গণতন্ত্রের কতটুকু মুল্যয়ন হলো

স্বাধিনতার ৫০ বছরে বাংলাদেশে গণতন্ত্র দেশের মানুষ ও রাজনৈতিক দলের কাছে কতটুকু মুল্যায়িত হলো এ নিয়ে দিনে দিনে সংশয় প্রকোট হচ্ছে। দেশের মোট জনসংখ্যার কতটুকুই বা গণতন্ত্র সম্পর্কে ধারনা রাখে। গণন্ত্রকে দেশে প্রতিষ্ঠিত করার দায়িত্বিই বা কারা পালন করবে। এসব প্রশ্ন দেশের গণমাধ্যমে প্রতিনিয়ত প্রচার হচ্ছে। টেলিভিশন খুললে টকশোতে গলাফাটিয়ে সুশিল সমাজের প্রতিনিধিরা প্রতিদিন বলে চলেছেন।

গণতন্ত্র’ শব্দের উৎপত্তি গ্রীক ভাষায় ডেমোক্র্যাটিয়া থেকে। এর অর্থ, ‘জনগণের দ্বারা শাসন।’ এটি দুটি সংক্ষিপ্ত শব্দকে একত্রিত করেছে: ‘ডেমো(উবসড়)’ অর্থ একটি নির্দিষ্ট নগর-রাষ্ট্রের মধ্যে বসবাসকারী সমগ্র নাগরিক এবং ‘ক্র্যাটোস(কৎধঃড়ং)’ অর্থ ক্ষমতা বা শাসন। খ্রিস্টপূর্ব ৫ম শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে কিছু গ্রীক নগর-রাজ্যে বিদ্যমান রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে বোঝানোর জন্য এটি ব্যবহৃত হয়েছিল। বিশ্বের প্রথম গণতন্ত্র সৃষ্টি হয় গ্রিসের একটি শহর-রাষ্ট্র এথেন্সে। গণতন্ত্রের জনক বলা হয় এরিষ্টটলকে। তবে, আধুনিক গণতন্ত্রের জনক হলেন জন লক।

বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে গণতন্ত্র শব্দের অর্থ শুধুমাত্র একটি অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচন ও নাগরিকদের ভোটের অধিকার। যাতে করে তারা আবার ক্ষমতায় আসতে পারে। কিন্তু দেশের মানুষের কাছে গণতন্ত্র সম্পর্কে জানতে চাইলে তাঁরা বলবে। খাদ্য, বাসস্থান, কর্ম, নিরাপত্তা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বস্ত্র এসব মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা। গণতন্ত্র এমন একটি শব্দ যা যুগ যুগ ধরে রাজনৈতিক চিন্তা জগতে তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। গণতন্ত্র কথাটির ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হচ্ছে জনগণের শাসন বা কর্তৃত্ব। গণতন্ত্র এমন এক ধরনের শাসন ব্যবস্থা যে শাসন ক্ষমতা সমাজের সদস্যদের কাছে থাকে। গণতন্ত্রের মূল কথা হচ্ছে শাসন সংক্রান্ত ব্যাপারে শাসিতের সম্মতি লাভ।

রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে বিংশ শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কার্যকরী ছিল পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে। একবিংশ শতাব্দীতে এসে সে চিত্র অনেকটাই বদলে গেছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে পৃথিবীর অনেকে দেশে গণতন্ত্র নামেমাত্র কার্যকর রয়েছে।

বর্তমান বিশ্বে দুই ধরণের গণতন্ত্রের প্রচলন রয়েছে। একটি প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র অপরটি প্রতিনিধিত্ত গণতন্ত্র।

প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র হচ্ছে, নাগরিকরা কোনো মধ্যবর্তী প্রতিনিধি বা সংসদের হাউস ছাড়াই সরাসরি কোনো নীতির পক্ষে ভোট দিতে পারে। সরকারকে কোনো আইন বা নীতি পাস করতে হলে তা জনগণের কাছে যায়। তারা ইস্যুতে ভোট দেয় এবং তাদের নিজেদের দেশের ভাগ্য নির্ধারণ করে। জনগণ এমনকি নিজেরাই ইস্যু তুলে আনতে পারে, যতক্ষণ না তাদের ইস্যুতে যথেষ্ট ঐকমত্য থাকে। এমনকি জনসমর্থন ছাড়া করও বাড়ানো যায় না!

