কোটচাঁদপুরের মঙ্গলপুরে বাস নেই কোন মানুষের

গ্রাম আছে মানুষ নাই ! হঠাৎ কথাটি শুনে অবাক হওয়ারই কথা। আজ থেকে দেড়’শ বছর আগের গ্রামের কথা এখন অনেকটা রুপ কথার গল্পের মত। আসলেই এমন একটি মানুষ শূন্য গ্রাম রয়েছে ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুর উপজেলার এলাঙ্গী ইউনিয়নে। গ্রামটি উপজেলা শহর থেকে মাত্র ৫ কিলোমিটার দূরে। নাম মঙ্গলপুর । কোটচাঁদপুর উপজেলা মানচিত্রে থাকা এমনি এক গ্রামের খোঁজে যায় এই প্রতিবেদক।
সরেজমিনে যেয়ে দেখা যায়, গ্রামটিতে কোন জনবসতি নেই। মঙ্গলপুর গ্রাম জুড়ে ধান, মুশুরি ইক্ষুসহ বিভিন্ন ফসলাদি আর ফলজ বাগান। রয়েছে বেশ কয়েকটি বশতভিটার ধ্বংসাবশেষ , রয়েছে পুকুর । দেখলেই বোঝা যায় এক সময় এই গ্রামে মানুষের বসবাস থাকলেও এখন আর নাই।

গ্রামটি মানবশূন্য কেন এই প্রশ্ন জানতে যায় পার্শ্ববর্তী বলাবাড়িয়া গ্রামের ৯৫ বছর বয়স্ক খালেক খানের কাছে। বর্তমানে তিনিই ওই গ্রামের বয়স্ক ব্যক্তি। তিনি বললেন, আমি নিজে মঙ্গলপুর গ্রামের মানুষ শূন্য হওয়ার বিষয়ে খুব একটা জানিনা। তবে বাপ দাদাদের কাছে শুনেছি এক সময় এই মঙ্গলপুর গ্রামে মানুষের বসবাস ছিল। তাদের অনেকের গোলা ভরা ধান, ছিল গোয়াল ভর্তি গরু। গ্রামটি প্রায় মানুষ শুন্য হয়ে পড়ে আজ থেকে দেড়’শ বছর আগে। সর্বশেষ হাজরা ঠাকুর, নিপিন ঠাকুর এরা ৪/৫ ঘর মানুষ ছিল তিনি দেখেছেন। আজ থেকে ৮০/৮৫ বছর আগে তারাও ঘরবাড়ী ভেঙ্গে চলে যায়। তিনি বলেন, পরবর্তীতে এরা হয়তো মাঠের মধ্যে নিরাপত্তা বোধ করেনি সে কারণে চলে গেছে। ঘরবাড়ী ভেঙ্গে আগে যারা গেছে তারা কি কারণে চলে গেছে এ সম্পর্কে তেমন কোন তথ্য দিতে পারেননি খালেক খান।

যেভাবে মানবশূন্য হয় মঙ্গলপুরঃ
বলাবাড়িয়া গ্রামের ৬৮ বছর বয়সী মুক্তার আলি বলেন, শুনেছি মঙ্গলপুর গ্রামের মঙ্গল পাঠান নামের একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি ছিলেন তার নামেই গ্রামটি’র নাম মঙ্গলপুর। মঙ্গল পাঠানের তিন একর জমির উপর ছিল বিশাল বাড়ী । বাড়ীর চতুর ধারে উচুঁ করে ৩০ থেকে ৪০ ইঞ্চি চওড়া মাটির প্রাচীর (গড়) ছিল। পাশের পুকুরের উচু পাড়ে দাঁড়িয়ে নাকি বাড়ীর ভীতরের কাউকে দেখা যেত না। ওই পরিবার ছিল ভীষণ ভাবে পর্দাশীল। বাড়ির বউ-মেয়েরা কখনো বাইরের পুরুষের দেখা দিত না। ওই মঙ্গল পাঠান এখানেই মারা যান। তার কবরও রয়েছে এখানে। তিনি বলেন, শুনেছি ১২ জাতির বাস ছিল এ গ্রামটিতে। অত্যাচারিত হয়ে ওই গ্রামের মানুষ গ্রাম ছেড়েছে কিনা তা কখনো শুনিনি। তবে সঠিক কি কারণে মানুষ গ্রাম ছেড়েছে তা, আমাদের বাপ দাদারাও বেঁচে থাকা অসস্থায় বলতে পরেননি বলে জানান তিনি।

তবে এই এলাকায় চাউর আছে, এক সময় কলেয়া গুটি বসন্ত ওই গ্রামটিতে ছড়িয়ে পড়ে। অনেক মানুষ ওই কলেরিয়া গুটি বসন্তে মারা যায়। মৃতদের মধ্যে শিশুর সংখ্যা ছিল বেশী। গ্রামে বিভিন্ন জায়গা থেকে ডাক্তার ,কবিরাজ ,ওঝাঁ নিয়ে এসে ঝাড় ফুক করাসহ গ্রাম বন্ধ করেও কলেয়া গুটি বসন্ত নিয়ন্ত্রণে না আসায় ওই গ্রামে অনেকে মনে করতে থাকে কোন দৈব শক্তির কারণে এমনটি হচ্ছে। তাদের বিশ্বাস জন্মাতে থাকে এ গ্রামে থাকলে তারাও বাঁচবেনা। ভয়ে তখন মানুষ ওই গ্রাম ছাড়তে শুরু করে। ধীরে ধীরে মানুষজন ঘর বাড়ী ভেঙ্গে যে যার মত ভারতসহ দেশের সুবিধামত জায়গায় যেয়ে বসবাস শুরু করে। সেই থেকে ওই গ্রাম মানুষ শুন্য হয়ে যায়।

এলাকার ইউপি চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান খাঁন বলেন, মঙ্গলপুর গ্রামের জমি জমা সব পরবর্তীতে ওই গ্রামের বসতিদের উত্তরসূরিরা বিভিন্ন জায়গা থেকে এসে পার্শ্ববর্তী গ্রামের মানুষের কাছে বিক্রি করে গেছে। এখন মঙ্গলপুর গ্রাম জুড়ে শুধুই ফল ফসলের মাঠ। তিনি বলেন, মঙ্গলপুর গ্রাম পর্যন্ত ১৮ফুট চওড়া মাটির রাস্তা ছিল। বর্তমানে রাস্তাটি তিনি হেরিং করে দিয়েছেন। রাস্তাটি এখন শুধুমাত্র মঙ্গলপুর মাঠের ফসলাদী আনা নেয়ার কাজে ব্যবহার হয়। ওই গ্রামের রাস্তার পাশেই মসজিদের নমুনা পাওয়া যায়। সেখানে মাঠে কর্মরত কৃষকেরা নামাজ আদায় করে। যে কারণে সেখানে পানির ব্যবস্থার জন্য টিউবওয়েল বসিয়ে দেয়া হয়েছে। চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান খাঁন বলেন, এলাকাতে তেমন বয়স্ক মানুষ বেঁচে না থাকায় মঙ্গলপুর গ্রামের প্রকৃত ইতিহাস এখন আর কেউ বলতে পারবে না।