়। এ সময় উপস্থিত ছিলেন কুষ্টিয়ার ৪৭ বিজিবি ব্যাটালিয়নের সদস্যরা। এরপর বেলা ১২টার দিকে একই উপজেলার কাথুলী সীমান্তের আন্তর্জাতিক সীমান্ত পিলার ১৩৩/৩ এসের নিকটে দ্বিতীয় দফায় আরও ৩০ বাংলাদেশিকে হস্তান্তর করা হয়।
ভারতের তেইমপুর বিএসএফ ক্যাম্পের কোম্পানি কমান্ডার অনোজ কুমার পতাকা বৈঠকের মাধ্যমে তাদের কাথুলী কোম্পানি কমান্ডার সুবেদার মিজানুর রহমানের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে হস্তান্তর করেন।
১৮ অক্টোবর, গাংনী উপজেলার কাথুলী সীমান্ত দিয়ে নারী-পুরুষ ও শিশুসহ ১৪ জনকে বিজিবির কাছে হস্তান্তর করেছে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ। এদের মধ্যে ৬ জন পুরুষ, ৪ জন নারী ও ৪ জন শিশু রয়েছে।
সেপ্টেম্বর ২০, মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার কাজিপুর সীমান্তে পতাকা বৈঠকের মাধ্যমে দিনে দুই দফায় মোট ২২ জন বাংলাদেশি নাগরিককে ফেরত দিয়েছে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ)।
সেপ্টেম্বর ১৯, মুজিবনগর সীমান্তের স্বাধীনতা সড়কে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের ১০৫ নম্বর পিলারের কাছে পতাকা বৈঠকের মাধ্যমে ভারতে অনুপ্রবেশকারী এক শিশুসহ চার বাংলাদেশি নাগরিককে ফেরত দিয়েছে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ)।
সেপ্টেম্বর ৬, মেহেরপুরের মুজিবনগর উপজেলার দারিয়াপুর সীমান্ত দিয়ে মা ও দুই মেয়েকে পুশ ইন করেছেন ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ)। শুক্রবার সকালে বিজিবির সদস্যরা ওই তিনজনকে আটক করে মুজিবনগর থানায় সোপর্দ করেছেন।
আগস্ট ১৯, মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার কাজিপুর সীমান্তে বিজিবি ও বিএসএফের মধ্যে পতাকা বৈঠকের মাধ্যমে নারী ও শিশুসহ ৩৯ জনকে হস্তান্তর করেছে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বিএসএফ। মঙ্গলবার দুপুর আড়াইটার সময় কাজিপুর সীমান্তের আন্তর্জাতিক সীমান্ত পিলার ১৪৭ এর নিকট বিজিবির কাছে তাদের হস্তান্তর করে বিএসএফ।
১৪ আগস্ট, মুজিবনগর সীমান্তে পতাকা বৈঠকের মাধ্যমে ৯ বাংলাদেশি নাগরিককে বিজিবির কাছে হস্তান্তর করেছে ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ।
বৃহস্পতিবার সকাল ১০টার দিকে চুয়াডাঙ্গা ব্যাটালিয়ন (৬ বিজিবি) এবং ভারতের ১৬১ বিএসএফ ব্যাটালিয়নের মধ্যে মেইন পিলার ১০৫-এর নিকটে শূন্য লাইনে কোম্পানি কমান্ডার পর্যায়ে এই পতাকা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
হস্তান্তর হওয়া ব্যক্তিরা হলেন, ফরিদপুর ভাঙ্গা থানার ওদুদ শেখের ছেলে আবু সাইদ (৪৫), তার স্ত্রী বিউটি বেগম (৪০), ছেলে সম্রাট (৭) ও মেয়ে শিমলা আক্তার (১১), ফরিদপুর নগরকান্দা থানার বদিরুজ্জামান (৩৯), তার স্ত্রী ডলি (৩৫), মেয়ে লামিয়া আক্তার (৬), ছেলে আলী আকবার (৪) ও মেয়ে ছাদিয়া আক্তার (১.৫)।
আগস্ট ১৩, মেহেরপুরের মুজিবনগরে ১ জন পুরুষ ও ৩ জন মহিলাসহ মোট ৪ জনকে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) পুশইন করেছে। পরে অবৈধ অনুপ্রবেশের দায়ে তাদের আটক করেছে মুজিবনগর থানা পুলিশ।
আগস্ট ১, মুজিবনগর সীমান্তে বিজিবি ও বিএসএফের মধ্য পতাকা বৈঠকের মাধ্যমে চার শিশু, পাঁচ নারীসহ ১৭ বাংলাদেশীকে ফেরৎ পাঠিয়েছে বিএসএফ। শুক্রবার সকাল সাড়ে ১১টা থেকে ১২ টা পর্যন্ত ৬ বিজিবি এবং ১৬১ বি এস এফ এর কোম্পানি কমান্ডার পর্যায় পতাকা বৈঠকের মাধ্যমে এসব বাংলাদেশীকে ফেরৎ দেন তারা।
২৯ জুলাই, মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে ৭ জন নারীসহ ১৮ জনকে পুশইন করেছে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ)।