উদাহরণস্বরূপ, সুইজারল্যান্ড একটি সফল প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রের দেশ। দেশের কিছু নির্দিষ্ট জায়গায় সমাবেশে লোকেরা একত্রিত হয় এবং তাদের সমাজের আইনে ভোট দেয়।

প্রতিনিধিত্ত গণতন্ত্র হচ্ছে, প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র বা পরোক্ষ গণতন্ত্র হল যখন জনগণ তাদের প্রতিনিধিত্বকারীকে ভোট দিয়ে সংসদে পাঠায় । এটি বর্তমানে গণতন্ত্রের সবচেয়ে সাধারণ রূপ। এর পাশাপাশি, এটি রাজ্যের সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষার উপর জোর দেয়। তারা যোগ্য প্রতিনিধি নির্বাচন করার মাধ্যমে, তাদের অভিযোগ আরও দক্ষতার সাথে সোচ্চার করতে সক্ষম হবে। গণতন্ত্রের এই রূপের নেতিবাচক দিক হল নির্বাচিত সরকার নাগরিকদের স্বার্থ অনুসরণ করতে ব্যর্থ হতে পারে।

বিশ্বের অধিকাংশ প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্র নিজেদেরকে উদার গণতন্ত্র বলে মনে করে। এর কারণ হল তারা সমগ্র রাষ্ট্রের চেয়ে তাদের স্বতন্ত্র নাগরিকদের চাহিদাকে বেশি মূল্য দেয়। এই কারণেই ভারত এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা কঠিন।
মধ্যেম আয়ের দেশে যখন সরকারি কম মুল্যের টিসিবির ট্রাকের পিছনে দরিদ্র জনগোষ্ঠির মানুষ সামান্য তেল ডাল চিনির জন্য ঝুলে পড়ে। সেখানে মানুষের অধিকার প্রাপ্যতা নিয়ে দোলাচাল চলতে দেখা যায়। দেশের দায়িত্বশীল মন্ত্রীরা খুব গর্ব করে গণমাধ্যমে বলেন মানুষের আর্থিক অবস্থা অনেক ভালো। তখন স্বাভাবিকভাবে মানুষ অশহায় হয়ে পড়ে। রাষ্ট্রে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা নিয়ে সংশয় সৃষ্টি হয়।
বাংলাদেশে সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক রাজনীতি গড়ে উঠতে পারেনি নানা কারণে। স্থানীয় পর্যায়ে নেতৃত্ব সৃষ্টি হওয়ার পথে বিচিত্র বাধা। একদিন এ দেশে সামন্ততন্ত্র ছিল। জমিদার ও জমিদারের ছেলেমেয়েরাই ছিলেন তাঁদের এলাকার প্রভু। গণতন্ত্রের যুগে নতুন সামন্ততন্ত্র শুরু হয়েছে পরিবারতন্ত্রের প্রথার মাধ্যমে। আগে ছিল জমিদারের পরিবার, এখন নেতার পরিবার।

রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্রের কথা বলা হয় জাতীয় পর্যায়ের নেতৃত্বের ক্ষেত্রে। কিন্তু স্থানীয় পর্যায়ে যে পরিবারতান্ত্রিক কুপ্রথার সৃষ্টি হয়েছে যা গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির সম্পূর্ণ বিরোধী। বাংলাদেশে গত ৫০ বছরে পরিবারতন্ত্রের অসংখ্য দৃষ্টান্ত আমাদের হাতে আছে। এই পরিবারতান্ত্রিক প্রথার জন্ম দিয়েছে বাংলাদেশের দুটি বড় শাসক দল। তাদের দলের কোনো সাংসদ মারা গেলে উপনির্বাচনে তাঁর পরিবারের সদস্যদের মধ্যে স্ত্রী, পুত্র বা কন্যাকে ওই আসনে মনোনয়ন দেওয়া হয়। যাঁদের মনোনয়ন দেওয়া হয় তাঁদের যোগ্যতা থাক বা না থাক। ওই আসনে দলের আর কেউ যদি প্রার্থী হওয়ার স্পর্ধা দেখান, তবে তাঁর বিপদের শেষ নেই। তার ফলে গণতন্ত্রের চর্চা ব্যাহত হচ্ছে।

লেখক ও গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদ ভাষায় রাজনীতিতে জনগণের অংশগ্রহণ না থাকায় তারা রয়েছে অন্ধকারে ও হতাশায়। কোনো এলাকার কোনো দলের প্রার্থীর নাম অনানুষ্ঠানিকভাবেও যদি বছরখানেক আগে ঘোষণা করা হয়, তাহলে ভোটাররা তাঁর ব্যক্তিগত জীবন ও যোগ্যতা বিচার করে দেখার সময় পান। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রধান বৈশিষ্ট্য স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি। রাজনৈতিক দলের ভেতরেই যদি স্বচ্ছতা না থাকে, তাহলে জনগণের শাসন বা সুশাসন প্রতিষ্ঠার আশা দুরাশা। সুষ্ঠু নির্বাচনের আন্দোলনের সঙ্গে রাজনৈতিক সংস্কৃতির গলদ দূর করার জন্যও গণতন্ত্রকামী নেতাদের উদ্যোগ নিতে হবে।

লেখক: প্রথম আলো মেহেরপুর প্রতিনিধি।