
দশর্না একটি নাম। যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে ইতিহাস, সংস্কৃতি, শিল্প ও বাণিজ্যের দীর্ঘ ঐতিহ্য। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ১২.৫০ বর্গ কিলোমিটারের এই ছোট্ট শহরটি এক সময় ছিল গৌরবের প্রতীক। সীমান্তবর্তী এই নগরী থেকেই ১৮৬২ সালের ১৫ নভেম্বর বর্তমান ভারতের রানাঘাট থেকে দর্শনা হয়ে কুষ্টিয়ার জগতি পর্যন্ত রেলপথের আনুষ্ঠানিকভাবে ট্রেন চলাচলের মাধ্যমে রেল পরিষেবার সূচনা ঘটে আজকের বাংলাদেশ ভূখণ্ডে।
বাংলাদেশের প্রথম রেলপথ, ‘দর্শনা’ নামে একটি নগরীর পত্তন। ইতিহাসের পাতা থেকে পাওয়া যায় দর্শনা নামটি ১৮০০ সালের কিছু আগে থেকেই প্রচলিত। ১৭৮৭ সালের ২১ মে মার্চ নদীয়া জেলা গঠিত হয়, তখনও এই স্থানটির নাম দর্শনা ছিল। রেনল্ড গেজেট থেকেও জানা যায় ১৮০০ সালের গোড়ার দিকেও এই অঞ্চলের নাম ছিল দর্শনা। সেইটা কিন্তু আমার এখন যে দর্শনার কথা বলি, সেইটা না! এখন বহুল প্রচলিত দর্শনার পাশেই ‘কোটালি দর্শনা’ নামের একটি গ্রামের নামের খন্ডাংশ থেকে পাওয়া বর্তমান ‘দর্শনা’। সবচে প্রচলিত এবং আলোচিত যা পাওয়া ইতিহাস,- কোটালি দর্শনার একজন ইঞ্জিনিয়ার রানাঘাট থেকে জগতি পর্যন্ত চলাচলের জন্য নির্মিত রেলপথের দায়িত্ব পাওয়া একজন মানুষের কৃতিত্ব। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘বাংলার ইতিহাস’ বই থেকে পাওয়া যায়, ‘রামনগর থেকে ভবানীপুর (ঈশ্বরচন্দ্রপুরের পুরাতন নাম) গ্রামের বুক চিরে পদ্মা নদীর শাখা মাথাভাঙ্গা নদীর পাশ দিয়ে বাষ্পশকট চলাচলের লৌহ নির্মিত পথ নির্মাণের মহাযজ্ঞ চলিতেছে’। তখনও আমাদের এ দর্শনা পায়নি। শোনা যায় কোটালি দর্শনার শ্রদ্ধেয় সেই ইঞ্জিনিয়ার মানুষটির মেধা আর বর্তমান ভারত থেকে আসা হাজার হাজার বিহারি সম্প্রদায়ের মানুষের শ্রম-ঘামের বিনিময়ে নির্মিত হিন্দু জমিদার এস্টেটের ভূমির ওপর মাথাভাঙ্গা নদীর কাটা খালের মুখের জায়গাটা কোটালী দর্শনার মানুষটির দেয়া নামের পত্তন হলো “দর্শনা” নামের এক নগর সভ্যতার। দর্শনা তখন থেকেই শুরু এ অঞ্চলের মানচিত্রের যোগাযোগ, সংস্কৃতি ও উন্নয়নের এক প্রাণকেন্দ্র।
১৮৬২ সালের ১৫ নভেম্বরের নির্মিত সেই দর্শনার কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আজ আলোর প্রদীপটি ধীরে ধীরে নিভে যাচ্ছে। শহরের প্রাণবন্ততা কমে এসেছে, পুরনো ঐতিহ্যের জায়গায় এসেছে অব্যবস্থাপনা, উদাসীনতা আর অবক্ষয়। জন কেরু নামের ব্রিটিশ সাহেবের ১৯৩৮ সালে কেরু এন্ড কোম্পানি প্রতিষ্ঠিত চিনিকলের হুইসেল বাজত, সেখানে এখন নীরবতা। রেলস্টেশনের কোলাহল ম্লান হয়ে গেছে। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর ১৯৫২ সালে ১৩.৬৬ একর জমিতে তৎকালীন কাস্টমস ও এক্সাইজ কালেকটরেট খুলনার অধীনে প্রতিষ্ঠিত দর্শনা কাস্টমস কলোনি। এক এলাহি ব্যাপার! রেল-কেরু-কাস্টমস, সব মিলিয়ে ২৪ ঘন্টায় কমপক্ষে ২০ হাজার কর্মজীবী মানুষ ছুটে চলা, আনন্দ-উৎসব।
