কোন পথে হাঁটবে শিশুরা?

ছোট বেলা থেকেই বড়দের বলতে শুনেছি, ‘আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ’। তখন অবশ্য ভবিষ্যতের ‘ভ’ বর্ণটা কেবল স্লেটে লেখা শিখেছি। কিন্তু প্রগাঢ় রূপে বোঝার সুযোগ হয়নি।

ভূমিষ্ঠকালীন ব্যক্তির প্রাথমিক রূপ শিশু (ঈযরষফ)। শিশু হিসেবে সমাজ কিংবা রাষ্ট্রে সেই চিহ্নিত হয়ে আছে যে এখনও যৌবনপ্রাপ্ত হয়নি কিংবা বয়ঃসন্ধিক্ষণে প্রবেশ করেনি। ইউনিসেফ’র শিশুসনদে আছে ০-১৮ নিচে বয়স এমন সকলেই শিশু। জীববিজ্ঞানের ভাষায় – মনুষ্য সন্তানের জন্ম এবং বয়ঃসন্ধির মধ্যবর্তী পর্যায়ের রূপ হচ্ছে শিশু। চিকিৎসাশাস্ত্রের সংজ্ঞানুযায়ী মায়ের মাতৃগর্ভে ভ্রুণ আকারে অ-ভূমিষ্ঠ সন্তানই শিশু। এই শিশুদের জন্য প্রতি বছর স্বীকৃত একটা বিশেষ দিনও থাকে, যাকে আমরা বলি শিশু দিবস।

১৯২৫ সালে শিশু কল্যাণ বিষয়ক বিশ্ব সম্মেলনের সময় জেনেভাতে প্রথম আন্তর্জাতিক শিশু দিবস ঘোষণা করা হয়েছিল। শিশু দিবস বাচ্চাদের সম্মানে প্রতিবছর পালিত একটি স্মরণীয় দিন। প্রতিটি দেশের সিদ্ধান্তানুসারে দিনটি ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে । বাংলাদেশে ১৯৯৬ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিনটিকে শিশু দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় এবং ১৭ মার্চ শিশু দিবস হিসেবে পালন করা হয়। ১ জুন ১৯৫০ সাল থেকে বেশিরভাগ কমিউনিস্ট এবং উত্তর-পূর্ববর্তী কমিউনিস্ট দেশগুলিতে দিনটি উদযাপিত হয়। ১৯৫৯ সালের ২০ নভেম্বর ইউএন-ইউনাইটেড নেশন(টঘ) জেনারেল অ্যাসেমব্লির মাধ্যমে শিশু অধিকারের ঘোষণার স্মরণে বিশ্ব শিশু দিবস পালিত হয়।

শিশু দিবস পালন করার যথার্থ মর্ম আমরা কতটুকু বুঝি? নিজের বিবেককে প্রশ্ন করে দেখি? আমার ঘরের শিশুটি কতটুকু নিরাপদ? সে কি নিজেকে বিকশীত কিংবা মুক্তমনা করতে পারছে? শতাংশের অবস্থানে দেখা যাবে অর্ধেকেরও নিচে বসবাস আমাদের। তার একটা বিশেষ কারণও আছে। শিশু হিসেবে বেড়ে ওঠা আগামীর অগ্রদূত নিজের মতো বাঁচতে শেখার আগেই ঘটে বড় বিপত্তি।

