ঝিনাইদহে সাপের কামড়ে গত কয়েক বছরে রেকর্ড সংখ্যক মৃত্যু হয়েছে। মৃত রোগীদের সবাইকেই সাপে কামড়ালে হাসপাতালে না নিয়ে ওঝার কাছে নিয়ে ঝাড়-ফুক করা হয়েছে।
সাপে কামড়ালে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে হাসপাতালে পৌছে চিকিৎসা নিলে রোগীর মৃত্যুর শঙ্কা থাকেনা। সাপে কামড়ানো রোগীর মৃত্যুর কারণ সময় মতো হাসপাতালে নিয়ে না আসা এবং ওঝার বাড়িতে ঝাড়-ফুক করে সময় নষ্ট করা। ওঝার বাড়িতে ঝাড়-ফুক করে রোগীর যন্ত্রণা উপশম না হলে শেষ সময়ে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। বর্তমানে দেশের সর্বত্র এন্টিভেনম পাওয়া যায়। শুধু প্রয়োজন সাপে কামড়ালে ওঝার বাড়িতে না নিয়ে সময় মতো হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া। কিন্তু ঝিনাইদহের স্বাস্থ্য বিভাগ ওঝার মিথের কাছে পরাজিত হচ্ছে। মানুষকে কিছুতেই ওঝাগীরির বিশ্বাস থেকে সরানো যাচ্ছে না।
গত সপ্তাহের রবিবার জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত জেলা উন্নয়ন সমন্বয় কমিটির সভায় জেলা প্রশাসক মোঃ আব্দুল আওয়াল ও সিভিল সার্জন ডাঃ মোঃ কামরুজ্জামান ওঝাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সকল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ও পুলিশকে নির্দেশনা দেন।
সাপে কামড়ালে ওঝাদের কাছে না নিয়ে হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসার বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে মাইকিং করার প্রস্তাবনাও রাখা হয়। কিন্তু জেলা প্রশাসক ও সিভিল সার্জনের নির্দেশনা উপেক্ষা করে ঝিনাইদহের হরিণাকুণ্ডু ও সদর উপজেলায় ৩টি স্থানে সাপ নিয়ে ঝাপান খেলা অনুষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু প্রশাসন তাদের কোন বাধা প্রদান করেনি। পুলিশও এবিষয়ে অবগত নয় বলে জানিয়েছে।
উন্নয়ন সমন্বয় সভায় উচ্চবাচ্যের পর গত ১৪ ও ১৫ আগস্ট সদর উপজেলার বৈডাঙ্গা গ্রামে দুইদিন ব্যাপী ঝাপান খেলা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এই খেলার আয়োজন করে এই এলাকার প্রেম কুমারের নেতৃত্বে। গত ১৮ আগস্ট হরিণাকুণ্ডু উপজেলার চিতলা পাড়ায় ঝাড়ান খেলা অনুষ্ঠিত হয়। সর্বশেষ গত ২১ আগস্ট সদর উপজেলার সাগান্না গ্রামে সাপের ওঝা তৈয়ব আলী ফকিরের আয়োজনে ঝাপান খেলা অনুষ্ঠিত হয়। হাজার হাজার দর্শক এই খেলা দেখতে আসেন।
এদিকে দেশের বন্যপ্রাণি (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন, ২০১২ অনুযায়ী সাপ ধরা বা খেলা দেখানো একটি অপরাধ, কারণ এই আইনের অধীনে বন্যপ্রাণি সংগ্রহ, আটকে রাখা ও প্রদর্শনের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। বন্যপ্রাণি আইন, ২০১২-এর ৬(১) ধারা অনুযায়ী, সাপ একটি সংরক্ষিত প্রাণি এবং এর খেলা দেখানো বা প্রদর্শনের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কিন্তু এই আইনের বাস্তবে প্রয়োগ নেই।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০২২ সালের ২১ সেপ্টেম্বর হরিণাকুণ্ডু উপজেলার ফলসি গ্রামের দুলাল বারী নামের এক বৃদ্ধকে সাপে কামড়ায়। পরিবারের লোকজন তাকে হাসপাতালে না নিয়ে ওঝার স্মরণাপন্ন হন। ওঝা মোবাইল কলের মাধ্যমেই ঝাড়-ফুক করে বিষ নামিয়ে দেওয়ার আশ্বস্থ করেন। শুধু রোগীকে ভাটির পাতা রস করে খাওয়াতে বলেন। ২২ সেপ্টেম্বর দুলাল বারী মারা যায়। ২০২৪ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি সদর উপজেলার হলিধানী ইউনিয়নের কোলা গ্রামের তুফান মন্ডল নামে এক সৌখিন সাপ পালনকারী পোষা সাপের কামড়ে মারা যান। গত ১০ মে শৈলকুপা উপজেলার খুলুমবাড়িয়া গ্রামের কাদের খন্দকার(৮০) নামের সাপের ওঝা সাপের কামড়ে মারা যান। তিনি তার পোষা সাপকে পানি পান করাতে গিয়ে দংশনের শিকার হন।
ঝিনাইদহের সিভিল সার্জন ডাঃ কামরুজ্জামান বলেন, ওঝা সাপের বিষ নামাতে পারেন এটি একটি ভ্রান্ত ধারণা। সাপ অনেক সময় ড্রাই বাইট করে থাকে। তবে রোগীকে সাপে কামড়ানোর দুয়েক ঘন্টার মধ্যে হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা দিলে রোগীর মৃত্যুর শঙ্কা থাকে না। ঝিনাইদহে সাপে কেটে মৃত্যুর হার অনেক বেশি। অধিকাংশ রোগীকেই ওঝার বাড়িতে নিয়ে সময় নষ্ট করে শেষ সময়ে হাসপাতালে নিয়ে আসেন। গত জেলা সমন্বয় সভায় ওঝাগীরী বন্ধে জেলা প্রশাসক মহোদয় ও আমি সকল ইউএনও, উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ও পুলিশকে ওঝাগীরিতে মানুষের বিশ্বাস তৈরি হয় এমন কর্মকান্ড রোধ করতে বলা হয়। কিন্তু তার পরেও দুই উপজেলায় জাপান খেলা অনুষ্ঠিত হয়ে গেল। খুব দুঃজনক। সাপ একটি বিপজ্জনক বন্য প্রাণি।
ঝিনাইদহ সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হোসনে আরাকে সদর উপজেলা এলাকার দুই জায়গায় অনুষ্ঠিত ঝাপান খেলার বিষয়ে জানতে চাইলে বৃহষ্পতিবার তিনি বলেন, আমার জানা ছিল না। এখনই ব্যবস্থা নিচ্ছি।
স্বেচ্ছায় সারাদেশে বিষধর সাপসহ অন্যান্য বন্যপ্রাণি উদ্ধারের কাজ করেন বোরহান বিশ্বাস রোমন। তিনি বলেন, সাপে কাটার চিকিৎসা হাসপাতালে করানোর রীতির সাথে ঝাপান খেলা সাংঘর্ষিক। ঝাপান খেলা মানুষের ওঝার প্রতি মিথ্যা বিশ্বাস তৈরি করে। ঝাপান খেলা বন্ধ করা উচিৎ। এটা দেশের আইন অনুযায়ী একটি দন্ডনীয় অপরাধ। প্রশাসন চাইলে আইন অনুয়ায়ী ব্যবস্থা নিতে পারেন।