সে শহরের দোকানপাটে আগের মতো বেচাকেনা নেই। শহরের প্রান্তে দারিদ্র্য আর বেকারত্বের ছায়া ঘন হয়ে উঠেছে।
দর্শনার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যও আজ ক্ষয়ে যাচ্ছে। একসময় এখানে নাট্যচর্চা, সাহিত্যসভা, সংগীত-আড্ডা—সব ছিল প্রাণবন্ত। আজ সেসব উদ্যোগ নেই বললেই চলে। তরুণ প্রজন্মের অনেকেই শহরের ইতিহাস জানে না; তারা অন্য শহরের চাকরির টানে বা জীবিকার প্রয়োজনে চলে যাচ্ছে দূরে। ফলে দর্শনার মাটিতে যেই আলোর রেখা একদিন গর্বের সঙ্গে জ্বলেছিল, আজ তা নিভু নিভু।
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সীমান্তবর্তী শহর দর্শনা ইতিহাস, ঐতিহ্য ও অর্থনৈতিক গুরুত্বে এক সময় ছিল গৌরবময় নাম। এটি কেবল একটি সীমান্তনগরী নয়, বরং বাংলাদেশের প্রথম রেলস্টেশন এবং প্রথম চিনিকল। এই শহর দেশের প্রাচীন শিল্পবাণিজ্য, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক বিকাশের সাক্ষী। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় দর্শনা তার ঐতিহ্য হারাতে বসেছে। রাজনৈতিক নেতৃত্বের লালসা, অর্থনৈতিক অনিয়ম, সামাজিক অবক্ষয় ও সাংস্কৃতিক বিভাজন আজ শহরটিকে অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
রাজনৈতিক নেতৃত্বের লালসা-নৈতিক অবক্ষয় :
দর্শনার রাজনৈতিক ইতিহাস ছিল একসময় সংগ্রামী ও আদর্শনিষ্ঠ। যখন জন কেরু সাহেব চিনিকলের আখ চাষের জন্যে আশ-পাশের জমিগুলো দখল নিয়ে ফার্ম তৈরী শুরু করে তখন উপমহাদেশের প্রখ্যাত কমিউনিস্ট নেতা মুজাফফর আহমদ এসে এ অঞ্চলের চাষিদের সংগঠিত করতে জনসভা করেছিলো আজকের বাজার মসজিদ সংলগ্ন বলখেলার ফিল্ডে। ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধকালীন আন্তর্জাতিক যোগাযোগের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র ছিলো। মুক্তিযুদ্ধ-পূর্ববতী সময়ে এখানকার নেতৃত্ব জনকল্যাণ, অবকাঠামো, শিক্ষা ও শিল্পোন্নয়নকে কেন্দ্র করে কাজ করেছিল। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী, বিশেষত ১৯৯১ সালের পর থেকে বর্তমানে সেই নেতৃত্ব পরিণত হয়েছে ক্ষমতার প্রতিযোগিতা ও ব্যক্তিস্বার্থে নিমজ্জিত এক গোষ্ঠীতে। দলীয় রাজনীতির প্রভাবে স্থানীয় প্রশাসন, শিল্প প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে সাংস্কৃতিক সংগঠন পর্যন্ত—সব ক্ষেত্রেই ছড়িয়ে পড়েছে পক্ষপাতিত্ব ও দখলদারিত্ব। প্রকৃত জননেতৃত্ব আজ হারিয়ে গেছে দলীয় ‘কর্মী’ ও ব্যবসায়িক সিন্ডিকেটের হাতে। ফলে দর্শনার উন্নয়ন এখন কেবল বক্তৃতা বা ব্যানারে সীমাবদ্ধ, বাস্তবে নয়।