একটা শিশুর জন্মের পর তাকে দেখতে আসা শুভাকাক্সিক্ষরা প্রথমে কোলে তুলে নিয়েই বলেন, মণি/বাবু তোমাকে কিন্তু চাচার মতো হতে হবে। কেউ বলেন তোমাকে নানার মতো হতে হবে, আবার কেউবা বলেন খালার মতো হতে হবে। মা-বাবার সামাজিক অবস্থান যদি অন্যের কাছে অর্থভান্ডার/জ্ঞানভান্ডার উত্তমরূপে প্রকাশ পায় তবে কেউ কেউ মা-বাবার মতোও হতে বলেন। চলমান এ অবস্থার রূপকার কিন্তু আমরা নিজেরা। এখন বিষয় হলো শিশুটা কোথায় যাবে? কোন পথে হাঁটবে? আমরা সর্বদা আমাদের ইচ্ছা, চাওয়া-পাওয়া, নিজের অপ্রাপ্তি, নিজের অতৃপ্ত বা অঙ্কিত স্বপ্নকে চাপিয়ে দিয়ে থাকি সন্তানের উপর।

এক সেকেন্ডের জন্য কখনও ভেবে দেখি না আমার সন্তান কি চায়। এ যেন বৃহৎ বটের চারাকে পাঁচ ফুটের টবে রোপন করার মতো। বর্তমানে আরও একটি বড় সংক্রমিত রোগ হলো এ-প্লাস পাওয়া। শুধু এ-প্লাস পেলেই চলবে না পেতে হবে গোল্ডেন। কারণ শুধু এ-প্লাস রূপা ধাতুর মতো, মূল্য কম, কিন্তু গোল্ড অনেক মূল্যবান ধাতু তাই ওটাতেই জীবনের তীর বিঁধাতে হবে। নিশানা আবার শিক্ষার্থীর থেকে বেশি থাকে বাবা-মায়ের। প্রথম শ্রেণির আগে থেকেই শুরু হয়ে পারিবারিক এই রঙিন স্বপ্নের, যার সমাপ্তি হয় বিদেশগমন, কাক্সিক্ষত চাকরী কিংবা অকাল মৃত্যু দেখে।

কিছুটা যান্ত্রিক জীবন চক্রের মতো। কথা গুলোর মানে আবার এমন নয় গোল্ডেন এ-প্লাস পাওয়া ভালো নয়। তবে এটাও সত্য গোল্ডেন এ-প্লাস জীয়নকাঠি নয়। আজও বাংলাদেশে পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়ার কারণে ১১.৮% ছেলে-মেয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়(তথ্য সূত্র: দৈনিক আমাদের সময়, ০২ জুন, ২০২০)। অকৃতকার্যরা কি আমাদের চোখে অন্য গ্রহের? ফল প্রকাশের পর আমাদের তর্জনী কিন্তু অকৃতকার্যদেরই নির্দেশ করে এবং পঞ্চকানে পৌঁছে দিতে সংবাদ দৌঁড়মারে।

নিশ্চিয়ই সংখ্যা শব্দটির সাথে আমরা সবাই পরিচিত। সংখ্যা হলো পরিমাপের একটি বিমূর্ত ধারণা আবার সংখ্যা প্রকাশের প্রতীকগুলিকে বলা হয় অঙ্ক। অর্থাৎ বিমূর্ত ধারণাটাই জীবনের জন্য অনেক বেশি মূল্যবান। গণনার ইতিহাস থেকে গণনার কয়েকটি পদ্ধতি জানা যায়। যেমন- মিশরীয় গণনা পদ্ধতি, ব্যাবিলনীয় পদ্ধতি, গ্রীক ও রোমান পদ্ধতি, মায়া সভ্যতার গণনা পদ্ধতি, আধুনিক পদ্ধতি।

এসব পুস্তকবদ্ধ পদ্ধতির বাইরে আধুনিকতার ছোঁয়ায় আমরা আবার অভিভাবক পদ্ধতি চালু করেছি। যেখানে আপনার প্রিয় সন্তানকে শ্রেণির প্রথম হতে হবে আর পরীক্ষার খাতায় একশতে একশ নতুবা নব্বইয়ের ঘরে নম্বর তুলতেই হবে। এ যেন চ্যবনপ্রাশ, খেলেই কাশি বিনাশ। আবার ৮০% বা ৯০% ছুঁতে না পারলে সোনার-এ প্লাস/ এ প্লাস মুখ থুবড়ে পড়ে থাকবে। তখন অভিভাবকের কি হবে? কে দেবেন সান্তনা? এ শোক তো শক্তিতে রূপান্তরিত হওয়ার নয়। আমার পরিবারও কিন্তু এমন চরিত্রের বাইরে নয়। মূলত এটা বোধশক্তি ও দৃষ্টি ভঙ্গির বিষয়।

