‘খাস আদায়’ করছেন দুই যুব মহিলা লীগ নেত্রী

মেহেরপুরের মুজিবনগর মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি কমপ্লেক্সের পিকনিক কর্ণার থেকে সরকার রাজস্ব হারাচ্ছে লক্ষ লক্ষ টাকা। গত দুই বছর ধরে বেসরকারী ব্যক্তিদের দিয়ে খাস কালেকশনের দায়িত্ব দেওয়ায় এ ঘটনা ঘটছে।

মেহেরপুর জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে টেন্ডার করা হলেও অজ্ঞাত কারণে টেন্ডার ছাড়াই পিকনিক কর্ণারটি লিজ দেওয়া হচ্ছে। তবে অভিযোগ রয়েছে কিছু লোককে সুবিধা পাইয়ে দিতে উপজেলা যুব মহিলা লীগের সভানেত্রী আকলিমা খাতুন ও সাধারণ সম্পাদিকা তহমিনা খাতুনকে এই লিজ দেওয়া হয়েছে। তাদের দুইজনের নেতৃত্বে এগারো জন খাস কালেকশনের দায়িত্বে আছেন।

গত শনিবার সরেজমিনে গিয়ে জানা গেছে, জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে বাস প্রতি চারশ টাকা, মিনিবাস দুইশো টাকা, নছিমন-করিমন ও অটো ৫০ টাকা এবং মোটরসাইকেল প্রতি ১০ টাকা করে খাস আদায় করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অথচ গাড়ি প্রতি চুলার নাম করে অতিরিক্ত একশো টাকা আদায় করা হচ্ছে যা রিসিপ্টে উল্লেখ নাই। পিকনিকের এই মৌসুমে প্রতিদিন গড়ে একশ টি গাড়ি এই পিকনিক কর্ণারে আসছে। ফেব্রুয়ারি এবং মার্চ মাস জুড়ে গড়ে একশোটি গাড়ি আসে বলে স্থানীয় ব্যবসায়ীরা জানান। তবে অন্যান্য মাসগুলোতেও একশ নাহলেও প্রতিদিনই অনেক গাড়ি আসে।

ফলে প্রতিবছর চার থেকে পাঁচ মাসে জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ লাখ টাকা আদায় হয়। দুই বছর আগে ওই পিকনিক কর্ণারটি ভ্যাটসহ ২৭ লাখ টাকায় লিজ দেওয়া হয়েছিল। অথচ গত বছর খাস আদায় করে ১১ লাখ টাকার মত পেয়েছিল সরকারি রাজস্ব খাতে। এবছরও খাস আদায় করা হচ্ছে। ফলে গত দুই বছরে লক্ষ লক্ষ টাকা রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সরকার । অপরদিকে, গুটিকতক রাজনৈতিক নেতা যারা লিজ নিয়েছেন তারা পকেটস্থ করছেন লক্ষ লক্ষ টাকা।

যশোরের খাজুরা বাজার থেকে পিকনিকে আসা মিহির ঘোষ ও আলকামা বিশ^াস জানান, গাড়ি প্রতি পাঁচশ টাকা নেওয়া হলেও রশিদ দেওয়া হচ্চে চারশ টাকার। এছাড়া কোন কথা বলতে গেলে তারা খুব খারাপ আচরণ দেখাচ্ছে।

নাটোরের কেশবপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারি প্রধান শিক্ষক মাজহারুল ইসলাম লিটনের নেতৃত্বে বিদ্যালয়ের বার্ষিক শিক্ষা সফর হিসেবে দুটি গাড়ি নিয়ে এসেছিলেন মুজিবনগরে। তিনি জানান, দেশের অন্যান্য পর্যটন স্থানের মত মুজিবনগর এক করলে হবে না। মুজিবনগর আমাদের চেতনার জায়গা। এই মুজিবনগরে আসতে পথে পথে চাঁদাবাজির শিকার হতে হয়েছে। মেহেরপুর জেলায় প্রবেশ করেই এই চাঁদাবাজির ঘটনা ঘটছে। মুজিবনগওে পৌছাতে গিয়ে প্রায় নয়শ থেকে এক হাজার টাকা খরচ করতে হচ্ছে। এটা খুবই দু:খজনক।