অর্থনৈতিক কাঠামোর ভাঙন; ঐতিহ্যের পতন :
দর্শনার অর্থনীতি একসময় দাঁড়িয়ে ছিল তিনটি স্তম্ভের ওপর—রেলপথ, কেরু অ্যান্ড কোম্পানি এবং সীমান্ত বাণিজ্য।
রেলপথ: ব্রিটিশ আমলে দর্শনা থেকে যে রেল সংযোগ গড়ে ওঠে। এটি ছিল দেশের শিল্পবাণিজ্যের মূলধারা কিন্তু বর্তমানে সেই ঐতিহাসিক রেলপথ অবহেলা ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে আর লুটপাটে প্রায় অচল। একইভাবে পাকিস্তান পর্বে নির্মিত খুলনা-দর্শনা সংযোগকারী রেলপথ ‘হল্ট ষ্টেশন’ আধুনিকীকরণ তো দূরের কথা, ন্যূনতম পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতাও অনুপস্থিত।
কেরু অ্যান্ড কোম্পানি : ১৯৩৮ সালে প্রতিষ্ঠিত এই চিনিকলটি দেশের প্রথম শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর একটি। একসময় হাজারো শ্রমিকের জীবিকার উৎস ছিল এটি কিন্তু আজ সেটি দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা, দলীয় প্রভাব ও অবকাঠামোগত দুর্বলতার কারণে টিকে থাকার লড়াই করছে। নিয়মিত উৎপাদন বন্ধ, শ্রমিক অসন্তোষ ও আর্থিক সংকট এই ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছে।
কাস্টমস হাউস ও সীমান্ত বাণিজ্য: দর্শনা সীমান্ত বাংলাদেশের অন্যতম ব্যস্ততম স্থলবন্দর। কিন্তু বাণিজ্যের বড় অংশ এখন চলে যায় প্রভাবশালী গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে। সাধারণ ব্যবসায়ী ও স্থানীয় জনগণ বঞ্চিত হয় সুযোগ থেকে। রাজনীতি ও অর্থনীতির অদ্ভুত মিশ্রণ তৈরি করেছে এক ধরনের দখলদার অর্থনীতি, যা উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করছে।
সামাজিক নেতৃত্বের বিভাজন ও গোষ্ঠীবাদ :
দর্শনার সমাজ একসময় ছিল ঐক্যবদ্ধ ও সহানুভূতিশীল। এখন সেই সমাজ বিভক্ত। সমাজসেবামূলক সংগঠনগুলোতেও দলে-দলে ভাগাভাগি, নেতৃত্ব নিয়ে টানাপোড়েন। কিছু ‘ছদ্মনেতা’ নিজেদের প্রভাব বজায় রাখতে সামাজিক কাজকে ব্যক্তিগত প্রচারের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করছে। ফলে সমাজে নৈতিকতা ও দায়বদ্ধতার পরিবর্তে বেড়েছে হিংসা, বিভাজন ও অবিশ্বাস।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অবনতি ও নীতিহীনতা :
