খবর বিক্রেতার খবর রাখে না কেউ

রোদ-বৃষ্টি, গরম-শীত উপেক্ষা করে কাঁকডাকা ভোরে তারা ছুটে আসেন পত্রিকা দপ্তরে কিংবা এজেন্টের কাছে। সেখান থেকে দৈনিক পত্রিকা সংগ্রহ করে আবার ছুটতে শুরু করেন গ্রাহকের দরজায়। দেশ, সমাজ, বিশ্বের খবর মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়া যেন তাদের ব্রত। দেশ ও জনপদের সমস্যা-সম্ভাবনার খবর বিলি করলেও তারা থেকে যান অগোচরে। তাদের মাঝেও লুকিয়ে আছে সুখ-দুঃখের গল্প।

ঝিনাইদহের কয়েকজন পত্রিকা বিক্রেতার সাথে কথা বলে সেই তথ্য মিলেছে। তেমনই একজন হাসানুজ্জামান। ১২ বছর আছেন পত্রিকা বিক্রির পেশায়। বাড়ি তার ঝিনাইদহ সদরের অন্তর্গত ৩ নং সাগান্না ইউনিয়নের নাথকুন্ডু গ্রামে। দীর্ঘ এ সময়ে পত্রিকা বিক্রির পেশাতে থেকে এক খণ্ড জমি কিনে বাড়ি করেছেন।

তিনি বলেন, মাসে মাত্র ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা উপার্জন করেন। এত অল্প আয়েও তার পথচলা থেমে থাকেনি। একমাত্র মেয়েকে লেখাপড়া শেখাচ্ছেন। মেয়েকে মানুষের মত মানুষ করতে চান।

অল্প বেতনে সংসার চলে কীভাবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সৎপথে অর্থ উপার্জন করে কোনোরকম দিন চলছে। দ্রব্যমূল্যের যে উর্ধ্বগতি তাতে জীবন চালানো কঠিন। বর্তমান সময়ে আয় কমই।

তিনি এক প্রশ্নোত্তরে বলেন, ‘অন্য পেশায় যেতে চান না। জীবনের বেশির ভাগ সময় আছি এই পেশায়। অন্য পেশায় যাওয়া আর সম্ভব না। এই পেশাকে ভালোবেসে ফেলেছি; এতেই আমি আনন্দ পাই। জীবনের শেষ পর্যন্ত এই পেশায় থাকবো।’

বর্তমান সময়ে পত্রিকার চাহিদা কেমন জানতে চাইলে, তিনি বলেন, মানুষ আগের মতো পত্রিকা পড়ে না। বর্তমান ইন্টারনেটের যুগে পত্রিকা পাঠকরা পত্রিকা পড়া একেবারেই বন্ধ করেনি তবে প্রযুক্তির কল্যাণে পত্রিকার যে চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল তা কমে গেছে।

৩ নং সাগান্না ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মুন্সী মোঃ শাহীন রেজা সাঈদ বলেন, হকার্সরা, খবরের কাগজ ও পাঠক উভয়ের মাঝে সেতুবন্ধন তৈরিতে ভূমিকা রাখেন। সমাজের আর পাঁচটি পেশার চেয়ে তাদের পেশা ভিন্ন। অন্য পেশার লোকদের বেতন বাড়ার সুযোগ থাকে। কিন্তু তাদের পত্রিকা বিক্রির উপর নির্ভর করতে হয়। ফলে দিনদিন জীবনযাপন কঠিন হয়ে যাচ্ছে।

হাসানুজ্জামান অনেক আশা-আকাক্সক্ষা নিয়ে ২০০২ সালে লক্কর ঝক্কর এক বাইসাইকেল ও ৫০ টি আঞ্চলিক পত্রিকা নিয়ে শুরু করেন বিক্রয় প্রতিনিধি হিসেবে তার জীবন। তার এ কাজ গুটি গুটি পায়ে আজ দেড় যুগ পেরিয়ে গেছে কিন্তু কোন উন্নতি নেই। তার জীবনের সুখ-আশা-আকাক্সক্ষা হয়তবা কোন দিন পূরণ হবে কি না, তা নিয়ে ভাবেন এই হাসান।

প্রতিদিন ভোর হওয়ার পূর্বেই পৌঁছাতে হয় চুয়াডাঙ্গায়। সেখান থেকে পত্রিকা সংগ্রহ করে ঝিনাইদহ সদর উপজেলার ডাকবাংলাসহ বিভিন্ন হাট-বাজার, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান,সরকারি-বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে সারাদিন লক্কর ঝক্কর বাইসাইকেলে ঘুরে ঘুরে পত্রিকা বিক্রি করে।

এ-বিষয়ে ডাকবাংলার পত্রিকা বিক্রয় প্রতিনিধি হাসান “দৈনিক মেহেরপুর প্রতিদিন পত্রিকার”ডাকবাংলা প্রতিনিধিকে জানান, “আমি ২০০২ সাল থেকে আজ প্রায় দেড় যুগ ধরে এই পত্রিকা বিক্রয় করি। এক সময় অফিস আমাদের জন্য প্রতি বছরে একটি করে গেঞ্জি ও এক বার খেতে দিতো কিন্তু এখন আর কিছুই দেয় না।

ডাকবাংলার কিছু সংবাদপত্র প্রেমীদের কারণেই পত্রিকা বিক্রি করতে পেরে আমার ফ্যামেলিকে কোন মতে বাঁচিয়ে রেখেছি। প্রতিদিন আমি পত্রিকা বিক্রি করে সর্বনিম্ন ২০০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৩০০ টাকা পর্যন্ত আয় করি। আর এজন্য সারাদিন পাঠকদের কাছে দৌড়তে হয়। পত্রিকা বিক্রি করে আমার একমাত্র কন্যা সন্তানকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করার স্বপ্ন দেখছি কিন্তু হবে কিনা আল্লাহ ভালো জানেন।

এ বিষয়ে ইসলামী সমাজ কল্যাণ সংস্থার সহ-সভাপতি মোঃ মাসুম বিল্লাহ বলেন, পত্রিকা বিক্রয় প্রতিনিধিদের জীবন অত্যন্ত কষ্টের। এদের প্রতি সরকারের সুদৃষ্টি দেয়া উচিত বলে তিনি মনে করেন।