মুজিবনগর পিকনিক কর্ণারের একটি দোকানের মালিক ইছাহাক মল্লিক জানান, মুজিবনগরে আসা পর্যটকদের কাছে থেকে কোন টাকা নেওয়ায় উচিৎ নয়। এটা আমাদের স্বাধীনতার জায়গা। আমি ১৯৯৬ সাল থেকে এখানে ব্যবসা করি। আগে একশ টাকা নেওয়া হত। এখন চারশ থেকে পাঁচশ টাকা নেওয়া হচ্ছে।

তিনি আরো জানান, পিকনিক কর্ণারের আম বাগানে গাছ রয়েছে প্রায় ৩শ টি। হায়াত আলী নামের এক ব্যক্তির কাছে তিন লাখ ৩০ হাজার টাকায় বাগানটি বিক্রি করা হয়েছে। সৌচাগারটিও ফ্রি লিজ ফ্রি থাকলেও ৩০ হাজার টাকা দিয়ে লিজ দেওয়া হয়েছে।

মুজিবনগরনাজমুল ইসলাম নামের অন্য দোকান দার জানান, ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাসে প্রতিদিন গড়ে ১০০টি গাড়ি আসে পিকনিক কর্ণারে। সে হিেেসব চারশ টাকা করে গাড়ি প্রতি হলে দুই মাসে আয় হয় ২৪ লাখ টাকা। এছাড়াও ডিসেম্বর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত কমবেশি গাড়ি আসে এই পিকনিক কর্ণারে।

মৌখিকভাবে খাস আদায়ের লিজ গ্রহিতা মুজিবনগর উপজেলা যুব মহিলা লীগের সভানেত্রী তকলিমা খাতুন ও সাধারণ সম্পাদিকা তহিমনা খাতুন জানান, ইউএনও স্যার আমাদের শ্রমিক হিসেবে দায়িত্ব দিয়েছেন। আমরা টাকা তুলে উনার কাছে জমা দিব। উনি আমাদের কত কি দিবেন আমরা জানি না। আমরা এগারো জন এই খাস আদায়ের দায়িত্বে রয়েছি। আজ (গত শনিবার) সকাল থেকে বেলা সাড়ে ১২ টা পর্যন্ত ৮৪টি গাড়ির খাস আদায় করেছি।

মেহেরপুর পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামীলীগের সভাপতি নুরুল ইসলাম বলেন, দুই বছর আগে তিনি কম মূল্য দেওয়ায় টেন্ডার পাননি। তার বিপরীতে ২৭ লক্ষ টাকা ডাক দিয়ে আরিফুল এনাম বকুল টেন্ডার পেয়েছিলেন। কিন্তু দুই বছর টেন্ডারের জন্য তাকে কিছু জানানোও হয়নি বলে তিনি অভিযোগ করেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন আওয়ামীলীগ নেতা জানান, কিছু জনকে এই সুবিধা দেওয়ার জন্য জেলা প্রশাসন থেকে কৌশলে তাদের দায়িত্ব দিয়ে খাস আদায় করাচ্ছেন। এতে সরকার প্রচুর রাজস্ব হারাচ্ছে।
মুজিবনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) উসমান গনি বলেন, কাঙ্খিত মুল্য না পাওয়ায় ডিসি স্যারের নির্দেশনা মোতাবেক অভিজ্ঞ কিছু লোককে দায়িত্ব দিয়ে খাস আদায় করা হচ্ছে।

মেহেরপুরের জেলা প্রশাসক মো: আতাউল গনি বলেন, মুজিবনগর স্মৃতি কমেপ্লক্স দেখভালের জন্য কোন অর্গানোগ্রাম নাই, কোন লোকবলও নাই। তিন বার টেন্ডার দেওয়া হয়েছে। কাঙ্খিত মূল্য না পাওয়ায় নিয়মানুযায়ী খাস কালেকশন করা হচ্ছে। মুজিবনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার তত্ত্বাবধানে পূর্বের অভিজ্ঞতা আছে এমন কয়েকজনকে এই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তবে বাগান ও সৌচাগার লিজের ব্যাপারে তিনি কিছু জানেন না।

মেপ্র/ইএম