দর্শনার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যেমন— ১৯১৬ সালে মেমনগর বিপ্রদাস উচ্চ বিদ্যালয়, ১৯৬২ সালে দর্শনা বালিকা বিদ্যালয়, ১৯৬৭ সালে কেরু উচ্চ বিদ্যালয়, ১৯৬২ সালে দর্শনা ডিএস মাদ্রাসা, ১৯৬৯ সালে প্রতিষ্ঠিত দর্শনা কলেজ ও অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান একসময় ছিল উচ্চমানের শিক্ষা ও চরিত্র গঠনের কেন্দ্র। আজ সেই প্রতিষ্ঠানগুলো রাজনৈতিক প্রভাব, শিক্ষক নিয়োগে অনিয়ম, এবং ছাত্র সংগঠনের দলীয়করণের কারণে মানহীন হয়ে পড়েছে। শিক্ষা এখন আর মেধা বিকাশের মাধ্যম নয়, বরং ক্ষমতার সোপান। তরুণ প্রজন্ম তাদের নৈতিক ভিত্তি হারাচ্ছে, যা ভবিষ্যতের জন্য বিপদজনক সংকেত।
সাংস্কৃতিক সংগঠনের দলাদলি ও অবক্ষয় :
দর্শনার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য একসময় ছিল উজ্জ্বল। নাটক, সংগীত, সাহিত্যচর্চা, নাট্যদল ও পাঠচক্র—এসব ছিল শহরের প্রাণ। এখন সেই সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো দলীয় দ্বন্দ্বে ভুগছে। পাকিস্তান পর্বেও সারাবছর পালাগান-জারিগান, যাত্রা-সার্কাস, কাওয়ালী, গণসঙ্গীতের সুরে মাতোয়ারা থাকতো এ মশহুর শহর।
স্বাধীনতা পরবর্তী স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের জ্বালানি হিসেবে ১৯৮৩ সালে সৃষ্টি অনির্বাণ সাংস্কৃতিক সংগঠন, ১৯৮৬ সালে সাম্প্রতিক সাংস্কৃতিক সংগঠনের গণ নাটকের মাধ্যমে সারাদেশে দর্শনাকে এক আইকনিক মাত্রায় দাঁড় করাই সেইসময়ের বিপ্লবীরা । যদিও তারও আগে ১৯৬২ সালেই যে আগুনের সূচনা করেছিলো হিন্দোল সঙ্গীত পরিষদ এবং সীমান্ত সংসদ।
আজ সেখানে সংগঠনগুলোর অন্ত:দ্বন্দ্ব, একটি সংগঠন অন্যটির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে ব্যস্ত, আর প্রকৃত শিল্পীরা হয়ে পড়ছে উপেক্ষিত। সংস্কৃতি এখন আর আত্মার প্রতিফলন নয়, বরং রাজনৈতিক পরিচয়ের প্রতীক। এখন এক পীর সাহেবের বিষ-নিশ্বাসে আর তার ভাই-ভাগ্নেদের পারিবারিক তালুকদারীতে; পীরের কতিপয় পাছা-চাটা মুরিদের সেরেস্তাদারীতে ঢাকের কাঠি নড়ে।
এর ফলে দর্শনার সৃজনশীল মনন ভেঙে পড়েছে, এবং তরুণ প্রজন্ম দূরে সরে যাচ্ছে শিল্প-সংস্কৃতি থেকে।
স্বাস্থ্যসেবা হয়েছে দানবদের কারখানা :
৫০ হাজার জনসংখ্যার এ নগরে নূন্যতম উপযুক্ত স্বাস্থ্যসেবার সুবিধা নেই। জরুরী চিকিৎসা পাওয়ার কোন অধিকার নেই দর্শনার মানুষের। প্রাইভেট ক্লিনিকগুলোতে জরুরী সেবা দেবে না। রাত ৯ টার পরে ডাক্তার সাহেবকে পাবেন না। ফোনও বন্ধ। শুধু রাত ৩ টায় ডাক্তার সাহেবকে যদি বলেন, সিজার করতে হবে বা এপেন্ডিস কাটতে। পেয়ে যাবেন! কেরু হাসপাতালে সব সুবিধা পাওয়া যেতো। কিন্তু যে নেতৃত্ব ছড়ি ঘোরাতে তাদের নজর, এটা বন্ধ করে দাও! সিন্ডিকেট বানাও! জনকল্যাণমুখী প্রাইভেট হাসপাতাল বানাও। রাস্তার দু’পাশে যে ডাক্তার…. সাইনবোর্ড লাগিয়ে বসে আছে, খোঁজ নিয়ে দেখে তো কতজনের সত্যিকার ডাক্তারী সার্টিফিকেট আছে –