২৬ জুন, মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার রংমহল সীমান্ত দিয়ে ৮ জন বাংলাদেশি নারী, পুরুষ ও শিশুকে পুশ-ইন করেছে ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ)।
২৬ জুন, মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার রংমহল সীমান্ত দিয়ে ৮ জন বাংলাদেশি নারী, পুরুষ ও শিশুকে পুশ-ইন করেছে ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ)।
১০ জুন, ভোরে মুজিবনগর উপজেলার আনন্দবাস সীমান্ত দিয়ে ১২ জনকে, ৪ মে ভবেরপাড়া সীমান্ত দিয়ে ১০ জনকে, ২৫ মে সোনাপুর সীমান্ত দিয়ে ১৯ জনকে এবং ২৭ মে সোনাপুর সীমান্ত পিলার ১০১ কাগমারী মাঠ দিয়ে আরও ৩০ জন বাংলাদেশিকে পুশ ইন করা হয়।
২৬ ফেব্রুয়ারি সোনাপুর মাঝপাড়া সীমান্ত দিয়ে ১৫ জন বাংলাদেশিকে পুশ ইন করে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী।পুশ ইন হওয়া বাংলাদেশিদের অধিকাংশের বাড়ি কুড়িগ্রাম জেলায়। এর পাশাপাশি চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, পাবনা, লালমনিরহাট, কক্সবাজার, ফরিদপুর, পিরোজপুরের নাগরিক রয়েছেন।
ভারত থেকে আসা কয়েকজন জানিয়েছেন, তাঁরা সবাই বাংলাদেশি। বিভিন্ন সময়ে তাঁরা অবৈধভাবে ভারতে গিয়েছিলেন। সেখানকার পুলিশ তাঁদের আটক করে বিএসএফের কাছে হস্তান্তর করে। পরে বিএসএফ তাঁদের সীমান্তে এনে কাঁটাতারের গেট খুলে জোর করে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয়।
কক্সবাজারের রিয়াজ আলী বলেন, প্রায় চার বছর হলো জীবিকার আশায় চোরাইপথে ভারতে গিয়েছিলাম। নয়ডা জেলার একটি লোহার কারখানায় চাকরি করতাম। ২ মে পুলিশ এসে তুলে নিয়ে যায়। পরে তারা আমাকে নদীয়া জেলার কারাগারে পাঠায়। সেখান থেকে একটি ট্রাকে সীমান্তে এনে ফেলে দেয়।
কুড়িগ্রাম জেলার জাহাঙ্গীর আলম ও বাবুল হোসেন বলেন, তারা দুজনই পরিবার নিয়ে প্রায় এক যুগ আগে ভারতে গিয়েছিলেন। গত বছরের পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার বহরমপুর বাজারে একটি বহুতল ভবনের নির্মাণশ্রমিক হিসেবে কাজ শুরু করেছিলাম। ভারতে বাংলাদেশের চেয়েও খারাপ পরিস্থিতি। গত মাসে পরিবার নিয়ে দেশে ফেরত আসার সময় বিএসএফ আটক করে তাদের জেলে পাঠায়।
জেল থেকে হৃদয়পুর সীমান্ত এলাকায় ট্রাকে করে এনে তাঁদের জড়ো করে এবং কাঁটাতারের মাঝখানে যে দরজা আছে, সেটা খুলে আমাদের বাংলাদেশের ভেতরে ঠেলে দেয়।
মুজিবনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মিজানুর রহমান বলেন, পুশ ইন হওয়া ব্যক্তিদের বিজিবি থানায় হস্তান্তর করলে আমরা আইনানুগভাবে ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি।
চুয়াডাঙ্গা-৬ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল নাজমুল হাসান বলেন, মেহেরপুর সীমান্ত দিয়ে পুশ ইন প্রতিরোধে বিজিবি কঠোর নজরদারি ও টহল তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। সীমান্তবর্তী জনসাধারণকে সঙ্গে নিয়ে আমরা সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থানে রয়েছি।
কোনো ব্যক্তি যাতে বেআইনিভাবে সীমান্ত অতিক্রম করে দেশে ঢুকতে না পারে, সে বিষয়ে আমরা সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নিয়েছি। পাশাপাশি, যেসব ক্ষেত্রে যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ না করে পুশ ইন-এর চেষ্টা হয়েছে, সেগুলোর বিরুদ্ধে আমরা নিয়মিতভাবে বিএসএফের সঙ্গে বিভিন্ন পর্যায়ে পতাকা বৈঠকের মাধ্যমে মৌখিক ও লিখিতভাবে প্রতিবাদ জানাচ্ছি।