“ যখন যেমন মনে করি তাই হতে পাই যদি, আমি তবে এক্ষুণি হই ইচ্ছামতি নদী”

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতাও বলে দেয় শিশুরা ওদের ইচ্ছা মত করে বাঁচতে চায়। আপনিতো অভিভাবক অর্থাৎ শিশুর মঙ্গলকামনাকারী, চিন্তক এবং পথ নির্দেশক। ওকে চার দেওয়ালের গন্ডিতে বাঁধবেন না। ওকে বলবেন রাস্তার বাঁ পাশ দিয়ে হাঁটতে হয়, কখনও সে ডান পাশে যাবে না। ক্লাসের ‘সেরা’ শব্দ দখল করতে বইয়ের বোঝা পিঠে চাপাবেন না। সাঁতার কাটাতে শেখান, ডুববে না। কাদা-মাটি মাখুক, মন নোংড়া হবে না। গল্পে গল্পে বাংলার ইতিহাস জানান, শেকড়ের টান বিনষ্ট হবে না।

মাঝে মাঝে গ্রামীণ পরিবেশে নিয়ে যান, দেখবেন সে কামার, কুমার, জেলে, মাঝি, তাঁতি, গাছ, মাছ, পশু, পাখি সহ পরিবেশকে ভালোবাসতে শিখবে। নিয়মিত প্রার্থনালয়ে নিয়ে যান, কখনও সে অন্য ধর্মের মানুষের প্রতি হিংসা, অশ্রদ্ধা শিখবে না। সুস্থ সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে যুক্ত করুন, বিপথ উঁকি দেবে না। সাইকেল চালাতে শেখান, আপনার সন্তান পিছিয়ে থাকবে না। লেখ্য, কথ্য, আঞ্চলিক যা হোক বাংলা ভাষা শেখান, সে ইংরেজিতে গালা গাল দেবে না।

শিশুর সামনে শিক্ষামূলক কিছু দেখুন, ভবিষ্যতে শিশুটি মোবাইলে গেম কিংবা অলীক স্বপ্নে ভাসবে না। আপনি ওর মতামত শুনুন, নৈতিক শিক্ষা দিন দেখবেন কখনও সে আপনাকে মেরে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠাবে না। ভুল করলে শিশুর গায়ে আঘাত না করে সঠিকটা উপস্থাপন করুন। আপনার কাছে আকাশের রং নীল হলেও শিশুর কাছে কালো, লাল বা অন্য যেকোন রং হতে পারে। কারণ আকাশটা শিশু দেখছে, আপনি নন। ওর চোখে নিজের চোখ মেলাবেন না।

আমাদের দেশে আজও বহু সুস্থ শিশু জন্মায়, কিন্তু বেশির ভাগ শিশু একটা সময় পরিবার ও সমাজের কারণে রূপান্তরিত হয় মানসীক প্রতিবন্ধীতে। শিশুর মনের বিরুদ্ধে যাওয়া মানে তার মন জগতের স্তরকে ধ্বংস করা আর এর দায় বহন কিন্তু আমাদের সকলকে করতে হবে। ভেবে দেখুন দায় মুক্ত হবেন, নাকি দায়ের ভারে সারাটা জীবন ঋণী থাকবেন? সমাধানের পথ নির্বাচন নিজেকেই করতে হবে।

উন্নয়ন কর্মী
দি হাঙ্গার প্রজেক্ট-বাংলাদেশ