ভরসা ফার্মেসীগুলো।
ঐতিহ্যবাহী দর্শনার ঐতিহ্য ধ্বংসের কারিগর :
দর্শনা সব মিলিয়ে ছিল এক প্রগতিশীল নগরচেতনার প্রতীক। কিন্তু সময়ের স্রোতে আজ সেই দর্শনা এক মৃত ইতিহাসের পৃষ্ঠা মাত্র। আর এই মৃত্যুর মূল কারিগর কোনো বহিরাগত শক্তি নয়—বরং শহরের ভেতরেই জন্ম নেওয়া কেরানী শ্রেনী মানসিকতার মতলববাজ-বাকোয়াজবাজ এলিট সম্প্রদায়। এই শ্রেণিটি হলো দর্শনার সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক পরজীবী। এরা রাষ্ট্রীয় বা প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতার নিচু স্তরে থেকে ধীরে ধীরে উপরে উঠেছে, কিন্তু চিন্তা-চেতনায় থেকে গেছে নীচেই। এদের কাছে প্রশাসন মানে সুযোগ, নেতৃত্ব মানে প্রভাব, উন্নয়ন মানে নিজের স্বার্থ রক্ষা। এই কেরানী মানসিকতাই দর্শনার ঐতিহ্যবাহী কাঠামোকে ভিতর থেকে খেয়ে ফেলেছে—যেভাবে ঘুনপোকা কাঠকে খায়, কিন্তু বাইরে থেকে সব ঠিকই দেখা যায়।
এই এলিট সম্প্রদায়,— বাকোয়াজবাজ ও বুদ্ধিজীবক, পাকা অভিনেতা । এরা সভা করে, আলোচনা করে, ব্যানার টাঙ্গায়, পত্রিকায় ছবি ছাপে কিন্তু কাজের নামে করে কেবল প্রহসন। তারা উন্নয়ন শব্দটাকে ব্যবহার করে নিজেদের অর্থনৈতিক স্বার্থের ঢাল হিসেবে আর ঐতিহ্যের কথা বলে পুরনো স্থাপনা ও জনসম্পদ বেচে দেয় ব্যক্তিগত কমিশনের বিনিময়ে। ফলে দর্শনার সাংস্কৃতিক ও প্রশাসনিক ঐতিহ্য ধীরে ধীরে পরিণত হয়েছে “নথির কবরস্থানে”।
রাজনৈতিক দিক থেকেও এই শ্রেণি ভয়ঙ্কর। তারা কোনো দল বা মত নয়—বরং ক্ষমতার প্রতি আনুগত্যই তাদের একমাত্র আদর্শ। সরকার বদলায়, রঙ বদলায় কিন্তু এদের মুখের হাসি বদলায় না। কারণ এরা জানে,- যে-ই আসুক, তাদের প্রয়োজন এই ‘অফিস-স্মার্ট’ কেরানী শ্রেণির। ফলে দর্শনার রাজনীতি বা সমাজ কিংবা সংস্কৃতি এখন আর নীতির নয়—এখন তা নেটওয়ার্ক, কমিশন, আর আত্মস্বার্থের সমীকরণ। সামাজিক দিকেও তাদের প্রভাব গভীর। এই শ্রেণি দর্শনার তরুণ প্রজন্মকে শিক্ষা দিয়েছে কীভাবে আদর্শ নয়, পরিচয়ই জীবনযাত্রার মূলধন। তারা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানকে পরিণত করেছে তোষামোদের উৎসবে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে বানিয়েছে পদোন্নতির সিঁড়িতে।
কত তার বাহারি নাম- নাগরিক কমিটি, বাস্তবায়ন কমিটি, আন্দোলন, ঐক্য, জইন্ন্যে আমরা আর একটা শ্রেনী আছে!
যারা দর্শনার মানুষ বলে রাজধানীর বুকে বছর বছর মিলনমেলায় হাজির হয়ে ডায়াসে দাঁড়িয়ে কিংবা কফির কাপ হাতে এসে বলে, …. কেমুন আছো–, এখন কি করচ্ছো— আচ্ছা, আপনার তো সরকারের বড়-বড় আমলা ছিলেন। তাই না?
কেউ সচিব, কেউ মহাপরিচালক, কেউ প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, কেউ চীফ কনসালটেন্ট আরো, আরো, আরো…….। আপনারা তো ইচ্ছে করলেই দর্শনা অঞ্চলের আপনার অধীনস্ত দফতরেই বা আপনার লিংকের একটা একটা সরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি দিতে পারতেন এ শহরের একজনকে । ১৯৯০ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত আপনারা যতজন উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা ছিলেন তারা যদি আজ প্রতিটা ঘরে একজন করে অন্তত সরকারী চাকুরীর বন্দোবস্ত করে দিতেন তাহলেও দর্শনার বর্তমান ৫০ হাজার জনসংখ্যার শহরে ৫ হাজার সরকারি চাকুরে থাকতো। টাকা নিয়েই দিতেন! এইটা তো এখন সিস্টেম। ইচ্ছে করলেই আমি বা আপনি যেতে পারবো না। কিন্ত আপনি দেননি, করেননি। আবার আপনি যে খুবই সৎ মানুষ তাও না। টাকা আপনি নিয়েছে। চাকরিও দিয়েছেন। সেইটা কই? শশুড়বাড়ী এলাকায় কিংবা অন্য এলাকায়।
দর্শনা হারিয়েছে তার মূল্যবোধ, আত্মসম্মান ও নাগরিক ঐক্যের চেতনা। তবু আশার জায়গা আছে। যে সমাজে ধ্বংসের চোরাগোপ্তা শক্তি প্রবেশ করে, সেই সমাজের অন্তঃস্থলে একদিন প্রতিরোধের আগুনও জ্বলে ওঠে। দর্শনার ঐতিহ্য একদিন হয়তো পুনর্জন্ম নেবে—যেদিন এই কেরানী মানসিকতার মতলববাজ ও বাকোয়াজবাজ এলিট সম্প্রদায়ের মুখোশ খুলে যাবে, সেদিন দর্শনা আবার হবে প্রগতির প্রতীক, মানুষের শহর।
আর কিছু আশা করার নেই পুরোনোদের কাছ থেকে :
যারা দশকের পর দশক এই শহরকে শাসন করেছে, তারা আজও নিজেদের ভুল স্বীকার করতে পারে না।
তারা এখনো “আমি করব”, “আমরা উন্নয়ন এনেছি” বলে প্রচারণা চালায়—কিন্তু বাস্তবতায় দর্শনা প্রতিদিন আরও পেছনে পড়ে যায়। তাদের কাছ থেকে এখন আর কিছুই আশা করার নেই। কারণ তারা শহর নয়, নিজেদের ভবিষ্যৎ গড়েছে; মানুষ নয়, নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করেছে।
কিছুদিন আগে এ জেলার একজন শীর্ষস্থানীয় নেতার সাথে গল্প করতে করতে তিনি দারুণ কথা বলল,’তোমরা গত ১৫/১৬ বছরে দর্শনার বাইরের মানুষদের কখনো মানুষ হিসেবেই গণ্য করোনি। এমপি তোমাদের, জেলা পরিষদ তোমাদের, উপজেলা তোমাদের, সেক্রেটারী তোমাদের, প্রেসিডেন্ট তোমাদের… সবই তোমরা। মিছিল করার, মিটিং করার, মহড়া করার সময় আমরা। আমাদের প্রয়োজন গেলে সারারাত বসিয়ে রেখে রাত ৪ টায় দেখা দিয়ে কও তাড়াতাড়ি বল…ঘুমাবো..।
এবার দেখবো তোমরা কি করো!
হয় জীবননগরে ফেলা হবে।
না হয় আন্দুলবাড়িয়া!
একদম শূন্য করে দেয়া হবে।
দর্শনার বর্তমান সংকটের সবচেয়ে ভয়াবহ দিক হলো—নেতৃত্বের প্রতি জনগণের আস্থার মৃত্যু।
পরিবর্তনের দায়িত্ব তরুণদের হাতে:
এখন যদি কিছু করার সুযোগ থেকে থাকে, তবে সেটি তরুণদের হাতে। যাদের বয়স এখন সর্বোচ্চ সর্বোচ্চ ৪০ বছর, যাদের মনে এখনো আদর্শের আগুন, সৎ থাকার সাহস এবং নতুন করে ভাবার শক্তি আছে—তাদেরই নিতে হবে দায়িত্ব। তরুণরা যদি রাজনীতিকে ব্যবসা না বানিয়ে জনসেবার মঞ্চ বানায়, যদি সমাজের ভাঙা বন্ধন জোড়া লাগায়, যদি শিক্ষায় নৈতিকতা ফিরিয়ে আনে, আর সংস্কৃতিতে সত্য ও মানবতার চর্চা করে—তবেই দর্শনা আবার জেগে উঠতে পারে।
এই প্রজন্মের তরুণদের দরকার “আমি পারব” নয়, বরং “আমরা পরিবর্তন আনব”—এই বিশ্বাস।
দর্শনার আলো আবার জ্বলবে তখনই, যখন তরুণরা পুরোনো মুখগুলোর তোষামোদি রাজনীতি ভেঙে নিজেদের সততা ও দক্ষতার মাধ্যমে নতুন নেতৃত্ব গড়ে তুলবে।
পুরোনোরা হারিয়েছে, নতুনরা সেটা ফিরে পেতে পারে :
দর্শনার অতীত গৌরবকে হারিয়েছে একদল আত্মস্বার্থপর নেতৃত্ব। তাদের হাতে রাজনীতি হয়েছে নাটক, অর্থনীতি হয়েছে ব্যবসা, সংস্কৃতি হয়েছে প্রদর্শনী, শিক্ষা হয়েছে কারচুপি, আর স্বাস্থ্যসেবা হয়েছে দানবদের কারখানা।
কিন্তু আশার কথা—দর্শনার মাটি এখনও উর্বর, তরুণদের হৃদয় এখনও সৎ। যদি তারা চায়, তবে তারা পারবে—এই শহরকে আবার নতুন করে গড়ে তুলতে, সততা, সৃজনশীলতা ও সম্মিলিত নেতৃত্বের আলোয়। কারণ ইতিহাসের সব বড় পরিবর্তনই শুরু হয়েছে তরুণদের হাত ধরে। দর্শনাও তার ব্যতিক্রম নয়।
দর্শনার ভবিষ্যৎ এখন তরুণদের হাতে—যারা এখনো বিশ্বাস করে যে পরিবর্তন সম্ভব, যদি কেউ সত্যিই চায়।
দর্শনা একসময় ছিল দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আলোকবর্তিকা। আজ সেই আলো নিভে আসছে—নেতৃত্বের লোভ, অব্যবস্থাপনা ও মূল্যবোধের সংকটে। তবে পুনর্জাগরণের সম্ভাবনা এখনও রয়েছে। যদি স্থানীয় জনগণ ঐক্যবদ্ধ হয়, যদি তরুণ
প্রজন্ম ইতিহাস ও ঐতিহ্যের প্রতি সচেতন হয়, এবং যদি সত্যিকারের নৈতিক নেতৃত্ব সামনে আসে—তবে দর্শনা আবারও জেগে উঠতে পারে নতুন আলোয়।
ঐতিহ্য হারিয়ে গেলে একটি শহর কেবল ভূগোল হয়ে থাকে; কিন্তু ঐতিহ্য ফিরে এলে সেটি হয়ে ওঠে ইতিহাসের প্রতিধ্বনি।


